স্কটিশ গণভোটে গণতন্ত্রের জয় যুক্তরাজ্যে সাংবিধানিক ভূমিকম্প

Sirajur Rahmanসিরাজুর রহমান:
ঐতিহ্যিকভাবেই স্কটিশ জাতি স্বাধীনতাপ্রিয়। ৩০৭ বছর আগে অ্যাক্ট অব ইউনিয়ন (সংযুক্তি আইন) অনুযায়ী ব্রিটেনের সাথে যোগ দিলেও কিছু মানুষের মনে খুঁৎ খুঁৎ থেকে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে স্বাধীনতার দাবি উঠেছে এবং আবার ঝিমিয়ে পড়েছে। বামপন্থী বলে পরিচিত অ্যালেক্স স্যামন্ড ২০ বছর আগে স্কটিশ জাতীয়তাবাদী দল এসএনপির নেতা হয়ে নতুন করে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে টনি ব্লেয়ার ব্রিটিশ প্রধামন্ত্রী হয়ে যুক্তরাজ্যের তিনটি অঙ্গরাজ্য স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের আইন পাস করেন। এতে সবচেয়ে লাভবান হয় স্কটল্যান্ড। অন্য দু’টি রাজ্যে আইনসভা (অ্যাসেম্বলি) হলেও স্কটল্যান্ডকে একটা পার্লামেন্ট এবং বৃহত্তর প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা দেয়া হয়।
অ্যালেক্স স্যামন্ড সাত বছর আগে প্রথম মন্ত্রী (মুখ্যমন্ত্রী) হয়ে স্বাধীনতার আন্দোলন আরো জোরদার করেন। তার আবেগপূর্ণ বাগ্মিতা এসএনপির জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তোলে। চার বছর আগের নির্বাচনে অনেক বেশি গরিষ্ঠতা নিয়ে এসএনপি স্কটিশ পার্লামেন্টে বিজয়ী হয়। তখন থেকে স্যামন্ড তার স্বাধীনতার দাবি আরো সোচ্চার, আরো আপসবিমুখ করে তোলেন। ২০১০ সালের ব্রিটিশ সাধারণ নির্বাচনে টোরি পার্টি সামান্য গরিষ্ঠতা পেলেও স্থিতিশীলতার জন্য সে গরিষ্ঠতা যথেষ্ট ছিল না। সরকারকে নিরাপদ করার লক্ষ্যে ডেভিড ক্যামেরন তৃতীয় দল লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের সাথে কোয়ালিশনে সরকার গঠন করেন। টোরি দলের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে স্যামন্ড ক্যামেরনের ওপর চাপ বাড়িয়ে তোলেন এবং দুই বছর আগে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের কাছ থেকে স্বাধীনতার প্রশ্নে স্কটল্যান্ডে গণভোটের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। তখনই স্থির হয়েছিল যে, সে গণভোট হবে ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার।
বহু কারণে এ গণভোট গণতন্ত্রের জন্য আদর্শস্থানীয় ছিল। তরুণসমাজের আদর্শবাদ ও ভাবাবেগের সুযোগ নেয়ার উদ্দেশ্যে স্যামন্ড ভোটার হওয়ার বয়স কমিয়ে ১৬ বছর করেন। অর্থাৎ এক লাখেরও বেশি ১৬ ও ১৭ বছর বয়সী স্কটিশ তরুণ গণভোটে ভোট দেয়ার অধিকার লাভ করে। দ্বিতীয়ত, ভোটার হওয়ার উপযোগী স্কটিশদের ৯৭ শতাংশ গণভোটে ভোট দেয়ার জন্য নিবন্ধিত হয় এবং তাদের ৮৪ শতাংশ প্রকৃতই ভোট দিয়েছে। যুক্তরাজ্যে ১৯৫১ সালের পর থেকে এত উঁচু হারে ভোট আর কখনো পড়েনি। আরো একটি ব্যাপার, স্কটল্যান্ডের সব মানুষ, এমনকি ১০-১২ বছরের শিশুরাও নির্বাচনী সভা ও মিছিলে অংশ নিয়েছে। গণতান্ত্রিক বিশ্বে কোনো জাতির রাজনীতিতে এমন পরিপূর্ণ সম্পৃক্ততা নজিরবিহীন। প্রচারাভিযানের শেষের দিনগুলোতে যুক্তরাজ্যের বড় তিনটি রাজনৈতিক দলের (টোরি, লেবার ও লিবারেল ডেমোক্র্যাট) নেতারা স্কটল্যান্ডে গিয়ে প্রচারাভিযানে অংশ নেন। মোট কথা গোটা স্কটল্যান্ডে অপ্রত্যাশিত রকম উদ্দীপনা সৃষ্টি করে এই গণভোট। তা সত্ত্বেও প্রচারাভিযানে একটি বাড়িতেও আগুন লাগেনি, খুন হওয়া দূরের কথা লাঠালাঠি হাতাহাতিও হয়নি কোথাও। উভয় পক্ষের নেতারা একই সভায় একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন অনেক স্থানে। দু-একটি ক্ষেত্র ছাড়া সর্বত্রই জনতা অত্যন্ত সৌজন্যপূর্ণভাবে সেসব বক্তৃতা শুনেছে, বৈঠক শেষে দুই পক্ষের বক্তারা পরস্পরের সাথে করমর্দন করেছেন। ভোট গণনা ইত্যাদি নিয়েও কোনো পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ ওঠেনি।
দীর্ঘ স্বস্তির নিঃশ্বাস
এসএনপির ব্যানার, মিছিল ইত্যাদি প্রচার-প্রচারণা নিñিদ্র ছিল। তাদের ব্যাপক ও উদ্দীপনাপূর্ণ প্রচার থেকে অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন যে, স্কটল্যান্ড যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয় যাওয়ার পক্ষেই ভোট দেবে। যুক্তরাজ্য ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপ হয়ে চীন-জাপান পর্যন্ত। এক কালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিল। সে সাম্রাজ্য এখন আর নেই। তার পরেও ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড মিলে চারটি রাজ্যের যুক্তরাজ্য হিসেবে তার অনেকখানি প্রভাব বজায় রেখেছে এ দেশ। বিশ্বরাজনীতিতে সে পরাশক্তিগুলোর সমগোত্রীয় বলে বিবেচিত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ বিশ্বনেতারা ভয় করছিলেন, যুক্তরাজ্য ভেঙে গেলে সে প্রভাব বজায় রাখা কঠিন হবে। খুব সম্ভবত ব্রিটেন জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে তার স্থায়ী সদস্যপদও হারাতে পারত। প্রভাব হারানোর ভয়ে শুধু ইংল্যান্ডেরই নয়, স্কটল্যান্ডেরও বহু লোক উদ্বিগ্ন ছিলেন। স্কটিশ ভোটদাতাদের বিজ্ঞতা ও পূর্ণতা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।
স্কটল্যান্ডের বিচ্ছেদ ঠেকানোর লক্ষ্যে ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টের বড় তিনটি দলের নেতারা স্কটল্যান্ডে প্রচারাভিযান চালিয়েছেন। যুক্তরাজ্যকে অখণ্ড রাখার লক্ষ্যে স্কটল্যান্ডকে আয়কর, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ ইত্যাদি বিষয়ে অধিকতর স্বাধিকারদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা। কিন্তু অন্য তিনটি অঙ্গরাজ্যে, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে এসব ঢালাও প্রতিশ্রুতিকে ভালোভাবে দেখা হয়নি। বস্তুত ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়াই দেখা দিয়েছে বলা চলে। ইংলিশ পার্লামেন্ট সদস্যরা বলছেন, স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্টকে সে দেশের ব্যাপারে কথা বলার ও সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ণ এবং একান্ত অধিকার দেয়া হয়েছে। সেসব ব্যাপারে ইংল্যান্ড, ওয়েলস আর উত্তর আয়ারল্যান্ড থেকে নির্বাচিত এমপিদের কোনো অধিকার থাকবে না। কিন্তু স্কটল্যান্ড থেকে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় (ওয়েস্টমিনস্টার) পার্লামেন্টের সদস্যরা অন্য তিনটি অঙ্গরাজ্যের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে কথা বলতে পারবেন, ভোট দিতে পারবেন, এ কেমন কথা?
টোরি দলীয় অনেক এমপি দাবি করছেন সম্পূর্ণ ইংল্যান্ডের ব্যাপারে স্কটিশ এমপিদের ভোটদানের অধিকার রহিত করা হোক। স্কটল্যান্ডের জের ধরে লন্ডন, ম্যানচেস্টার, লিভারপুল, লিডস, শেফিল্ড প্রভৃতি বৃহত্তর নগরীও এখন অশান্ত হয়ে উঠছে। লন্ডনের মেয়র বরিস জনসন বলেছেন, বৃহত্তর লন্ডনের জনসংখ্যা স্কটল্যান্ডের মোট জনসংখ্যার দ্বিগুণ; স্কটল্যান্ড যখন কর ধার্য ও আদায় করার অধিকার পাচ্ছে, তখন একই অধিকার লন্ডনেরও থাকা উচিত। একটা যেন শৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে এখন। উত্তর-পূর্ব ইংল্যান্ডসহ কোনো কোনো অপেক্ষাকৃত কম সমৃদ্ধ অঞ্চল বলছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং কর ধার্য করা ও আদায়ের ব্যাপারে তাদেরও স্কটল্যান্ডের সমান স্বাধিকার থাকা উচিত। অর্থাৎ গণতন্ত্রের দাবি এখন যুক্তরাজ্যের সর্বত্র মাটি ফুঁড়ে বেরোচ্ছে বলে মনে হতে পারে।
রাজনীতির মারপ্যাঁচ ও প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি
লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড আর টোরিদের নেতা ডেভিড ক্যামেরন একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্কটল্যান্ডকে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়ে এসেছিলেন। সেসব প্রতিশ্রুতি তারা পালন করবেন বলেও পুনরোক্তি করছেন। কিন্তু পন্থা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। গণভোটের পরের দিন প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন বলেন যে, স্কটল্যান্ডের সাথে একযোগে ইংল্যান্ডকেও সমান স্বাধিকার দান করা হবে। প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে আপত্তি করেন বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড। স্কটল্যান্ড থেকে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় এমপিরা (বর্তমানে ৪১ জন) সনাতনীভাবেই লেবার পার্টিকে সমর্থন করেন। বরাবরের জন্য তাদের সমর্থন হারানো লেবারদের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। এড মিলিব্যান্ড সন্দেহ করছেন যে, লেবার পার্টিকে বেকায়দায় ফেলার জন্যই স্কটল্যান্ডের সাথে একযোগে অন্য তিনটি অঙ্গরাজ্যকেও অধিকতর স্বাধিকার প্রস্তাব করছেন ডেভিড ক্যামেরন। ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্টে স্কটিশ এমপিদের ভোটবঞ্চিত করার দাবিতে অনেকেই রাজি হতে পারেন না। সে সমস্যা এড়াতে কেউ কেউ ওয়েস্টমিনস্টার পার্লামেন্ট ছাড়াও শুধু ইংল্যান্ডের জন্য পৃথক একটি পার্লামেন্ট গঠনের প্রস্তাব দিচ্ছেন। ইংল্যান্ডের পৃথক পার্লামেন্ট হলে ওয়েলস আর উত্তর আয়ারল্যান্ডও নিশ্চয়ই একই দাবি জানাবে। অর্থাৎ কেন্দ্রশাসিত যুক্তরাজ্য তেমন অবস্থায় একটা বিকেন্দ্রীকৃত ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
এড মিলিব্যান্ড ডেভিড ক্যামেরনের ফাঁদে পা দিতে প্রস্তুত নন। তিনি বলছেন, সংবিধানের ব্যাপারে এতগুলো জটিল সমস্যার সমাধান হুট করে করা অন্যায় হবে। তার মতে, সমাধানের সঠিক পন্থা হচ্ছে উপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়ে আগামী বছরের (২০১৫ সালের) হেমন্তকালে একটা সাংবিধানিক কনভেনশন (মহাসম্মেলন) আহ্বান করা। সে সম্মেলনে বিচার বিবেচনার পর যে সিদ্ধান্ত হবে তার ভিত্তিতেই বিষয়গুলোর মীমাংসা হতে হবে। কিন্তু সেখানেও একটি সমস্যা আছে। আগামী বছরের হেমন্তের আগে মে মাসেই সারা যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন হবে। তার আগেই স্কটল্যান্ডকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিগুলোর পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে ফেলা হবে বলে তিন দলের নেতা স্কটিশ গণভোটের প্রচারকালে কথা দিয়ে এসেছেন।
যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন আর সাবেক অর্থমন্ত্রী অ্যালিস্টার ডার্লিং (উভয়েই লেবার দলীয় এবং স্কটিশ বংশোদ্ভূত) বলছেন যে কেন্দ্রীয় সরকারকে তাদের প্রতিশ্রুতি গিলে খেতে দেয়া হবে না। অ্যালেক্স স্যামন্ড গত রোববার বিবিসির পলিটিকস টুডে অনুষ্ঠানে বলেছেন, বড় তিনটি জাতীয় দলের কোনো কোনো নেতা অন্যান্য বিষয়কে টেনে এনে নতুন নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করছেন মে মাসের সাধারণ নির্বাচনের আগেই স্কটল্যান্ডকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দান বিলম্বিত করার উদ্দেশ্যে। স্যালম হুমকি দিয়েছেন স্কটিশ জাতি কিছুতেই নেতাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা সহ্য করবে না। তারা আবার পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য কঠোর আন্দোলন শুরু করবে।
ব্রিটেনের কোনো লিখিত সংবিধান নেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী আলোচনা, মতৈক্য আর সমঝোতার ভিত্তিতে অলিখিত সংবিধানের সংশোধন, বিবর্তন আর পরিবর্তন করেছে এই জাতি। এবারে তার ব্যতিক্রম হবে কেন? আমার দৃঢ় বিশ্বাস মারামারি খুনোখুনি না করে আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে এ সমস্যারও সমাধান করবে তারা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button