ডিজিটাল মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াতী কার্যক্রম

islamড. মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম: ইংরেজি ডিজিট শব্দের বিশেষণ হলো ডিজিটাল। ডিজিটের বাংলা অর্থ অঙ্ক; এখানে অঙ্ক অর্থ গণিত শাস্ত্র নয়। ০ হতে ৯; এই দশটি অঙ্কের ভিত্তিতে ডিজিটাল যন্ত্রপাতির বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ক্যালকুলেটর, মোবাইল ফোনসেটসহ সব ধরনের ডিজিটাল যন্ত্রপাতি ০ এবং ১ এ দুই অঙ্কের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়। আধুনিক সভ্যতা ডিজিটাল যন্ত্রপাতির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে সাড়াজাগানো আলোচিত বিষয় হচ্ছে ইন্টারনেট। এর ব্যবহারের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া বা মাধ্যম। মিডিয়াকে বলা হয় সমাজের আয়না। এটি দু’ধরণের, প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক বা ওয়েব মিডিয়া। টেলিফোন, রেডিও, পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, মোবাইল, কম্পিউটারের সাথে যুক্ত হয়েছে বর্তমান প্রযুক্তির সর্বাধিক উন্নত সংস্করণ ইন্টারনেট। এটি ব্যবহার করছে ছাত্র-শিক্ষক, নারী-পুরুষ, অফিসার-কর্মচারী, ছোট-বড় সকলেই।
একজন মুসলিমকে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনে পথ চলার জন্য হালাল-হারাম যাচাই-বাছাই করে চলা আবশ্যক। এটি প্রত্যাশিত যে, প্রতিটি সচেতন মুসলিম ইন্টারনেট ব্যবহারকারী অনৈতিক পথ পরিহার করে যাবতীয় কাজ পরিচালনার করবেন; পাশাপাশি এর মাধ্যমে নিজেকে একজন আল্লাহর পথে আহ্বানকারী তথা দা‘ঈ হিসেবে মানুষকে আল্লাহর পথে আহ্বান করবেন।
বর্তমান সময়ে সুউচ্চ অট্টালিকার দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে দা’ওয়াতী কাজ করা খুবই কষ্টসাধ্য বৈকি। এমতাবস্থায় ইন্টারনেট হতে পারে দাওয়াতী কাজের এক বিশ্বমঞ্চ। যার মাধ্যমে একজন দা‘ঈর বক্তব্য মুহূর্তেই ছড়িয়ে দিতে পারেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সংবাদপত্র পাঠ, তথ্য সংগ্রহ ও আদান-প্রদান, যোগাযোগ, হিসাব সংরক্ষণ, ফাইল ও ডাটাবেজ সংরক্ষণ, শিক্ষা ও গবেষণার কাজ, কেনাকাটা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, সামাজিক যোগাযোগ, বিনোদন, লাইভ ভিডিও কনফারেন্স, কুরআন-হাদীস চর্চা, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ, ইসলামের দিকে দাওয়াতদান, ইসলামের শত্রুদের জবাবদান, মাকতাবাতুশ শামেলার ব্যবহার, অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম, নৈতিক চরিত্র গঠন ও উপকারী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যে কাজ শেষ করতে অনেকগুলো মানুষের প্রয়োজন হয়, যে কাজ করতে অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হয় তা স্বল্প সময় ও অর্থ ব্যয়ে অতিদ্রুততারসাথে নিপুণভাবে শেষ করা যায়। তাই দিন দিন ইন্টারনেটের উপর মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে। এমতাবস্থায় ইসলাম নিয়ে যারা ভাবেন, ইসলামের প্রসারই যাদের কাম্য ও কর্ম, তাদের হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না।
ইসলাম প্রচারে ইন্টারনেট নামক ডিজিটাল মাধ্যমকে কাজে লাগানো এখন সময়ের দাবি। ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর তার কথার চেয়ে কার কথা উত্তম, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সৎকর্ম করে এবং বলে অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা ফুসসিলাত: ৩৩)
আরো ইরশাদ হচ্ছে, ‘বল, এটি আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (সূরা ইউসুফ: ১০৮)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আল্লাহ যদি তোমার মাধ্যমে একজনকে হিদায়াত দেন তবে তা লাল উটের চেয়ে উত্তম।’ (বুখারী)
তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি বাক্য হলেও পৌঁছে দাও।’ (বুখারী)
আগে সমাজ সংস্কারকগণ বাজারে, মসজিদে ও বিভিন্ন লোক সমাগমস্থলে গিয়ে মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিতেন। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এ উৎকর্ষের যুগে একজন দা‘ঈ ঘরে বসেই ডিজিটাল মাধ্যমে দাওয়াত পৌঁছাতে পারেন কোটি কোটি লোকের দুয়ারে। আর ইতোমধ্যে বিশ্বে মুসলমানগণ এর মাধ্যমে বিভিন্ন ওয়েবসাইট খুলে ইসলাম প্রচারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মাধ্যমে কাজ করা অনেক সহজ এবং তুলনামূলক খরচ অনেক কম। একবার পোস্ট করলে দীর্ঘ মেয়াদী দাওয়াতের প্রচার চলতে থাকে। মানুষের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে হয় না। ব্যাপক অঙ্গনজুড়ে একে কাজে লাগানো যায়। কিছু নেতিবাচক দিক থাকলেও এর ইতিবাচক দিকই বেশি। বর্তমানে পাশ্চাত্যের অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে জানতে সক্ষম হচ্ছে এবং অনেকে ইসলাম গ্রহণ করছে। এর মাধ্যমে আরো ব্যাপক দাওয়াতী কাজের বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
ডিজিটাল মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে যেভাবে ইসলামের দিকে মানুষকে আহবান করা যায়, বিশেষকরে যাঁরা এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন তাঁরা হলেন আলিম সমাজ। বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার একটি বিরাট ঐতিহ্য রয়েছে। মাদ্রাসায় পড়া কেন প্রয়োজন, এতে দেশ ও মানবতার কীরূপ সেবা হয়, এ ধরনের প্রবন্ধ-নিবন্ধ তাতে থাকতে পারে। মাদ্রাসার সকল শিক্ষককে প্রতি মাসে অথবা দুই মাসে ন্যূনতম একটি করে ছোট গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে বলা হবে। সেগুলো দায়িত্বশীল কারো সম্পাদনার পর ইন্টারনেটে মাদ্রাসার ওয়েবসাইটে দিয়ে দেয়া। ছাত্ররা যে দেয়ালিকা প্রকাশ করে তা ওয়েবসাইটে দেয়া যেতে পারে। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কার্যক্রম, সিলেবাস, বার্ষিক মাহফিল ইত্যাদি সবকিছু ওয়েবসাইটে থাকবে ও তা নিয়মিত আপডেট দিবে। আলিমদের নিয়মিত বক্তব্য-আলোচনাগুলো ওয়েবসাইটে দেয়া। ওয়েবসাইটে প্রশ্ন করার অপশন থাকবে। যেন পাঠক বা ভিজিটর সহজেই প্রশ্ন করতে পারেন এবং যে কোন বিষয়ে ইসলামী সঠিক সমাধান পেতে পারেন।
লেখক: নিজের লিখিত প্রবন্ধ, যেগুলো বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো ব্যক্তিগত সাইটে প্রকাশ করা। ছোট স্মৃতি, অনুভূতি, দৈনন্দিন ডায়েরী বা অপ্রকাশিত ইসলামী লেখাগুলো সাইটে দেয়া। প্রকাশিত বাইগুলোর ভূমিকা, সূচি, প্রাপ্তিস্থান ইত্যাদি সাইটে দেয়া। মন্তব্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে পাঠক-ভিজিটরদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করা যেতে পারে।
ইসলামী বই প্রকাশক: প্রকাশনার একটি নিজস্ব সাইট থকতে পারে। সেখানে প্রকাশিত সব বই এর প্রচ্ছদ, ভূমিকা, সূচি, মূল্য ও প্রাপ্তিস্থান উল্লেখ করা। নতুন নতুন বইয়ের সংবাদ ও রিভিউ প্রকাশ করা যেতে পারে। ই-কমার্সের মাধ্যমে সহজেই বই বিক্রয় করা যেতে পারে।
মসজিদের খতীব: নিজের নামে ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট খুলতে পারেন। সেখানে নিজের ওয়াজ-নসিহত, জুমু‘আর বয়ান ইত্যাদির অডিও-ভিডিও রাখা যেতে পারে। নিজের প্রবন্ধ-নিবন্ধ রাখতে পারেন। দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর নানা ইসলামী দিক তুলে ধরে ব্লগ লিখতে পারেন। পাঠক যেন প্রশ্ন করতে পারেন, সে অপশনও রাখতে পারেন। এছড়া আরো যেভাবে দায়িত্ব পালন করা যায়- ইসলামী প্রত্রিকা চালু করা। সেটি দৈনিক, মাসিক ও ত্রৈমাসিক হতে পারে। কমিউনিটি ব্লগ ও ফোরামের মাধ্যমে।
সোশ্যাল কমিউনিটি সাইটের মাধ্যমে: যেমন- ফেসবুকে বেশি বেশি ইসলামী গ্রুপ খুলে বন্ধু-বান্ধবকে আহবান করা ও ইসলামী স্ট্যাটাস দেয়া। ইসলামী সাইট, আর্টিকেল, অডিও ও ভিডিও লিংক বেশি করে শেয়ার করা। কুরআনের আয়াত, হাদীস বা স্কলারদের উক্তি স্ট্যাটাসে দেয়া। ইসলামী সাইটের ফ্যান পেজ খুলে, ইসলামী নোট লিখে বন্ধু-বান্ধবকে ট্যাগ করা। ই-মেইল, ইয়াহু এবং গুগল গ্রুপ-এ ইসলামী গ্রুপ খুলে ইসলামী আর্টিকেল পাঠানো। Ranking ভালো এমন সাইটে ইসলামী সাইটের প্রচার করা। ব্লগার ডট কম, ইউটিউব, ফেসবুক, ওয়ার্ডপ্রেস ইত্যাদি সাইটে যতবেশি সম্ভব ব্লগ লিখে বা লিংক শেয়ার করে ইসলামী সাইটের প্রচার করা। টেক্সট ও অডিও চ্যাটের মাধ্যমে বিভিন্ন চ্যাটরুম গুলোতে ইসলাম প্রচার করা যেতে পারে। ইসলামী মাহফিল, সেমিনার বা আলোচনা সভার সরাসরি সম্প্রচার ও অডিও আপেলোড করা। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে সমৃদ্ধ কোন ইসলামী সাইটের বিভিন্ন কনটেন্ট (বিষয়সূচি) প্রচার করা। যেমন হজ্জের ও রমজান মাসে সংশ্লিষ্ট বিষয় সাইটে তুলে ধরা। নতুন সাইটের নতুন নতুন বিষয়গুলো পুরো লিংকসহ প্রচার করা। নতুন প্রবন্ধ দিয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা। নবাগত ভালো লেখকদের মন্তব্য জানিয়ে উৎসাহ প্রদান করা। যে ইবাদত সামনে আসছে মানুষকে তার কথা স্বরণ করিয়ে দেয়া। যেমন লায়লাতুল কদর, আশুরার সাওম ইত্যাদি। চলমান ইস্যুগুলো সংশ্লিষ্ট ফিকহী দিকগুলো মানুষকে স্বরণ করিয়ে দেয়া। মানুষকে বিদআত, নিষিদ্ধ ও হারাম কাজ থেকে সতর্ক করা। নির্দিষ্ট কোন হারাম কাজ নির্মূলের কথা স্বরণ করিয়ে দেয়া এবং তা নির্মূলের চেষ্টা করা। জনকল্যাণমূলক কাজে মানুষকে পথ দেখানো। বিপদগ্রস্ত মানুষের আশু সাহায্যের আবেদন প্রচার করা। মানুষকে সুসংবাদ পৌঁছে দেয়া। মিথ্যা খ-ন করা এবং ইসলামের অপপ্রচারের জবাব দেয়া। দা’ওয়াতী কাজে সহযোগিতার আবেদন প্রচার করা। অশ্লীলতার বিরুদ্ধে সরকারীভাবে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া। অনেক মানুষ আছেন যারা ইসলামের জন্য কিছু করতে চান। তাদের এ অনুভূতি যে মৃত্যুর পরও তা সাদাকা হিসেবে অব্যাহত থাকে।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখন কোন মানুষ মারা যায় তখন তার সমস্ত আমলের ধারা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি কাজ ব্যতীত। সেগুলো হচ্ছে, সাদাতুল যারিয়া, উপকারী জ্ঞান ও নেক সন্তান।’ (মুসলিম)
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুলুল্লাহ সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন ভালো কাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান জানাবে, যারা তার অনুসরণ করবে তাদের অনুরূপ সাওয়াবই ঐ ব্যক্তির জন্য লিখা হবে। অথচ এটি তাদের সাওয়াবের কোন অংশ কমিয়ে দিবে না। আর যে ব্যক্তি কোন ভ্রষ্টতার দিকে আহ্বান জানাবে, তাকে যারা অনুসরণ করবে তাদের সমান পাপই লিখা হবে তার জন্য। অথচ এটি তাদের পাপসমূহ থেকে এতটুকু কমবে না।’ (মুসলিম)
প্রত্যেক মুসলিমকে এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, জীবনে যত সময় ব্যয় হয় কিয়ামতের দিন এ সময়গুলোর হিসাব দিতে হবে। ডিজিটাল মিডিয়াসমূহ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ ন্যায় ও সুন্দরের পথে চলুক, অন্যায় ও অশ্লিলতা পরিহার করুক এবং এখান থেকে মানবজাতি আরো বেশি উপকৃত হোক সে প্রত্যাশাই করছি।
লেখক: ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল আলম, সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button