আল-কোরআনের মাহাত্ম্য

Biggest Quranআলেমা আমাতুল্লাহ তামান্না: কোরআন মাজীদ আল্লাহ তায়ালার কালাম বা বানী। যুগে যুগে মহান আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির ইহজগতের কল্যানময় জীবন এবং পরজগতের মুক্তির সনদরূপে বানী এবং কিতাব প্রেরন করেছেন। প্রেরিত সেসব প্রত্যাদেশরই সর্বশেষ চ‚ড়ান্ত রূপ আখেরী নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফার (সা:) নিকট প্রেরিত আল-কোরআনুল কারীম। পবিত্র কোরআন প্রতিটি মানবসন্তানেরই অবশ্য পঠিতব্য একখানা পবিত্র গ্রন্থ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- “অথবা তদপেক্ষা বেশী কোরআন আবৃত্তি করুন সুবিন্যস্তভাবে ও স্পষ্টভাবে।” -সূরা মুযাম্মিল:৪।
কোরআন মাজীদের অনেক হক রয়েছে, কুরআনে কারীমের যে সকল হক রয়েছে তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হক হলো সহজ ও সঠিকভাবে বাক্য উচ্চারন করা। আল্লাহ তায়ালা উপরোক্ত আয়াতে এটাই নির্দেশ দিয়েছেন। পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ উচ্চারনসহ শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ চিন্তা করে তদ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে তেলাওয়াত করাই হচ্ছে তারতীল তেলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য।
হাদীস শরীফে কোরআন তিলাওয়াতকে সর্বোত্তম ইবাদত আখ্যা দেওয়া হয়েছে, তা সত্তে¡ও এ ইবাদত আমাদের কাছে অবহেলিত। এমন মুসলমানের সংখ্যা খুবই কম, যারা প্রতিদিন নিয়মিত কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করেন। আগেকার যমানায় আমাদের পূর্বসূরীদের অবস্থা এমন ছিল যে, তাঁরা রাতের পর রাত নামাযে কাটিয়ে দিতেন তিলাওয়াত মগ্ন হয়ে। কোরআনের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের কারনে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা:) এর উপাধি ছিল, তরজমানুল কুরআন বা কুরআনের ভাষ্যকার। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তির কল্বের মধ্যে কোরআনে কারীম রয়েছে তাকে যদি জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হয় তাহলে জাহান্নামের আগুন তার দেহ পুড়বে না। (হাদীসের একাধিক অর্থের মধ্যে এটিও একটি অর্থ।)
কুরআনে কারীমের সম্মান ও মর্যাদা অনেক উর্দ্ধে। তাই যে ব্যক্তি এ কোরআনে কারীমকে তার কলবে ধারন করতে পারবে তাকে কোনো কারনে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হলেও জাহান্নামের আগুন তাকে দগ্ধ করতে পারবে না। এমনটি হবে কুরআন শরীফের বরকত ও মর্যাদার কারনে। এজন্য আমরা কোরআন শরীফের খুব ইজ্জত করব। হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র.) বলেন, যে ব্যক্তি তিনটি আমল করবে দুনিয়াতে তার রিযিকের কোনো অভাব থাকবে না। তার খাদ্যের অভাব হবে না। পোশাক ও বাসস্থানের অভাব হবে না। তার প্রয়োজন পূরনের যাবতীয় আসবাবপত্র আল্লাহ তায়ালা ব্যবস্থা করে দেবেন। সে ৩টি আমল হলো:- ১.কোরআন সহীহ শুদ্ধভাবে শিক্ষা করা। ২.অন্যকে সহীহ শুদ্ধভাবে কোরআন শিক্ষা দেওয়া। ৩. কোরআনের ধারক-বাহকদের সম্মান করা।
আমরা রিযিকের জন্য পেরেশান, দিন-রাত কতই না মেহনত করি। তো এ তিনটি আমল করতে পারলে আল্লাহ পাক আমাদের রিযিকের অভাব ও পেরেশানী দূর করে দিবেন ইনশাআল্লাহ। কোরআনে কারীমের তিলাওয়াত শিক্ষা করা ফরযে আইন। প্রত্যেক মুসলমানের ওপর সহীহ শুদ্ধভাবে কোরআনে কারীমের তিলাওয়াত শিক্ষা করা ফরয। কোরআন শরীফে সহীহ শুদ্ধ তিলাওয়াত না জানলে তো নামাযই আদায় হবে না। বড়ই আফসোসের বিষয়, আজ মুসলমানদের অনেকেই কোরআন তিলাওয়াত করতে জানে না। যারা জানে তাদের অনেকের তিলাওয়াত সহীহ শুদ্ধ হয় না। কোরআন শরীফের তিলাওয়াত প্রত্যেক মুসলমানকে অবশ্যই শিখতে হবে। যাদের বয়স হয়ে গেছে তাদেরও শিখতে হবে। অনেকে ছোট বেলা কোরআন শরীফ পড়েছিলো কিন্তু এখন ভুলে গেছে। এমন ব্যক্তিদের ও কোরআন শিখতে হবে। কোরআন শিক্ষা করা এক দিকে তো ফরয অপরদিকে এতে অনেক ফযীলত রয়েছে। মাদরাসায় যেমন তালিবুল ইলমরা কোরআন শিক্ষা করছে তেমনি আমাদেরও কোরআন শিখতে হবে। তালিবুল ইলমের খাতায় আমরাও নাম লিখাব, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত-ই ইলম শিখার সুযোগ আছে। আমরা যদি সুযোগকে কাজে লাগাই তবেই হতে পারবো সফলকাম। কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি মাসআলা মাসায়েল শিখতে হবে। এটাও ফরয। মাসআলা মাসায়েল না শিখলে তো সহীহ শুদ্ধভাবে নামায ও আদায় করতে পারব না।
কোরআন কারীম দুনিয়াতে সবচাইতে দামী ও সম্মানী বস্তু। কোরআনের সঙ্গে যেকোনো উপায়ে সম্পৃক্ত হতে পারলে আমাদের মান-মর্যাদা ও সম্মান হবে সবার উর্দ্ধে। উদাহরনত: কোরআন শরীফ মহা-মূল্যবান গ্রন্থ। এ গ্রন্থ পবিত্রতা বিহীন স্পর্শ করা যায় না। কোরআন শরীফের উপরের যে মালাট রয়েছে এটা মূল কোরআনের অংশ না হলেও কোরআনের সঙ্গে যুক্ত বলে এটাও অযু ছাড়া স্পর্শ করা যাবে না। যে চামড়া আমরা জুতায় ব্যবহার করি, পায়ে পরিধান করি সে চামড়া দিয়ে যদি কোরআন শরীফের মলাট বানানো হয় তাহলে তাও অযু ছাড়া স্পর্শ করা যাবে না। দুনিয়াবী জিনিসের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, অনেক মূল্যহীন বস্তুও মূল্যবান বস্তুর সংস্পর্শে এসে দামী হয়ে যায়। যেমন, ধুলাবালু। আমরা বাজার থেকে আঙ্গুর কিনে আনি। আঙ্গুরে ধুলাবালু লেগে থাকে। তাইতো আমরা আঙ্গুর ধুয়ে খাই। আঙ্গুর যখন মাপা হচ্ছে তখন ধুলাবালুসহ মাপা হচ্ছে। এ মূল্যহীন ধুলাবালু মূল্যবান আঙ্গুরের সংস্পর্শে থাকার কারনে আমরা সযতনে ঘরে নিয়ে আসছি। তো যারা আল্লাহর কালাম শিক্ষা করছে এবং যাঁরা শিক্ষা দিচ্ছেন তাঁরা আঙ্গুরের মতো। আর আমরা সাধারন মুসলমানরা ধুলাবালুর মতো। অতএব, আমরা যদি কোরআন শরীফ, ওলামায়ে কেরাম ও হাফেয সাহেবগনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি তাহলে আল্লাহ তাআলা আমাদেরও সম্মানিত ও মর্যাদাবান করবেন। একজন কৃতজ্ঞ অনুগত বান্দার কাছে এর মূল্য সবকিছুর উর্দ্ধে। আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে যার সম্পর্ক যত গভীর কোরআন মাজীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক তত নিবীড়। হাদীস শরীফে হুযুর আকরাম (সা:) ইরশাদ করেছেন- “তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই সর্বোত্তম যিনি কুরআন শিক্ষা দেন এবং শিক্ষা করেন।” বস্তুত দুনিয়া ও আখেরাতের এমন কোন কল্যান ও ফজীলত নেই যা কুরআন মাজীদের তেলাওয়াতে নিহিত নয়। কেনইবা এমন হবে না এই কুরআন তো আল্লাহ তায়ালার কালাম। তাই এর ফজীলত অপরিসীম। হযরত আবু উমামা বাহেলী (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা:) কে বলতে শুনেছি, তোমরা কুরআন পড় কেননা, কেয়ামতের দিন কুরআন তার সঙ্গীদের জন্য সুপারিশ কারী হিসেবে হাজীর হবে। মুসলিম।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা:) থেকে বর্ণিত নবী করীম (সা:) ইরশাদ করেন, দু ব্যক্তি ছাড়া কারো ব্যাপারে হিংসা করা যায় না অর্থাৎ দু ব্যক্তি ছাড়া কারো ব্যাপারে ঈর্ষা করা প্রশংসনীয় নয়। সে ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তায়ালা কুরআন দান করেছেন সে রাত-দি তাতে মগ্ন থাকে। আরেকজন হল যাকে আল্লাহ তায়ালা সম্পদ দিয়েছেন, সে রাত দিন (আল্লাহর রাস্তায়) এ সম্পদ ব্যয় করে। (বুখারী ও মুসলিম) হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, যার ভিতরে কুরআনের কোন অংশ নেই নিশ্চয় সে একটি বিরান ঘরের মত। (তিরমিযী)
হযরত মুআয বিন আনাস (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন, যে কুরআন পড়ে এবং সে অনুযায়ী আমল করে, আল্লাহ তাআলা তার মা-বাবাকে কেয়ামতের দিন একটি মুকুট পড়াবেন। সূর্যের আলো যেমন সুন্দর সে মুকুটের আলো তার চেয়েও সুন্দর হবে। অতএব, যে কুরআন অনুযায়ী আমল করেছে তার ব্যাপারে তোমাদের কী ধারনা? আবু দাউদ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে বর্নিত, নবী (সা:) ইরশাদ করেন, তোমরা কুরআন পড়। কারন, যে অন্তর কুরআন হেফজ করেছে আল্লাহ তাআলা তাকে আযাব দিবেন না। নিশ্চয়ই এই কুরআন আল্লাহ তাআলার দস্তরখান যে কুরআনকে ভালবেসেছে সে যেন সুসংবাদ গ্রহন করে। (মুসনাদে দারেমী) হযরত ইবনে উমর (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন, নিশ্চয় মানুষের অন্তরে জং ধরে যেমন লোহায় পানি লাগলে জং ধরে। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল, এই জং দূর করার উপায় কী? এরশাদ করলেন, মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরন করা এবং কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা। (বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান।)

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button