সিরাজুর রহমান : এক জীবন এক ইতিহাস

Sirajur Rahmanআলফাজ আনাম: বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বিদায় নিলেন। সংবাদপত্র ও রেডিও উভয় গণমাধ্যমে যিনি অর্জন করেছিলেন সমান জনপ্রিয়তা। তিনি খ্যাতিমান সাংবাদিক সিরাজুর রহমান। তিন দশকেরও বেশি সময়ের বিবিসি বাংলার সাথে যার নাম উচ্চারিত হতো। ৩৪ বছর বিবিসিতে কাজ করেছেন। সাংবাদিকতার সূত্রে ছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায়ের সাক্ষী। যার জীবন হয়ে উঠেছিল ইতিহাসের অংশ। সিরাজুর রহমান যে আত্মজীবনী লিখেছেন তার নাম ‘এক জীবন এক ইতিহাস’। এ লেখার শিরোনাম সেখান থেকে নেয়া।
নয়া দিগন্তে কলাম লেখার সূত্রে সিরাজুর রহমানের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হতো। প্রতি রোববার বা সোমবার তিনি নিজেই ফোন করে জানাতেন কী বিষয়ে লিখতে চাইছেন। জানতে চাইতেন এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান কী? কখনো কখনো আমার মতামত চাইতেন। বিস্মিত হতাম, আমার মতো নবিস এক সাংবাদিকের মতামত মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। সিরাজুর রহমানের বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনে আমরা ছাত্র। বলতাম সিরাজ ভাই আপনি স্বাধীনভাবে লিখবেন। যদি কখনো টেলিফোনে না পেতেন শফিক ভাইকে (শফিক রেহমান) ফোন করে বলতেন আলফাজকে (এই লেখককে) জানাবেন এই বিষয়ে লিখছি।
নয়া দিগন্তের শুরু থেকে সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করার কারণে অনেক লেখক ও কলামিস্টের সাথে আমাকে যোগাযোগ করতে হতো। হাজার মাইল দূরে থেকে যার লেখাটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা পেতাম তিনি সিরাজুর রহমান। বুধবার বিকেল ৪টার মধ্যে তার লেখা মেইলে চলে আসত। শুক্রবার ছাপা হতো তার কলাম। শফিক ভাই কথা প্রসঙ্গে একদিন জানালেন সিরাজ ভাই এতটাই সময় মেনে চলতেন যদি ৬টায় তাকে কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হতো, তিনি ৫টা ৫০ মিনিটে বাসার গেটে এসে হাজির হতেন। ঠিক ৬টায় কলিং বেল টিপতেন। লেখার ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যাত্যয় হতো না। বর্তমানে সংবাদপত্রে যে সেলফ সেন্সরশিপ চলছে তাতে সিরাজুর রহমানের লেখাও বাদ যেত না। তার পাঠানো লেখার অনেক কিছু আমরা ছাপতে পারিনি। কিন্তু এ নিয়ে কখনো অনুযোগ করেননি। বলতেন পত্রিকাটি আগে টিকিয়ে রাখতে হবে।
সিরাজুর রহমান সাংবাদিকতা শুরু করেছিলেন একেবারে কৈশোরে। মেট্রিক পরীক্ষার আগে। ১৯৪৬-এ দাঙ্গার সময় তিনি আজাদে কাজ শুরু করেন সে সময়ের স্বনামধন্য বার্তা সম্পাদক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের তত্ত্বাবধানে। সেই থেকে সাংবাদিকতার জগৎ ছেড়ে যাননি। পরিবর্তন হয়েছে শুধু মাধ্যমের।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কলকাতা ছেড়ে পরিবারের সাথে চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ভাষা আন্দোলনে যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়, তিনি ছিলেন ঢাকা কলেজের সমন্বয়কারী। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৯ অর্ধসাপ্তাহিক পাকিস্তানে কাজ শুরু করেন। এ সময় খণ্ডকালীনভাবে ইত্তেফাকে সম্পাদকীয় লিখতেন। তিনি কাজ করেছেন ইনসাফ ও মিল্লাতে। বার্তা সম্পাদক হিসেবে মিল্লাতে কাজ করেছেন। এরপর যোগ দেন ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে।
সাংবাদিকদের অনেকের কাছে অজানা যে পূর্ব পাকিস্তানে সাংবাদিক ইউনিয়ন গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন সিরাজুর রহমান। ১৯৫০ সালে জহুর হোসেন চৌধুরী, সৈয়দ নুরুদ্দিন, তাসাদ্দুক আহমেদ আর সিরাজুর রহমান মিলে পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন (ইইপইউজে) গঠন করেন। ১৯৫২ সালে কয়েক মাস এই ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ছিলেন সিরাজুর রহমান।
সিরাজুর রহমান বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৬০ সালে। অবসর নেন ১৯৯৪ সালে। ৩৪ বছর তিনি বিবিসিতে কাজ করেছেন। ’৬০-এর দশক থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে থাকে। তিনি বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি অনেকবার মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।
বলা যায়, বিশ্ব গণমাধ্যমের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি পরিচিত করেছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চে বর্বরোচিত সামরিক অভিযানের পর বিলেতে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি নিজেই লিখেছেন ‘আমার মুক্তিযুদ্ধ তখন পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানি উচ্চ শিক্ষার্থীদের অনেকে বিবিসি বাংলা বিভাগে খণ্ডকালীন কাজ করতেন। তাদের কয়েকজনকে নিয়ে বিশ্ব মিডিয়াকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত পরিস্থিতি জানাতে শুরু করি। মূলত আমার অনুরোধ আর উপরোধে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী একাত্তরের ১০ এপ্রিল আমাদের আন্দোলনে যোগ দেন এবং তারপর কলকাতায় নির্বাসিত সরকার তাকে বিদেশে প্রধান প্রতিনিধি নিয়োগ করে।’ প্রকৃতপক্ষে বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে তিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি কূটনীতিকদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন।
তার স্ত্রী সোফিয়া রহমানও সক্রিয় ছিলেন। প্রবাসীদের আন্দোলনে মহিলারা যাতে সম্পৃক্ত হন, সে লক্ষ্যে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ মহিলা সমিতি গঠন করা হয়েছিল। জেবুন্নেসা বখশকে চেয়ারপারসন ও সোফিয়া রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে এই মহিলা সমিতি গঠন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তির পর প্রথমে লন্ডন গিয়েছিলেন। লন্ডনে তার পাশে ছিলেন সিরাজুর রহমান। অনেক ঘটনা দেখেছেন কাছে থেকে। লিখে গেছেন সেসব বিবরণ।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে একদলীয় শাসন কায়েম, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন সিরাজুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে সেসব প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। তিনি রুষ্ট হয়েছিলেন। এসব ঘটনার বিবরণ তিনি নিজেই লিখে গেছেন। তিনি লিখেছেন দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর সর্বপ্রথম আমি বিবিসি থেকে প্রচার করি। সেদিন মনে মনে স্থির করেছিলাম, আমার কাজ শেষ হয়েছে। নেতারা দেশ চালাবেন। বাংলাদেশের মানুষকে তারা এবং আমরা প্রচারবিদেরা উন্নত জীবন, সুশাসন ও উদার সংসদীয় গণতন্ত্র দেয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, নেতারা সেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন। দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের মানুষের জন্য আমার আন্তরিক ইচ্ছা ও শুভকামনা সফল হয়নি। আমি মনে রাখলেও নেতারা তাদের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়েছিলেন। স্বৈরতন্ত্রী প্রবণতা স্বাধীন জাতীয় জীবনের গোড়া থেকেই লক্ষ করা গিয়েছিল। রাজনৈতিক বিরোধিতা নির্মূল করতে একটি ব্যক্তিগত বাহিনী ৪০ হাজার মানুষ খুন করেছে, অর্থনীতির সর্বনাশ আর দুর্ভিক্ষে ৭০ হাজার মানুষ মারা গেছে। তার ওপর গদি চিরস্থায়ী করার চক্রান্তে গণতন্ত্রকে তালাক দিয়ে স্বৈরতন্ত্র চালু করা হয়।
বিবিসি থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি কলাম লেখায় মনোযোগ দিয়েছিলেন।
নয়া দিগন্তে লেখা শুরু করেন ২০০৭ সালের মাঝামাঝি থেকে। এরপর তিনি প্রতি সপ্তাহে লিখেছেন। অসুস্থতার কারণে কোনো সপ্তাহে লিখতে না পারলে পাঠকেরা আমাদের টেলিফোনের পর টেলিফোন করে জানতে চাইতেন সিরাজুর রহমানের লেখা ছাপা হচ্ছে না কেন? তিনি নিজেও ই-মেইলে অনেক প্রতিক্রিয়া পেতেন। তিনি নিজেই বলতেন, লেখার সময় পাঠকের প্রতিক্রিয়ার দিকেও খেয়াল রাখতে হয়।
পত্রিকায় কলাম লেখা ছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি অনেক বই লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রীতি নিন সকলে, লন্ডনের চিঠি, ইতিহাস কথা কয় ও নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ, ইরাকের বিরুদ্ধে অন্যায় যুদ্ধ, বাংলাদেশ : স্বাধীনতার পনের বছর, রাজনৈতিক প্রবন্ধ, এক জীবন এক ইতিহাস। বেশ কয়েকটি বই অনুবাদ করেছেন মার্ক টোয়েনের টম সয়্যার, ন্যাথালিয়েন হ থর্নের দ্য স্কার্লেট লেটার। নাট্যানুবাদ করেছেন জেন অস্টিনের প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস, আন্তন চেকভের নাটক, চার্লস ডিকেন্সের গ্রেট এক্সপেক্টেশন্স, শার্লোট ব্রুন্টির জেন এয়ার ইত্যাদি। সিরাজুর রহমানের বেশ কয়েকটি বই কলকতা থেকেও প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সম্পাদক দায়ী নহেন, বিজ্ঞানের নতুন দিগন্ত, আন্তন চেকভের ভালুক, অসকার ওয়াইল্ডের দ্য ইম্পর্টেন্স অব বিয়িং আর্নেস্ট।
মৃত্যুর ১২ দিন আগে তার সাথে শেষ টেলিফোনে কথা হয়। টেলিফোনে তাকে ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। জানালেন লেখা শুরু করেছেন। কিছুটা লেখার পর হঠাৎ করে অক্সিজেনের নল নাকি খুলে গিয়েছিল। উল্লেখ্য, তার পাশে সব সময় অক্সিজেনের বোতল রাখতে হতো। শারীরিক সমস্যার কারণে লেখাটি শেষ করতে পারেননি। সবার কাছে দোয়া চেয়ে বললেন, লেখা শেষ করে পাঠিয়ে দেবো। সিরাজুর রহমানের সেই লেখাটি আর শেষ করা হলো না। এর মধ্যে তিনি চলে গেলেন। আমরা হারালাম ইতিহাসের একজন সাক্ষীকে। হারালাম বাংলাদেশে সাংবাদিকতার একজন মহান শিক্ষককে, যিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য শেষ দিনও কলম চালু রেখেছিলেন।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এই কিংবদন্তি সাংবাদিকের ইন্তেকালের খবর তেমন একটি গুরুত্ব পায়নি। কারণ বোঝা খুব কঠিন নয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন এবং লন্ডনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদেশীদের সমর্থনের জন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, কিন্তু তিনি কখনো চেতনা ব্যবসায়ের সাথে নিজেকে যেমন সম্পৃক্ত করেননি, তেমনি চেতনা-ব্যবসায়ীদের তৈলাক্ত অগণতান্ত্রিক মনোভাবের সমালোচনা করেছেন। তিনি জীবনের শেষ লেখাটিতেও একজন সাংবাদিকের সত্যকে সত্য বলার যে নৈতিক শক্তি তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। গণতন্ত্র নির্বাসনে পাঠিয়ে বাংলাদেশে এখন যে একদলীয় শাসনের প্রক্রিয়া চলছে, তাতে তিনি হতাশ ছিলেন। তার লেখায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যে আকুতি থাকত, আলাপচারিতায় একই কথা বলতেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button