আমরাও শার্লি? হায় ইউরোপ !

Charlieফরহাদ মজহার:
ফ্রান্সে বেড়ে ওঠা ফরাসি নাগরিক দুই ভাই শরিফ কুয়াচি (Cherif Kouachi) ও সায়িদ কুয়াচি (Said Kouachi) অতর্কিতে শার্লি হেবদো পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়ে চারজন নামকরা কার্টুনিস্টসহ প্রায় বারোজন মানুষকে হত্যা করেছে। বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করলে এটা, বলাবাহুল্য, একটি হত্যাকাণ্ড। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে পাশ্চাত্যের পত্রিকাগুলোর খবর হচ্ছে, হামলাকারীদের মুখে ‘আল্লাহু আকবর’ স্লোগান শোনা গিয়েছে এবং এটাও শোনা গিয়েছে যে তারা বলেছে ‘নবীর অপমানের প্রতিশোধ নিয়েছি’। হত্যাকারীদের ধরার জন্য ফ্রান্সে রীতিমতো যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তিন দিনব্যাপী পরিচালিত এই অসম ও অস্বাভাবিক পুলিশি অপারেশনে শরিফ কুয়াচি ও সৈয়দ কুয়াচিকে প্রায় ৮০ হাজার ফরাসি পুলিশ সংঘবদ্ধভাবে ঘেরাও করে হত্যা করেছে। তারা একটি ছাপাখানার ভবনে লুকিয়ে ছিল। তাদের হত্যা এতই জরুরি হয়ে পড়েছিল যে, কালো কাপড় পরা কমান্ডোরা হেলিকপ্টারে চড়ে বিল্ডিংয়ের ছাদে নেমে পড়ে। তারপর ভবনের ভেতরে তারা ফ্লাশ গ্রেনেড ছুড়ে মারে।
শরিফ আর সৈয়দ পুলিশের ভাষ্যানুযায়ী বিল্ডিং থেকে তাদের কালাশনিকভ নিয়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়, আর তাদের এ সশস্ত্র বেরিয়ে আসা তৎক্ষণাৎ হত্যার জন্য ভালো একটি যুক্তি হয়ে ওঠে। তাদের সহযোগী ১৮ বছর বয়সী হামিদ মুরাদ নিজেকে নির্দোষ বলে স্বেচ্ছায় পুলিশের কাছে আগেই ধরা দিয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে, পত্রিকাটির অফিস পাহারা দিতে গিয়ে একজন পুলিশও প্রাণ দিয়েছেন, যিনি নিজেও ইসলাম ধর্মাবলম্বী। পুলিশ হামলাকারীদের পরিচয় জানতে পেরেছে। শরিফ কুয়াচি (৩২) এবং সাইদ কুয়াচি (৩৪)।
ওদিকে প্যারিস শহরের ২৫ মাইল দক্ষিণ-পূর্বের ইহুদি লোকালয়ে একটি ‘কোশার’ সুপার মার্কেটে আমেদি কুলেবালি (Amedz Coulibaly) ও হায়াত বুমেদিয়েন (Hayet Boumddiene) কিছু মানুষকে জিম্মি করে দুই ভাইকে বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। সেখানেও পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে জিম্মি উদ্ধার করতে গিয়ে আমেদিকে হত্যা করে এবং ১৫ জন জিম্মিকে উদ্ধার করে। তবে এতে চারজন জিম্মিও নিহত হয়। তবে হায়াত বুমেদিয়েন ঠিক কোথায় তা এখন অবধি সঠিক জানা যায়নি।
ইসলামের নবীর কুৎসিত কার্টুন এঁকে ধর্মপ্রাণ মানুষের মর্যাদাবোধকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করবার ক্ষেত্রে শার্লি হেবদো কুখ্যাতি অর্জন করেছে অনেক আগেই। আল কায়দার চোখে শার্লি হেবদো এবং তার কার্টুনিস্টরা দুশমন। এটা তারা ঘোষণা দিয়েই রেখেছে। এরকম হামলা হতে পারে সে আশংকা সবসময়ই ছিল। পুলিশ পত্রিকাটির অফিস পাহারা দিত। অবশেষে যে আশংকা সবাই করছিল, সেটাই সত্য প্রমাণিত হল।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা সহনশীলতার সীমা নিয়ে তর্ক হতে পারে। কিন্তু শার্লি হেবদো সব ধর্মকেই অপমানিত করে, এটা সত্য নয় মোটেও। অন্যকে অপমানিত করার ক্ষেত্রে তারা উদার অথবা সবার বিরুদ্ধেই কার্টুন এঁকে অপমান ও লাঞ্ছনা সমভাবে বিতরণ করেন, এটা একটা মিথ মাত্র। ইউরোপ এক্ষেত্রে নিজেদের সহনশীল দাবি করলেও ইহুদি ধর্মের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ইউরোপ সহ্য করে না। তাদের ভাষায় এটা ‘অ্যান্টি- সেমিটিক’। ইহুদি ধর্মের কোনো অপমান করা যাবে না। শার্লি হেবদো ব্যতিক্রম নয়। মরিস সন (Maurice Sinet) নামের ৮০ বছর বয়সী এক কার্টুনিস্ট ইহুদি ধর্মকে অবমাননার পর তাকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। কিন্তু তিনি মাফ চাননি, তাকে শার্লি হেবদো থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। ইহুদি বা ইহুদি ধর্মকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা না গেলেও ইসলাম ও মুসলমানদের অনায়াসেই অপমান ও লাঞ্ছিত করা যায়। এই ডবল স্ট্যান্ডার্ড ইউরোপে চালু, শার্লি হেবদোর কার্টুনিস্টরাও এই অসম আচরণে অভ্যস্ত। ইসলামের নবীকে নিয়ে যা খুশি কার্টুন আঁকা যায়, কিন্তু ইহুদি বা ইহুদি ধর্ম নিয়ে নয়।
আগেই বলেছি, বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করলে শার্লি হেবদোর ঘটনা নিঃসন্দেহে একটি হত্যাকাণ্ড এবং প্রথাগত নীতি-নৈতিকতা ও আইনি বিচারে নিন্দনীয় ও বিচারযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এর জন্য ফরাসি প্রশাসনের দায় কতটুকু সেটাও ভেবে দেখা দরকার। শরিফ তথাকথিত জিহাদি কর্মকাণ্ডে জড়িত, এটা প্রশাসনের জানা ছিল। ২০০৫ সালে ফরাসি টেলিভিশনে একটি ডকুমেন্টারি প্রচারিত হয়। সেখানে উগ্র ইসলামপন্থায় জড়িয়ে পড়ার আগে যে তরুণ ফরাসি নাগরিকদের মধ্যে পরামর্শ ও সহায়তা দরকার হয়, ডকুমেন্টারিটি ছিল সেটা নিয়েই। সেখানে শরিফকে ডকুমেন্টারির শুরুতেই দেখা যায়। এখন বলা হচ্ছে, শরিফ কিছুকাল আগে সিরিয়ার যুদ্ধ শেষে ফিরেছে এবং তার অপারেশন ইয়েমেনে আল কায়দার নির্দেশে ঘটেছে।
শার্লি হেবদোর হত্যাকাণ্ডের পর পত্রপত্রিকায় এ যাবৎ যত তথ্য আমরা পাচ্ছি তাতে পরিষ্কার যে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ফরাসি পুলিশ তাদের গ্রেফতার করার চেষ্টা করেনি; যে বিল্ডিংয়ে তারা আশ্রয় নিয়েছিল সেই ভবন আত্মসমর্পণে বাধ্য না হওয়া অবধি ঘিরে রাখার ধৈর্য তারা দেখায়নি। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করার কোনো ভিন্ন কৌশলও তারা গ্রহণ করেনি। বরং হেলিকপ্টার দিয়ে ছাদে নেমে সেখান থেকে তারা ভেতরে ফ্লাশ গ্রেনেড ছোড়ে। এটা ছিল শরিফ ও সৈয়দকে উদভ্রান্ত করার কৌশল যাতে তারা তাদের অস্ত্রসহ বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় এবং তাদের সহজে হত্যা করা যায়। বাংলাদেশে আমরা ‘ক্রসফায়ার’ নামে যে ঘটনার সঙ্গে পরিচিত, এক্ষেত্রেও পুলিশি হত্যাকাণ্ডের ধরন একই। ফরাসি পুলিশের তৎপরতা বাংলাদেশের র‌্যাব বা পুলিশের চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। পার্থক্য হচ্ছে, পুরা ঘটনাই ঘটেছে মিডিয়ার সামনে। দুই ভাইকে আইনের অধীনে এনে বিচার করার পরিবর্তে ‘ক্রসফায়ারে আইনবহির্ভূতভাবে হত্যা’ করা হয়েছে। কালাশনিকভ হাতে বেরিয়ে আসা এবং এরপর আত্মরক্ষার জন্য তাদের হত্যা করা বাংলাদেশী পুলিশের মতোই গল্প। আইনি কায়দায় সাজানো হয়েছে। পত্রিকায় পুলিশের বরাতে প্রচার করা হয়েছে, তারা নাকি শহীদ হতে রাজি, ধরা দেবে না। সেটা সত্য কী মিথ্যা জানার আর উপায় নেই। কারণ শরিফ ও সৈয়দ তাদের ইমান বা বিশ্বাস অনুযায়ী শহীদ।
কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তারা বলতে পারবে না তারা কেন শার্লি হেবদো পত্রিকা অফিসে হামলা করে কার্টুনিস্টদের হত্যা করেছে। কিংবা এটা যে ইসলামের নীতি-নৈতিকতার দিক থেকেও ভুল- সেই উপলব্ধি তাদের মধ্যে সঞ্চার করার মধ্য দিয়ে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে কেউ যেন আর উদ্বুদ্ধ না হয় সেই সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করাও আর সম্ভব নয়। এর একটা নিট ফল হবে এই যে, শরিফ ও সৈয়দ বহু মুসলিম তরুণকে তাদের নবী-রাসূলের অপমান ও অমর্যাদার জন্য ‘প্রতিশোধ’ নিতে অনুপ্রাণিত করবে। মুসলিম তরুণ-তরুণীর জীবনে নবী-রাসূলদের জন্য যে সম্মান ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত, তার মূল্য তাদের নিজের জীবনের সঙ্গে অভিন্ন। ফলে নবীর মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন বিসর্জনের মধ্য দিয়েই অনেকে নিজের জীবনের মর্যাদা ও মূল্য রক্ষাকে শ্রেয় মনে করবে।
দুই
তাহলে আমরা মেনে নিতে পারি, উদ্দেশ্য যাই হোক, শার্লি হেবদোর হত্যাকাণ্ড একটি অপরাধমূলক ঘটনা; কিন্তু অপরাধের বিচার পাল্টা আইনবহির্ভূত পুলিশি হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। এ অধ্যায় আমরা আপাতত ভবিষ্যতের পর্যালোচনার জন্য তুলে রাখতে পারি। শার্ল হেবদোর কার্টুনিস্টদের দেবতা বানানোর যেমন কোনো কারণ ঘটেনি, ঠিক তেমনি তাদের হত্যাকারীদের দানব জ্ঞান করারও কোনো যুক্তি নেই।
ফরাসি সমাজ আন্তর্জাতিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত তারা ফরাসি নাগরিক। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ফরাসি সমাজ ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ হয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে ‘ওরা’ হচ্ছে মুসলমানরা। বলা হচ্ছে, শার্লি হেবদো যেভাবে কদর্য ও কুৎসিতভাবে ইসলামের নবীর কার্টুন এঁকেছে, তাতে মুসলমানদের এত ক্ষিপ্ত হওয়ার কী আছে? এটাই ইউরোপের প্রশ্ন। শার্লি হেবদো তো অন্য ধর্ম এবং ব্যক্তিকে নিয়েও তামাশা করে। কই তারা তো এসে কালাশনিকভ দিয়ে গুলি করে মানুষ হত্যা করে না? এ যুক্তি থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, যেহেতু ইসলাম একটি অসহনশীল ও নিষ্ঠুর ধর্ম, অতএব মুসলমান মাত্রই এ ধরনের ভয়ংকর কাজ করে। ইসলাম ধর্মের কারণেই প্রতিটি মুসলমানেরই সন্ত্রাসী ও সহিংস হয়ে ওঠার সমূহ সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে। শরিফ, সৈয়দ কিংবা আমেদি ফ্রান্সে জন্ম নিয়ে সেখানে বেড়ে উঠলেও তারা ‘ফরাসি’ নয়, শেষ বিচারে তারা ‘মুসলমান’। ফলে খুনের দায়ে অভিযুক্ত হলেও এটা ইসলামেরই দায়। ফরাসি সমাজ তাদের অপরাধপ্রবণতা বদলাতে পারল না কেন, সেটা ফরাসি সমাজের সমস্যা নয়, সেটা ইসলামের সমস্যা।
আইনবহির্ভূতভাবে অপরাধীদের হত্যাকাণ্ড সাঙ্গ করে পাশ্চাত্য এখন ইসলামকে কাঠগড়ায় তুলতে চায়। দ্বিতীয়ত, তারা বলতে চায়, এটা ‘ফ্রি স্পিচ’ বা যা খুশি তাই বলা, লেখা ও কার্টুন আঁকার স্বাধীনতা। অন্যের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা কিংবা অন্যকে অপমানিত করা এতই পবিত্র অধিকার যে, এর সঙ্গে নাকি ঠাট্টা-তামাশা, ব্যঙ্গ বা ইয়ার্কির কোনো পার্থক্য নেই। পাশ্চাত্য যদি এ পার্থক্য করতে অক্ষম হয় তাহলে সেটা তাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি বা সমাজের সমস্যা নয়, সেটা ইসলামেরই সমস্যা! ফ্রিডম অব স্পিচ বা যা খুশি তাই বলা, লেখা বা কার্টুন আঁকার অধিকার একটি ‘পবিত্র’ অধিকার। কোনোভাবেই এ ‘পবিত্র’ অধিকার লংঘন করা যাবে না। সীমাহীন ও অলংঘনীয় অধিকারের এ পবিত্রতা ফ্রিডম অব স্পিচকে স্রেফ ধর্ম ও ধর্মতত্ত্বে পরিণত করে ফেলে। সেদিকে অধিকারবাদীদের বিশেষ হুঁশ নেই। অথচ এ ধার্মিকতাকেই সেক্যুলার দাবি করে ধর্মের বিরুদ্ধে, বিশেষত ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় পাশ্চাত্য। বেশ কৌতুকের ব্যাপার বটে।
শার্লি হেবদোর অফিসে বন্দুকধারীর হামলায় নিহতদের প্রতি শোক জানাতে গিয়ে শোকার্তরা বলছেন, ‘আমরাও শার্লি’। সেটা ঠিক, কারণ তারা সবাই যে নীতিতে বিশ্বাস করেন সেটা হচ্ছে ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’, পাশ্চাত্য লিবারেল চিন্তা ও সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে যার ভূমিকা নির্ণায়ক। সারকথা হচ্ছে, কেউ মুখের কথায়, কিংবা লেখালেখিতে কারও ধর্ম, সংস্কৃতি, পরিচয় কিংবা ব্যক্তির আত্মমর্যাদার সঙ্গে যুক্ত কোনো কিছুকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করলেও সেটা মেনে নিতে হবে। নবী-রাসূলদের নিয়ে কুৎসিত ঠাট্টা, মশকরা, কার্টুন কিংবা লেখালেখি এ নিয়মের বাইরে নয়। কারণ সেটা লাঞ্ছনাকারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা। তারা ধর্ম বা নবী-রাসূলদের নিয়ে যা খুশি বলতেই পারে। অতএব যাকে আহত করা হয়েছে তাকে সেটা মেনে নিতে হবে। এর নাম সহনশীলতা। টলারেন্স। উদার সমাজে বাস করতে হলে সহনশীল হতে হবে। কথা বা কার্টুন দিয়ে প্রতিপক্ষকে পাল্টা আঘাত করা যাবে; কিন্তু সেটা শারীরিক হতে পারবে না। আহত হওয়াটা মানসিক। যিনি আঘাত পেয়েছেন, অলংঘনীয় পবিত্র ব্যক্তি অধিকারের সুবাদে তাকে সেটা মেনে নিতে হবে।
ব্যক্তিতান্ত্রিক অধিকারের এ ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা সেক্যুলারিজমের সমসাময়িক বৈশিষ্ট্য। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক ব্যক্তি ও সমাজের সম্পর্কে যে রূপান্তর ঘটায়, তার বিচার ছাড়া ব্যক্তিতন্ত্রের এ আধ্যাত্মিক পরিণতি ভালোভাবে বোঝা যাবে না। এখানে সেই ব্যাখ্যার সুযোগ সীমিত। যে সমাজে ব্যক্তির চেয়ে সমাজ ছোট, কিংবা সমাজের ঊর্ধ্বে ব্যক্তি অধিষ্ঠিত সেই সমাজের পক্ষে কেন নবী-রাসূলদের অমর্যাদাকে পুরো সমাজের অমর্যাদা হিসেবে গণ্য করা হয় সেটা অনুধাবন করা মুশকিল। ফলে ফ্রান্স শার্লি হেবদোর হত্যাকাণ্ডের স্মরণে মোমবাতি জ্বালিয়ে ‘Je Sui Charlie’ বা ‘আমরাও শার্লি’ প্লাকার্ড হাতে নিয়ে শোক মিছিল করতে পারে সহজে। কারণ তারা তাদের ধর্ম বিশ্বাসেরই প্রতিনিধিত্ব করছে- যা খুশি তাই বলা, লেখা এবং কুৎসিত ও কদর্য কার্টুন আঁকার গোঁয়ার্তুমি। আর তাদের এ অন্ধবিশ্বাসকে লিবারেলিজম আখ্যা দিয়ে তাকে প্রতিস্থাপন করছে ইসলামের বিরুদ্ধে। বিশেষত তাদের বিরুদ্ধে, যারা তাদের সমাজে সংখ্যালঘু ও দুর্বল। তাদের ধারণা, ‘মর্যাদাবোধ’ যার যার ব্যক্তিগত সংবেদনার ব্যাপার। মর্যাদা আহত হওয়ার মানদণ্ড দিয়ে ব্যক্তির অধিকার সংকুচিত করা যাবে না। বলা যাবে না, এ হচ্ছে ঠাট্টা-তামাশা-ব্যঙ্গ-রসিকতা করার সীমা- এ সীমা লংঘন করার অর্থ শুধু অপর কোনো ব্যক্তিকে নয়, পুরো একটি কমিউনিটি বা সমাজকেও অমর্যাদা ও অপমানিত করা। ব্যতিক্রম থাকলেও ফরাসি সমাজ সাধারণভাবে এতই সংবেদনহীন হয়ে পড়েছে যে, ‘আমিও শার্লি’ বলার মধ্য দিয়ে তারা নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করার চেয়ে বিশ্বব্যাপী সেই রটনাকেই প্রবল করছে যে, শার্লি হেবদোর মতো ইসলামের নবী-রাসূলদের অপমান করা তাদের আদপ বা সংস্কৃতির মধ্যেই পড়ে। তারা নিজেরাও শার্লি হেবদোর মতো অন্যদের অপমান ও অবমাননা করতে প্রস্তুত। কারণ ‘আমরাও শার্লি’! বেশ!
আমরাও শার্লি প্রমাণ করার জন্য ইউরোপ ও আমেরিকার পত্রপত্রিকায় শার্লি হেবদোর কার্টুনগুলো আবার ছাপানোর হিড়িক পড়েছে। তারা প্রমাণ করতে চায়, এ ধরনের হামলায় ভীত হয়ে মুখে, কথায়, কিংবা কার্টুনে যা খুশি তাই বলতে, লিখতে ও আঁকতে পারার অন্ধবিশ্বাস তারা ত্যাগ করবে না। ইউরোপ ফ্রিডম অব স্পিচ রক্ষা করার নামে মূলত যেভাবে নগ্নভাবে তাদের বর্ণবাদী চেহারা দেখিয়ে ইসলামের প্রতি আতংক প্রকাশ করছে, তা এক দর্শনীয় ব্যাপার বটে।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে দুনিয়াব্যাপী তারা যে যুদ্ধ করছে, ইউরোপের এ দৃশ্যমান বর্ণবাদ যুদ্ধেরই সম্প্রসারণ মাত্র। তারা নিজেরাই দাবি করছে যে, শরিফ আল কায়দার ইয়েমেনি শাখার নির্দেশ পালন করছে। জানি না এটা সত্য কিনা। যদি তাই হয়, তাহলে যে যুদ্ধ ইউরোপ অন্যের ভূখণ্ডে করছিল তা ক্রমে তার নিজ দেশের সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়ছে।
যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে নিজেদের পক্ষে ইউরোপে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটানোর কৌশলের দিক থেকে আল কায়দা খুবই সফল বলতে হবে। যে গর্ত ইউরোপ অন্যদের জন্য খুঁড়েছিল, সেই গর্তে তারা নিজেরাই পা দিচ্ছে।
ইউরোপের বিবেক ফিরে আসুক। এছাড়া দূর থেকে আমরা আর কীইবা বলতে পারি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button