বিজয়ের মাস ডিসেম্বর

Bijoyসাদেকুর রহমান: কথিত নব্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী কর্তৃক রাখাইনের লাখ লাখ রোহিঙ্গার পালিয়ে আসার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখে পড়েছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে লাল-সবুজের দেশটির দিকে দিকে ঔদ্ধত্য শকুনেরা  শ্যেনদৃষ্টি নিয়ে ওড়াওড়ি অব্যাহত রয়েছে। প্রিয় বাংলাদেশের মানচিত্র নাকি খুবলে খেতে চায় ওরা! স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব থাকা-না থাকা নিয়েও দেখা দিচ্ছে উদ্বেগমিশ্রিত প্রশ্ন। ঠিক এমন সময়ে পঞ্জিকার ধারাবাহিকতায় আবার এলো মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়ের মাস, বেদনাবিধুর শোকগাঁথার মাস। ত্রিশ লাখ শহীদ আর দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার সাক্ষর মাস ডিসেম্বর গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটেই তো শুরু হয়েছে। এবার এমন এক সময় বিজয়ের মাস এলো, ইউনেস্কোর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকে বিশ্ব সম্পদ হিসেবে স্বীকৃতির আনন্দে যখন গোটা জাতি উদ্বেলিত।
প্রতিবারই ডিসেম্বর আসে দুর্নিবার আকাক্সক্ষার বারতা নিয়ে। হেমন্তের নবান্ন আমোদন আর কুয়াশার চাদর জড়ানো এ মাসের সাথে জাতীয় জীবনের সম্পর্ক রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আবেগের। আমাদের মানচিত্র, লাল-সবুজ পতাকা, নিজস্ব সত্তা-পরিচয় ও বিকাশের বীজ এ মাসেই পূর্ণরূপে অঙ্কুরিত হয়েছিল। তাইতো যখনই ডিসেম্বর আসে তখন দেশপ্রেম ও দ্রোহের ফল্গুধারায় প্লাবিত হয় গোটা দেশ, এমনকি প্রবাসী বাংলাদেশীর প্রতিটি হৃদয়। না বললেও এতক্ষণে সবাই জেনে গেছে, আজ শুক্রবার পহেলা ডিসেম্বর। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অব্যাহত শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির বছর, একাত্তরের এ দিন ছিল বুধবার। এবারও বিজয়ের মাস উদযাপনে বিভিন্ন সংগঠন বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
বিশ্লেষকদের বিবেচনায় বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম ঘটনা হলো ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের এক ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক রাজনৈতিক স্বপ্ন সাধ পূরণ হয় এ মাসে। মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় গৌরবদীপ্ত চূড়ান্ত বিজয় এ মাসের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয়। ভাষার ভিত্তিতে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ঘোষিত স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় এ দিনে। এ মাসেই স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এ দেশের মেধা, শ্রেষ্ঠ সন্তান-বুদ্ধিজীবী হত্যার নৃশংস হত্যাকান্ডে মেতে ওঠে। সমগ্র জাতিকে মেধাহীন করে দেয়ার এধরনের ঘৃণ্য হত্যাকান্ডের দ্বিতীয় কোন নজীর বিশ্বে নেই।
এই ডিসেম্বরেই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল- শিথানে তার হিমালয় পর্বত আর পদপ্রান্তে নীল পানিরাশির বিশাল বঙ্গোপসাগর। টানা নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও অসংখ্য শহীদের তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় এ দেশের স্বাধীনতা। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের একটি প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পর্যায়ক্রমিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের অত্যাচর, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলনের চরম পর্যায়ে স্বাধীতার আওয়াজ ওঠে। দাবি আদায়ের আন্দোলনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজপথে নেমে আসে। বিজয়ের জন্য লড়াকু জনতা শরীরের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থে এ সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, “মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণে পাক সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্রমশ হতাশা দেখা দিতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা অপারেশনের ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়তে থাকে। পাকবাহিনী দিনের বেলা ছাড়া পারতপক্ষে বেরই হতো না। রাতের বেলা সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দুর্বার মুক্তিসেনাদের দখলে থাকতো বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ নরনারী অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে গর্বের সঙ্গে গেরিলাদের সাহায্য করতেন। অপরপক্ষে হানাদার বাহিনী সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিন্দুমাত্র সাহায্যও পায়নি। ভয় দেখিয়ে দাম না দিয়ে খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহ করলেও তারা জনগণের চূড়ান্ত অসহযোগিতা এবং প্রবল ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই লাভ করেনি।”
ভাষাতত্ত্বের বিচারে ‘জয় বাংলা’ ও ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে আমরা কোনো পার্থক্য দেখতে পাই না। ‘জিন্দাবাদ’ আর ‘জয়’ দুইটি শব্দই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর দুটো ভাষা থেকে আমরা ব্যবহার করছি। ‘জিন্দাবাদ’ হচ্ছে ফার্সি আর ‘জয়’ হলো হিন্দি। এ দুইটি ভাষার মূল ভাষা হচ্ছে এক ও অভিন্ন। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, সে মূল ভাষা বর্তমান রাশিয়ার ভলগা অববাহিকা ও কাস্পিয়ান সাগর উপকূলের প্রাচীন অধিবাসীদের ভাষা। অথচ এ নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সময় এ অঞ্চলের পক্ষ থেকে যৌক্তিক দাবি পেশ করলেও পাকিস্তান সরকার এটাকে ‘প্রাদেশিকতাবাদ’ বলে তাচ্ছিল্য করতো। আর আজ স্বাধীনতা লাভের পর ‘সা¤্রাজ্যবাদ’, ‘আধিপত্যবাদ’, ‘চাণক্যবাদ’, ‘সম্প্রসারণবাদ’ ইত্যাদি এদেশকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে রেখেছে।
১৯৭০ সাল পর্যন্ত আমাদের জাতীয় জীবনবোধে ইংরেজি বছরের শেষ মাসটির তেমন আবেদন ছিল না। পরের বছর ১৯৭১ সাল থেকেই এর সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যায় বাংলাদেশের নামটি। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ রাষ্ট্রের নিজস্ব ভূখন্ড, নিজস্ব মানচিত্র, নিজস্ব প্রশাসন, স্বশাসিত রাষ্ট্রযন্ত্র সবকিছুই যেন ডিসেম্বরের বদৌলতে। হয়তো ডিসেম্বর না হলে আমাদের স্বপ্ন কেবলই ফানুস হয়ে উড়তো। তাই তো এ মাস এলেই দেশপ্রেমিক জনতাসহ জাতীয় জীবনের সর্বত্র লাগে উদ্দীপিত আবেগের ঢেউ। এ দিনের সূর্যটাও অন্য দশটা দিনের চেয়ে একটু ভিন্ন আবেশ মাখা। নবজাগৃতির আলোকমালা। দীর্ঘ ছেচল্লিশ বছরের ব্যবধানেও স্বকীয়  বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল, চরম আকাঙক্ষা ও পরম প্রাপ্তির প্রতীক মাসটি।
সমকালীন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলে থাকেন, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে মুক্ত করার উদ্যোগ-আয়োজন ছিল না। আলোচনার নামে কালক্ষেপণের এক পর্যায়ে একাত্তরের ‘কালরাত’ পঁচিশে মার্চে নিরীহ জনগোষ্ঠীর ওপর হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। একাধারে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিধন শুরু হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হন। তৎকালীন পরিস্থিতিকে নানা ভাবে বিশ্লেষণ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানের (পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট) স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা পেয়ে দিকভ্রান্ত জাতি মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। এভাবেই পরাজিত পাকবাহিনীর রাহু থেকে বাংলাদেশ পৃথক দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয়।
মুক্তিযুদ্ধের সফল সংঘটনকে কেন্দ্র করে এদেশে দুর্ভাগ্যজনকভাবে জটিল ও কূটিল রাজনীতি চলে আসছে, এ চলার শেষ কোথায় কেউ জানে না। ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে নিজেদের কৃতিত্ব দাবি করা হয়ে থাকে। বাস্তবতা হলো, আদর্শিক কারণে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া বাকি সবাই মনে-প্রাণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছেন এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লড়াই করেছেন।
পাকিস্তান সরকারের আমলা ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম তার ‘বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থেও প্রায় একই কথা বলেছেন, “জনযুদ্ধ বলতে আমরা যা বুঝি সেই সংজ্ঞাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সত্যিকার অর্থেই একটি অনন্য জনযুদ্ধ ছিল। সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণ এবং অসীম ত্যাগ স্বীকারই তো জনযুদ্ধের প্রধান উপাদান। আমাদের সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর জন্ম জনগণের মধ্যে, লালনও জনতার আশ্রয়ে। মুক্তিযুদ্ধে এতো ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাসে খুব কমই হয়েছে। ভিয়েতনামে আমরা সেটি দেখেছি। হাতে-গোনা কয়েকজন দক্ষিণ ভিয়েতনামী সেনা অফিসার ও পুতুল রাজনীতিবিদ ছাড়া কেউই দক্ষিণ ভিয়েতনামী সরকার তথা আমেরিকানদের সমর্থন করেনি।”
ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণ আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর জল,স্থল আর আকাশপথে সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর চারদিক থেকে ভেসে আসতে থাকে। এ বছরের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। পরাজয়ের দলিলে স্বাক্ষর করেন পাক জেনারেল নিয়াজী। এ সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত থাকলেও ছিলেন না বা থাকতে পারেননি বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর ওসমানীর মতো ব্যক্তিরা।
এদিকে, মহান এ বিজয়ের মাস উদযাপনে জাতীয় কর্মসূচির পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। বিজয়ের মাসের প্রথম দিনেই বিভিন্ন সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করবে। এসব কর্মসূচির মধ্যে আছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, বিজয়ের মাসকে স্বাগত জানিয়ে সমাবেশ, মানববন্ধন, বিজয় র‌্যালি ইত্যাদি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button