নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারসহ ১১ দফা প্রস্তাব আ’লীগের

Awamiনির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহারসহ ১১ দফা প্রস্তাব দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে আগামী নির্বাচন কি সংসদ বহাল রেখে নাকি সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন হবে এ বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। সেই সাথে নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকারই বহাল থাকবে নাকি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তাও উল্লেখ করা হয়নি তাদের প্রস্তাবে।
গতকাল বুধবার নির্বাচন কমিশনের সাথে সংলাপে ২১ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বেলা ১১টায় সংলাপ শুরু হয়ে বেলা দেড়টার দিকে সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করা হয়। ব্রিফিংএ সংসদ ভাঙ্গা ও নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোন জবাব না দিয়েই বেরিয়ে আসেন। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জিয়াউর রহমানকে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তক আখ্যায়িত করে যে বক্তব্য দিয়েছে, তার ব্যাখ্যায় আওয়ামী লীগ সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছেন ওবায়দুল কাদের।
সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে কি না, বর্তমান সংসদ বহাল রাখা হবে কি না, ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহার করা-না করা, সংসদীয় আসনগুলোর বিদ্যমান সীমানা বহাল রাখা-না রাখা, নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা-না করা, করলে তাদের বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হবে কি না- মূলত এসব বিষয়ই ঘুরেফিরে প্রাধান্য পাচ্ছে আগামী নির্বাচন ঘিরে।
আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে  নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপে দেয়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মৌলিক বিষয়ে দেয়া প্রস্তাব পরস্পরবিরোধী। সংসদ ভেঙ্গে সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবি বিএনপি জানালেও এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ কোন বক্তব্য দেয়নি। আর বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার দাবি জানানো হয়েছে বিপরীতে আওয়ামী লীগ ভোট গ্রহণে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে প্রস্তাব দিয়েছে। অপর দিকে নির্বাচনে সেনা বাহিনী মোতায়েনের ক্ষেত্রে বিচারিক ক্ষমতা দেয়াসহ সেনা মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি আর আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রের বিরোধিতা করে বলেছে, কোন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা যায় তার ফৌজদারী কার্যবিধি ও সেনা বিধিমালায় উল্লেখ করা আছে। সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিএনপির পক্ষ থেকে সংসদীয় আসনের সীমানা ২০০৮ সালের আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার দাবি জানানো হয়েছে আর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ২০১৪ সালের সংসদীয় আসনের সীমানা বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
তবে আরপিও সংশোধনের ক্ষেত্রে দুই দলের অবস্থান কাছাকাছি। বিএনপি নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোসহ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে। নির্বাচনে অবৈধ অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার রোধের বিষয়ে প্রধান দুই দলের ভাবনা কাছাকাছি।
আওয়ামী লীগের প্রস্তাবমালায় আরপিওর বাংলা সংস্করণে ইসির উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে এর প্রতি সমর্থন দেয়া হয়েছে। নির্বাচনে অবৈধ অর্থ ও পেশিশক্তির ব্যবহার রোধে নির্বাচন সংক্রান্ত সংবিধানের নির্দেশনা ও বিদ্যমান আইনের নিরপেক্ষ ও কঠোর প্রয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত ও নির্বাচনী দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা সংস্থার নির্বাচনে অপেশাদার ও দায়িত্বহীন আচরণের জন্য কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাব করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন পরিচালনায় বেসরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মচারীদের নিয়োগ না দিয়ে প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল কর্মচারীদের থেকে যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ তার সুপারিশে রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে ওই দলের তৃণমূল নেতাকমীদের ভোটের মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী প্রার্থীদের বাছাই করে সংশ্লিষ্ট দলের মনোনীত প্রার্থীদের একটি চূড়ান্ত প্যানেল প্রণয়নের মাধ্যমে প্রার্থী চূড়ান্ত করার কথা বলা হয়েছে।
এ ছাড়া দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও সতর্কতা অবলম্বন এবং কোনোভাবেই যাতে কোনো বিশেষ দল বা ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যশীল হিসেবে পরিচিত বা চিহ্নিত ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব প্রদান না করা হয় তার প্রস্তাব দিয়েছে তারা।
ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসহ গণমাধ্যম কর্মীদের নির্বাচনী বিধি-বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে দায়িত্ব পালনের জন্য কার্যকর নির্দেশনা প্রদান, গণমাধ্যমকর্মীদের উপযুক্ত পরিচয়পত্র প্রদান ও তাদের দায়িত্ব কর্ম-এলাকা নির্ধারণ করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।
পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রভিত্তিক তালিকা ছবি ও এনআইডিসহ নির্বাচনের অন্তত তিন দিন আগে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কাছে প্রদান নিশ্চিতকরণ এবং প্রিজাইডিং অফিসার কর্তৃক তাদের পরিচয়পত্র নিশ্চিত হয়ে ভোটকক্ষে প্রবেশ ও নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত অবস্থানের অনুমতি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
বিরাজমান সব বিধিবিধানের সঙ্গে জনমানুষের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করতে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের মতো আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটদান প্রবর্তন করার সুপারিশ করেছে আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন এ দলটি নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিরোধিতা করে বলেছে, নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পর হতে আইন শৃংখলা রক্ষার ক্ষেত্রে কোন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ করা যাবে তা ১৮৯৮ সালের প্রণীত ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯-১৩১ ধারায় ও সেনা বিধিমালায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।
সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ প্রসঙ্গে তাদের প্রস্তাব হলো, ২০১১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে সীমানা পুননির্ধারণ করা হয়েছে উল্লেখ করে নির্বাচনের কাছাকাছি সময় এসে আবার সীমানা নির্ধারণ করতে গেলে জটিলতা দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে এ জন্য বিদ্যমান সীমানাতেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।
নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে উপস্থাপিত দলের লিখিত প্রস্তাবে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত অপশক্তি ও তাদের এদেশীয় দোসররা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ রাতের আঁধারে নির্মমভাবে হত্যা করে। স্তব্দ হয়ে যায় বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা। কিছুদিনের মধ্যেই হত্যা, ক্যু ও ষড়যন্ত্রের হোতা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান ও সেনা আইন লঙ্ঘন করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন। বাংলাদেশের সংবিধান ও সকল প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ধ্বংস করে দেন। শুরু হয়  স্বৈরশাসনের।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘এ  স্বৈরশাসক তার অবৈধ ক্ষমতা দখলকে  বৈধতা দেওয়ার অভিপ্রায়ে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে হ্যাঁ/না ভোটের আয়োজন করেন এবং তার পক্ষে হ্যাঁ ভোট প্রদানে সব আয়োজন সম্পন্ন করেন। “প্রহসনের এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ যেমন তাদের ভোটাধিকার হারিয়ে ফেলেন, অপরদিকে সব গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট হয়ে যায়। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর‌্যন্ত। জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ক্ষমতা দখলকারী অপর স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালের অবসান ঘটে।
এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিশদ তুলে ধরা হয়। বলা হয়, ‘১৯৮১-৯১ সাল পর্যন্ত জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার যে সংগ্রাম করে আসছিলেন স্বৈরশাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে তার প্রাথমিক বিজয় হয়। জাতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার পরিচালনায় রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রবর্তন ঘটে।’
বৈঠক সূত্র জানায়, গত ১৫ অক্টোবর বিএনপির সঙ্গে সংলাপে জিয়াউর রহমানের গুণগান করে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে আওয়ামী লীগের একজন নেতা ইসিকে উদ্দেশ করে বলেন, “ইতিহাসের স্যাটেলড বিষয় নিয়ে অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করবেন না।’
বৈঠক থেকে বের হয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের বলেন, সিইসির বক্তব্য ভুলভাবে ব্যাখ্যার অবকাশ থাকায় বিতর্ক এড়ানোর জন্য কমিশনকে সতর্কতার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন জ্যেষ্ঠ এক নেতা।
সংলাপে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে সকল নির্বাচন কমিশনার ও সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সংলাপে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলে ছিলেন আমির হোসেন আমু এমপি, তোফায়েল আহমেদ এমপি, মতিয়া চৌধুরী এমপি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, মোহাম্মদ নাসিম এমপি, এইচ টি ইমাম, ড. মসিউর রহমান, ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপি, লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি, রমেশ চন্দ্র সেন এমপি, অ্যাম্বাসেডর জমির, মো. রশিদুল আলম. মাহবুবউল-আলম হানিফ এমপি, ডা. দীপু মণি এমপি, জাহাঙ্গীর কবির নানক এমপি, আব্দুর রহমান এমপি, এইচ এন আশিকুর রহমান এমপি, ড. হাছান মাহমুদ এমপি, ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ ও অ্যাডভোকেট এবিএম রিয়াজুল কবির কাওছার।
স্ত্রীর অসুস্থার কারণে দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী  সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম দেশের বাইরে থাকায় তিনি অংশগ্রহণ করতে পারছেন না।
গত ৩১ জুলাই সুশীল সমাজের সঙ্গে বসার মধ্যদিয়ে সংলাপ শুরু করে নির্বাচন কমিশন। এরপর, ১৬ ও ১৭ আগস্ট নির্বাচন কমিশন আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানায় গণমাধ্যমের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের। সবশেষ ২৪ আগস্ট রাজনৈতিক দল গুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করে নির্বাচন কমিশন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button