প্রতিদিন ২০ হাজার মেট্রিক টন বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্য নদীতে পড়ছে

দখল আর দূষণের কবলে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে শীতলক্ষ্যা

Shitolokkaকামাল উদ্দিন সুমন: দখল আর দূষণের কবলে পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদী। একদিকে শিল্প কারখানার বর্জ্য অন্যদিকে দখলের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে নদীটি। বৃটিশ শাসনামলে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি ডিস্টিল ওয়াটার হিসেবে ব্যবহার ও বিদেশে রফতানি হতো। সে সময় শীতলক্ষ্যা নদীর পানি ‘মেডবাই শীতলক্ষ্যা’ বোতলের মোড়কে দেশে বিদেশে বাজারজাত হতো। আজ শীতলক্ষ্যা নদীর পানি থেকে ভেসে আসে দুর্গন্ধ। এছাড়া অনেক আগেই শীতলক্ষ্যা নদী মাছবিহীন হয়ে গেছে।
সূত্র জানায়, শীতলক্ষ্যা নদী দূষিত হয়ে মৃত প্রায়। সরকারি ও বেসরকারি কোন উদ্যোগই কাজে আসে না এ নদী রক্ষায়। ফলে ঘটছে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়। বিভিন্ন কল কারখানা, সুয়ারেজ লাইন, ডাইং ফ্যাক্টরী, সার কারখানাসহ বিভিন্ন প্রকারের বর্জ্য সরাসরি নদীতে নিক্ষেপের ফলে মরতে বসেছে নদীটি।
সূত্র জানায়, প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্য পড়ছে নদীতে। এর ৬০ ভাগই নানা শিল্প কারখানার, ৩০ ভাগ সুয়ারেজের এবং বাকি ১০ ভাগ বর্জ্য অন্যান্য উৎসে মাধ্যমে নদীতে এসে পড়ছে। এছাড়া শীতলক্ষ্যার তীরে গড়ে ওঠা সিমেন্টে কারখানার বর্জ্য ও ক্লিংকারসহ নানা  কেমিক্যাল নদীতে পড়ে ও বাতাসের সঙ্গে মিশে মানুষের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে নানা রোগের সৃষ্টি হচ্ছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জ বন্দরে নদীর দুই তীরসহ এর আশপাশের এলাকাগুলোতে ছোট বড় মিলে কয়েক হাজার শিল্প কারখানা রয়েছে। এসব শিল্প কারখানায় ৯৯ ভাগেরই তরল বর্জ্যরে পানি শোধনাগার নেই। সরকার ইটিপি প্লান্ট বাধ্যতামূলক করার পরও খরচ বাঁচাতে শিল্প মালিকরা ইপিটি ব্যবহার বন্ধ রেখে শতভাগ বর্জ্যই সরাসরি নদীতে নিক্ষেপ করা হচ্ছে।
শীতলক্ষ্যার পানি পরীক্ষা রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই পানিতে ক্রোমিয়াম, নাইট্রেট, সিসা ও উচ্চ মাত্রায় পারদসহ ৬৮ প্রকার অপরিশোধিত রাসায়নিক পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। প্রতি লিটার পানিতে প্রায় দশমিক ৪৮ মিলিগ্রাম ক্রোমিয়াম রয়েছে। তবে পানিতে ক্রোমিয়ামের মাত্রা দশমিক ৫০ মিলিগ্রাম মিশ্রণ পানি পান করলেই মানুষ মারা যাবার সম্ভাবনার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
নদী রক্ষায় সরকার শীতলক্ষ্যাসহ রাজধানীর আশেপাশের ৪টি নদীর হারানো ঐতিহ্য এবং সৌন্দর্য পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নিয়ে পরামর্শক নিয়োগ দেয়। তাদের গবেষণা রিপোর্টে শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদীর দুই পাড়ে প্রায় ৫ হাজার শিল্প কারখানার কথা বলা হয়েছে। আর এই শিল্প কারখানার অপরিশোধিত ডাইং এন্ড প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ, সল্ট ক্রাশিং ইন্ডাস্ট্রিজ, ২ শতাধিক সিসা ডালাই কারখানা, কয়েকশ ব্যাটারী কারখানা, ১২/১৩টি সবজি এবং মাছের আড়ৎ রয়েছে। ৩ শতাধিক ডকইয়ার্ড, শতাধিক স’মিল, রাবার ও প্লাস্টিক কারখানা। আরও রয়েছে, কয়েক হাজার লেদ ও ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ছোট বড় গার্মেন্টস। রয়েছে ক্যামিক্যাল কারখানা, তামাক কারখানা, সিমেন্ট ফ্যাক্টরী, সার কারখানা। এছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটি ইটের ভাটা। নদীর পাড়ের ইট ভাটার ছাঁই ও ধুলাবালি নদীর পানি নষ্ট করে যাচ্ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিপে বলা হয়েছে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জও বন্দরে ৩৮৪টি লাল তালিকাভুক্ত শিল্প কারখানার মধ্যে ২৮১টিতে ইটিপি পাওয়া গেছে। এরমধ্যে কমলা ’খ’ শ্রেণির তালিকাভুক্ত ১৩৯টি শিল্প কারখানার মধ্যে ইটিপি আছে মাত্র ৬৭টিতে। ৭০৯টি কারখানায় ইটিপির জরুরি প্রয়োজনীয়তা থাকলেও এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে তা নেই।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিবেশ অধিদফরের সিনিয়র ক্যামিস্ট মোঃ মহিউদ্দিন মানিক জানান, আমরা ২০১০ সাল থেকে শিল্পকারখানায় ইপিটি স্থাপনের জন্য জোরদার করছি, এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের বিধি অনুযায়ী এনফোর্সম্যান্ট চালু করা হয়েছে। যারা ইটিপি স্থাপন করছে না তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। আর আস্তে আস্তে নদীর ভারসাম্যতা ফিরে পাবে বলে আমি মনে করি।
নারায়ণগঞ্জ জেলা নাগরিক কমিটির সভাপতি এড. এবি সিদ্দিক জানান, আমরা প্রতিনিয়তই শীতলক্ষ্যা নদীর পানি ও পরিবেশ রক্ষার্থে আন্দোলন করে যাচ্ছি। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। সরকার কলকারখানাগুলোতে ইটিপি স্থাপনের নির্দেশ দিয়েই হাত-পা গুটিয়ে বসে আছে। আইন আছে শুধু অসৎ কিছু মহলের লাভের জন্য।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button