ইসরাইলের বিরুদ্ধে এক ইহুদি নারীর লড়াই

israelসম্প্রতি তেলআবিবে ইসরাইলি বার অ্যাসোসিয়েশন একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। এই সম্মেলনে হাজির ছিলেন ইসরাইলের জাস্টিস মিনিস্টার আইয়েলেট শেকেড । তিনি এই সম্মেলনে তার বক্তব্যে বলেছেন, জায়োনিজমের সাথে শুধু মানবাধিকারেরই বৈপরীত্য রয়েছে তা নয়, এটি সার্বজনীন ন্যায়বিচারেরও পরিপন্থী। ইসরাইলের সুপরিচিত দৈনিক হারেৎজ-এর সাংবাদিক জিডিওন লেভি তাকে অভিহিত করেছেন ‘ইসরাইল’স মিনিস্টার অব ট্রুথ’ অভিধায়। আইয়েলেট শেকেড মনে করেন, ডানপন্থী ইহুদিবাদী আদর্শ তথা জায়োনিস্ট আইডিওলজি মানবাধিকারের বিষয়টি অস্বীকার করে।
উল্লেখ্য, ইহুদি সম্পর্কিত দুইটি প্রচলিত শব্দবাচ্য রয়েছে। একটি জায়োনিজম এবং অপরটি জুডায়িজম। জায়োনিজম হচ্ছে- মূলত ইহুদিদের স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। আধুনিক কালে এটি ইসরাইলকে ইহুদিধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্দোলন। এটি উগ্র ইহুদিদের একটি আন্দোলন হিসেবেই বিবেচিত। অপর দিকে, জুডায়িজম হচ্ছে- ইহুদি ধর্ম ও ধর্মীয় সংস্কৃতি সম্পর্কিত মতবাদ। এই জুডায়িজম সম্পর্কে কারো কোনো আপত্তি নেই। ইহুদিরা জুডায়িজম অনুসরণ করে চলবে, এটি তাদের ধর্মীয় অধিকার হিসেবে সব মহলে স্বীকৃত। কিন্তু বিবেকবান ইহুদি ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষের আপত্তি আছে ইহুদিদের উগ্রপন্থার জায়োনবাদ বা জায়োনিজম সম্পর্কে। কারণ এটি অ-ইহুদিদের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার খর্ব করে। ঠিক একইভাবে হিন্দুদের ধর্মীয় মতবাদ ‘হিন্দুইজম’ সম্পর্কে কারো কোনো আপত্তি নেই বা থাকার কথা নয়। কিন্তু যত আপত্তি উগ্রবাদী ‘হিন্দুত্ববাদ’ নিয়ে, যার সারকথা হচ্ছে ভারতকে একান্তভাবেই একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। বিবেকবান হিন্দুরাও এর বিরোধী।
যা-ই হোক আইয়েলেট শেকেড হচ্ছেন একজন ইসরাইলি রাজনীতিক ও কম্পিউটার প্রকৌশলী। ২০১৩ সাল থেকে তিনি ইসরাইলি পার্লামেন্ট তথা নেসেটের মেম্বার এবং ২০১৫ সাল থেকে ইসরাইলের জাস্টিস মিনিস্টার। তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন ‘দ্য জিউইশ হোম’ নামে ইসরাইলের একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের। তবু তিনি সুপরিচিত একজন সেকুলার রাজনীতিবিদ হিসেবে। তিনি তার দলের একমাত্র সেকুলার মহিলা। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন তেলআবিব হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিতে, টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টের একজন প্রকৌশলী হিসেবে। ২০১০ সালে তিনি রাজনীতিবিদ নাফতালি বেনেটের সাথে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মাই ইসরাইল’ নামে এক্সট্রা-পার্লামেন্টারি মুভমেন্ট। ২০১২ সালের মে মাস পর্যন্ত তিনি এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তাকে বিবেচনা করা হয় ইসরাইলের সবচেয়ে বেশি সক্রিয় একজন বিধায়ক হিসেবে। তিনি উদ্যোগী হয়ে খসড়া তৈরি করেন ইসরাইলের অনেক আইনের। এর মধ্যে আছে ইসরাইলের এনজিও ট্রান্সপারেন্সি ল’ এবং দেশটির ব্যাপকধর্মী সন্ত্রাসবিরোধী আইনের খসড়া।
আইয়েলেট শেকেড ও তার সমগোত্রীয়রা বরাবর ইসরাইলের হাইকোর্ট অব জাস্টিসের কট্টর সমালোচক। তিনি তার বক্তব্যে আদালতের সমালোচনা করেন ইহুদিবাদ ও দেশের সংখ্যাগুরু ইহুদিদের সম্পর্কে অপর্যাপ্ত মনোযোগ দেয়ার ব্যাপারে। জায়োনিজম ও ইসরাইলকে যেসব চালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে, সেগুলোকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। তার মতে, ডেমোগ্রাফি ও জিউইশ মেজোরিটিকে আরো বিবেচনায় নেয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘জায়োনিজমকে আর চলতে দেয়া উচিত নয়। আর এখানে আমি বলছি, এটি সার্বজনীনভাবে বিবৃত ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অব্যাহতভাবে অবদমন করে চলবে।’ তিনি আরো বলেন, নেতানিয়াহু সরকার ঠেলে দিচ্ছে বিতর্কিত ‘ন্যাশন-স্টেট বিল’। এটি নির্ধারণ করবেÑ ইসরাইল হচ্ছে, ‘ন্যাশনাল হোম অব ইসরাইলি জিউইশ পিপল’ এবং ইহুদিরাই রাষ্ট্রে ভোগ করবে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার। শেকেড মনে করেন, জাতীয় ও ইহুদিবাদী মূল্যবোধই যেন হচ্ছে একটি ‘পরম সত্য’ তথা অ্যাবসলিউট ট্রুথ।
ইহুদিবাদের সমালোচকেরা বরাবর বলে আসছেন, ইসরাইল দেশটি গণতান্ত্রিক নয়। কারণ এটি বৈষম্য করে অ-ইহুদি বসবাসকারীদের প্রতি। কারণ, এরা ইহুদি নয়। ইসরাইলি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধরে নেয়, ইসরাইল হচ্ছে একটি ‘জিউইশ ও ডেমোক্র্যাটিক’ রাষ্ট্র (যেখানে সরকার নির্বাচন করে, তবে সিভিল রাইটের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে)। ইসরাইলি পার্লামেন্ট নেসেটের সাবেক স্পিকার আভরাম বুর্গ এটিকে অভিহিত করেছেন একটি ড়ীুসড়ৎড়হ নামে, যা স্ববিরোধী। শুরু থেকেই জিওডো-ডেমোক্র্যাটিক ইসরাইলকে অ্যান্টি-জায়োনিস্ট, অ্যান্টি-সেমাইটস কিংবা ‘সেলফ-হেটিং জিউ’ মোকাবেলা করে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। সমালোচক ও বেন গুরিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওরেন ইফতাচেল ইসরাইলকে অভিহিত করেছেন একটি ‘এথনোক্র্যাসি’ নামে।
আইয়েলেট শেকেড এখন নাফতালি বেনেটের জাতীয়তাবাদী জেউইশ হোম পার্টির একজন। এই দল ডানপন্থী সেটেলার মুভমেন্টের সাথে মিলে জায়োনিজম হাইজ্যাক করেছে এবং এটিকে রূপান্তর করেছে একটি ন্যাশনালিস্টিক, রেসিস্ট ও ফেসিস্ট ধরনের আইডিওলজিতে। ইসরাইলের দীর্ঘ দিনের ইন্টেরিওর মিনিস্টার জুসেফ বুর্গের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল রিলিজিয়াস পার্টি ছিল একটি উদার সংরক্ষণবাদী দল।
ডানপন্থী ইসরাইলিরা একটি ধ্বংসাত্মক ধারণা পোষণ করে। এরা মনে করে গোটা পৃথিবী তাদের বিরুদ্ধে, আর পরের হলোকাস্ট অতি নিকটে। এদের মতে, এর সবচেয়ে নতুন উদাহরণ হচ্ছে, ইসরাইলবিরোধী বিডিএস (বয়কট, ডিভেস্টমেন্ট স্যাঙ্কশনস) মুভমেন্ট। জায়োনিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ও ওয়ার্ল্ড জিউরি (World Jewry) মনে করে, এই মুভমেন্ট একটি অপরিহার্য অস্তিত্বগত হুমকি, যার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে তাদের লড়তে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ও জার্মানির মতো অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে ইহুদিবাদী ইসরাইলি লবি ও তাদের ফিলোসেমেটিক সহযোগীরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে উত্তেজিত।
এ প্রেক্ষাপটে ধন্যবাদ জানাতেই হয় আইয়েলেট শেকেডকে। কারণ, তিনি উন্মোচন করেছেন ইহুদিবাদের সত্যিকারের চেহারা। ইসরাইলের অনেক ইহুদিবাদী দলের কাছে তা জানা থাকলেও মুখ খুলতে নারাজ। এরা অন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে চায় ন্যায় হিসেবে। এরা চায় বর্ণবাদের প্রতিষ্ঠা, ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠা। এরা চালাতে চায় দশকের পর দশক ধরে বর্ণবাদী প্রথা। ফিলিস্তিনে বজায় রাখতে চায় দখলদারিত্ব। এটি দুঃখজনক, পাশ্চাত্য এখনো সমর্থন করে যাচ্ছে এই ভণ্ডামিকেই।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button