একুশ এখন সারা বিশ্বের

Ekushe Googleআবুল খায়ের: প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের মনের ভাব প্রকাশের নানা মাধ্যম ছিল। ইশারা, ইঙ্গিতে অথবা সাংকেতিক চিহ্নের মাধ্যমে কথা বলত। মাটি, কয়লা, গাছের বাকল, চামড়া, পাথর ইত্যাদি ব্যবহার করত ভাব প্রকাশের জন্য। আস্তে আস্তে মানুষ লেখার চেষ্টা করতে থাকে। বলার জন্য যেমন ভাষার দরকার। আবার সেটা যদি লিখে রাখা যায় এবং পরবর্তীতে প্রয়োজনে কাজে লাগানো যায়। সে চিন্তা থেকেই ক্রমশ লেখার প্রচলন। বিভিন্ন মাধ্যম ও ধারার পটপরিবর্তন ও বিবর্তনের পথ অতিক্রম করে আজ বিশে^র নানান দেশে নানান ভাষার প্রচলন লাভ করেছে। আর তারই চূড়ান্ত পর্যায় হলো ভাষা। সেটা লেখ্য অথবা কথ্যরূপ। ভাব প্রকাশের সবচেয়ে সুন্দর ও সহজ মাধ্যম হলো ভাষা। ভাষা ছাড়া কোন জাতি বা গোষ্ঠীর টিকে থাকা দুরূহ। পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ হাজারেরও বেশি ভাষা আছে। অনেক ভাষা কালের আবর্তের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারায় হারিয়ে গেছে। এখনও অনেক ভাষা আছে, যেগুলো অচিরেই বিলুপ্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সামান্য কিছু লোক ব্যবহার করে এমন ভাষা আছে প্রায় কয়েক হাজার। কিছু কিছু ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আবার কিছু ভাষা আছে যেগুলো ক্রমান্বয়ে দাপটের সাথে প্রভাব বিস্তার লাভ করছে সারা পৃথিবীতে। বিশ্বের প্রধান দশটি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম। সংখ্যার দিক দিয়ে চতুর্থ। এটা কম কিসে? এদিক দিয়ে আমরা অনেক সৌভাগ্যবান জাতি। আবার অন্য দিক দিয়ে আমরাই একমাত্র জাতি যারা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আন্দোলন, সংগ্রাম এবং জীবন দিতে হয়েছে অকাতরে।
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্বার মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। সাথে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও লাঠি চার্জ। পুলিশের গুলিতে বুকের তাজা রক্ত উজাড় করে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রমাণ করল মায়ের ভাষার প্রতি এ দেশের মানুষর কত দরদ। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিকসহ আরো নাম না জানা অনেকে সেদিন শাহাদাত বরণ করল। সারা বাংলা তখন আন্দোলনের অগ্নিশিখায় প্রজ্বলিত হতে থাকল। একসময় পাক হানাদারেরা এ দেশের জনসাধারণের প্রচণ্ড আন্দোলনের ও যৌক্তিক দাবির মুখে মেনে নিতে বাধ্য হলো। বিশ্ব দরবারে জন্ম নিল একটি নাম। একুশ। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ শুধু বাংলাদেশের নয়, বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য নয়, সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কাছে জনপ্রিয়। জাতিসঙ্ঘের অফিসিয়াল ভাষাগুলোর একটি ভাষা বাংলা এবং ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত ভাষাও বটে।
পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষার দৈন্যদশা। কারণ সেখানে বাংলা ব্যবহার কমে যাচ্ছে দিন দিন আশঙ্কাজনকভাবে। বাধ্য হয়ে ও যৌক্তিক কারণে ইংরেজি অথবা হিন্দি ভাষা রপ্ত করতে হয় তাদের। ফলে বাংলা ভাষা তার মর্যাদা হারাতে বসেছে পশ্চিম বাংলায়, যা চিন্তার বিষয় বাংলা ভাষার প্রেমিকদের। তবে সারা বিশ্বে বাংলা ভাষার মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনিভাবে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংস্কৃত ভাষাসহ অনেক ভাষা আছে নতুন শব্দ ইচ্ছে করলেই তারা গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু বাংলা ভাষা ব্যতিক্রম। যেকোনো নতুন শব্দ বাংলা ভাষা খুব সহজে গ্রহণ করতে পারে। এটাই বাংলা ভাষার বৈচিত্র্যতা ও সৌন্দর্য। ফলে বিদেশীরাও বাংলা ভাষা শেখার প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে ব্যাপকভাবে। যেটা আমাদের জন্য সুখবর।
কিন্তু হতাশার বিষয় হলো বাংলা ভাষা নিয়ে সেরকম পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি এখন পর্যন্ত। ব্যবহার ও প্রয়োগের সীমাবদ্ধতাকে দূর করাও সম্ভব হয়নি। বানানরীতির সমস্যাতো আছেই। হয়নি ব্যাপকভাবে ব্যবহার। অফিসিয়ালি এখনো ইংরেজি ভাষাই ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক বই, পুস্তক এমনকি আইনের বইগুলো এখনো বাংলা প্রচলন করা যায়নি, কোনো এক অজানা কারণে। আদালতে এখনও ইংরেজি ভাষাই ব্যবহার হচ্ছে। যদিও এ নিয়ে অনেক আপত্তি, আলোচনা হয়েছে। সভা সেমিনার কোনো কাজেই আসছে না। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই অনেক আশা, প্রত্যাশার কথা শোনা যায়। কিন্তু পরে সবাই ভুলে যায়। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করো, করতে হবে। এই স্লোগান এখন আর শোনা যায় না বললেই চলে। স্কুল, কলেজ, দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বেশির ভাগ সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। সাইবোর্ডে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও লেখা থাকলে সমস্যা কোথায়? দায়িত্বশীলদের এ বিষয়ে নজর দেয়া উচিত।
আমরা একসময় ইন্টারনেটে ও মোবাইলে বাংলা লিখতে পারতাম না। এখন পারি। মাত্র কয়েক বছর আগের ঘটনা। ফেসবুকে একদিন আইটি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বার (বর্তমানে মন্ত্রী)কে জিজ্ঞেস করলাম ইন্দোনেশিয়ান ভাষাকে গুগুলে ট্রান্সলেট করা যায় সহজে অথচ বাংলা কেন করা যায় না? তিনি উত্তর করলেন আমাদের দেশের কোনো সরকারই এ নিয়ে কোনো ইনভেস্ট করেনি। তা ছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে এত বড় ইনভেস্ট করাও কঠিন। অথচ খুব কম সময়ে অনেক দূর এগিয়েছি আমরা। গুগলে এখন সহজে বাংলা লিখলেও অনুবাদ করা যায়; আবার ইংরেজি না জানলেও সমস্যা নেই বাংলা লিখলেও সরাসরি ইংরেজি হয়ে যায় বা করে নেয়া যায়। ফলে ইমেল/ইন্টারনেট এমনকি ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও বাংলা ব্যবহার হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
বাংলা আমার অহঙ্কার। কেউ বলে একুশ আমার অহঙ্কার। আবার কেউ বলে থাকে একুশ আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। বায়ান্নর পরিণতিই একাত্তর। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত এ দেশের জনগণ একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করত। কেউ তো বাধাদান করার সাহস পায়নি তখন। নীরব দর্শকের মতো দেখত। কোনো বাজেট ছিল না একুশ পালন করার জন্য। কোনো প্রজ্ঞাপন বা নির্দেশ জারি করার অপেক্ষা জনগণ করেনি। শুরু হয়ে গেল শহীদ মিনার নির্মাণের হিড়িক। বিভিন্ন আকৃতির। বিভিন্ন মডেলের। ইট, কাঠ, সুরকিতে তৈরি করা শহীদ মিনার কত স্বমহিমায় স্থান পেয়ে আসছে বাঙালি জাতির হৃদমাঝারে।
স্বাধীনতার পর আর পেছনে তাকানোর সময় নেই। ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করল শহীদ মিনার। বিভিন্ন ঐতিহাসিক জায়গায় এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের উদ্যোগেই শহীদ মিনার তৈরি হতে থাকে। আর এখনতো শুধু বাংলাদেশ অথবা আসাম বা পশ্চিম বাংলায় নয়; সারাবিশ্বের মানুষের একটি অহঙ্কারের বিষয় একুশ।
তবে দেশের একশ্রেণীর লোক ইংরেজি ও বাংলায় জগাখিচুড়ি ভাষায় কথা বলার মধ্যে নিজেদের শিক্ষিত ও উচ্চবিত্তের লোক বলে প্রকাশ করার হীন প্রচেষ্টা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। ওরা বাংলায় কথা বলাকে নিম্নবিত্তের ভাষা মনে করে। ইংরেজি ভাষাসহ অন্য যেকোনো ভাষা শিখবে প্রয়োজনে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে আগে বাংলা ভাষাকে রপ্ত করতে হবে ভালোভাবে। বাংলা জানতে ও চর্চা করতে হবে। ভাষার প্রতি কোনো প্রকার অবজ্ঞা করা যাবে না। নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষাকে সহজ ও সাবলীলভাবে প্রকাশ করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কলেজ/ভার্সিটি পর্যায়ের বইগুলো ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় রচনা করতে হবে। বাংলা, ইংরেজি দুইটাই পড়ার সুযোগ থাকতে পারে। যারা চাইবে বাংলা/ইংরেজি পছন্দ মতো পড়তে পারবে।
বাংলাদেশ ছাড়াও সিয়েরালিয়নের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। সারা বিশ্বে এখন বাংলা ভাষার মর্যাদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক দেশে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে শহীদমিনার নির্মাণ করছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আসলেই বায়ান্নর ভাষা শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে সবাই প্রস্তুতি গ্রহণ করে। যথাযোগ্য মর্যাদায় একই দিনে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশে^র মানুষ পালন করে থাকে। নিজের ভাষার প্রতি যেমন ভালোবাসা থাকবে তেমনি অন্যের ভাষার প্রতিও শ্রদ্ধবোধ থাকতে হবে। এটাই হলো একুশে ফেব্রুয়ারির শিক্ষা। আর এই বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির কারণেই বাংলাদেশ আজ সারা বিশে^র এক অকুতোভয় জাতি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। যারা ভাষার জন্য দেশের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করা পবিত্র দায়িত্ব মনে করে বুকের তাজা রক্তকে বিলিয়ে দিয়ে শহীদ হয়েছেন, তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও সালাম এবং তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button