আল মাহমুদ : তাঁর পূর্ণাঙ্গতা

Al Mahmudমাহমুদ শাহ কোরেশী: মিতা শব্দের অর্থ আমার জানা ছিল মনে হয়- ‘বন্ধু’, ‘সুহৃদ’। কিন্তু শব্দটির ব্যবহার ছিল অজানা। আল মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হওয়ার পর তিনিই আমাকে জানালেন, আমরা একে অপরের মিতা। আমাদের নামে মিল রয়েছে, আমাদের সাহিত্যচর্চার আকাক্সক্ষা সেই সম্পর্ককে জোরদার করেছে।
বিষয়টি আমি বিস্মৃত হয়েছিলাম। চার বছর আগে কবি ফজল শাহাবুদ্দীন এসেছিলেন আমার বাসায়। যাওয়ার সময় রেখে যাচ্ছেন একটা মোটা বই। বললেন, ‘কোরেশী, বইটি এনেছিলাম আপনার জন্য’ আমার কবিতা! খুশি মনে বইটির পাতা উল্টিয়ে দেখি কিছু লেখা নেই। বললাম, ‘অন্তত একটা স্বাক্ষর দেয়া কি সম্ভব? স্বভাবসিন্ধ দুষ্টমির হাসি ছড়িয়ে ফজল একটু ভাবলেন, তারপর লিখলেন :
‘মাহমুদ শাহ কোরেশীকে
কাফেলা ও আল মাহমুদ
– সেই দিনগুলোকে মনে করে
ভালোবাসা।’
ফজল শাহাবুদ্দীন
২৬-৩-২০১০ ইং।
লেখাটা দেখে চমকে উঠল অন্তরাত্মা। যতবার দেখি, ততবারই। শরীর মনে এক প্রবল শিহরণ, কম্পন দেখা দিলো। অবশ্য ভাবতে ভালো লাগল। স্মরণে এলো পুরনো দিনের কথা। যেখানে আজ মাহমুদের কথা মনে হলেই আমার স্মৃতিতে জাগে পাটুয়াটুলী ‘কাফেলা’ অফিস অথবা নবাবপুর রোডের দোতলায়, তাঁর ছোট্ট আবাসস্থল। সেটা ১৯৫৪ সালের কথা।
সে বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমি ঢাকায় আসি। সেই ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ সাল অবধি রাজধানীতে কাটাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বাংলা বিভাগে। প্রথম তিন মাস ছিলাম নীলক্ষেত ব্যারাকে- যা বর্তমানে অদৃশ্য। পরিচয় হলো অগ্রজপ্রতিম দুই কবির সঙ্গে- আবদুস সাত্তার ও আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী। পরে প্রায় দু’বছর কাটল লালবাগ আমলিগোলায় আর দু’বছর রমনায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। লালবাগ অবস্থানকালে আমার ছোটবোন হোস্নে আরা লিলি ও তার স্বামী সৈয়দ বদিউল আলম নিশ্চয়ই আপ্যায়নের সুযোগ গ্রহণ করেছেন বন্ধু আল মাহমুদকে। তারা ছিলেন খুবই অতিথিপরায়ণ দম্পতি। অবশ্য আল মাহমুদ ইতোমধ্যে আমার আকর্ষণ ছাড়াও তার কাজের প্রয়োজনে আসতেন কবি হাবীবুর রহমানের কাছে। খুব কাছেই থাকতেন এই প্রখ্যাত সনেট-রচয়িতা। এক সময়ে ‘কাফেলা’ সাময়িকীর দায়িত্বভারও ছিল তার ওপর। তা ছাড়া তার ছোট ভাই সাইফুর রহমান, গল্পলেখক, ছিলেন আমাদের দু’জনের বন্ধু।
আমার মিতা আল মাহমুদ তখন চুটিয়ে কবিতা লিখছেন। পাঠক-শ্রোতারূপে মুগ্ধ হচ্ছি আমরা। নিজে কবি নই তাই কাব্য ঈর্ষার জন্ম হয়নি। কখনো অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো দু’চারটা গল্প, আরেকটু বেশি অনুবাদ, সাহিত্য ও সিনেমা-সমালোচনা লিখে কাউকে কাউকে অবাক করে দিচ্ছি। হাবীব ভাই, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আল মাহমুদ ও আহমেদুর রহমান সেগুলো যতœ করে ছাপছেন। সে এক অবিশ্বাস্য দিন বটে! আমাদের তারুণ্যদীপ্ত প্রহরগুলো অতিক্রান্ত হতো নানা আলাপ আর অট্টহাসিতে। তারপর যোগাযোগ নেই দীর্ঘ দিন। আমি বিদেশবাসী, প্যারিসে। ফিরলাম ১৯৬৮ সালের আগস্টে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আল মাহমুদও তখন চট্টগ্রামে। আমাদের বন্ধু সৈয়দ মোহাম্মদ শফির আর্ট প্রেসে কর্মরত। তবে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের একান্ত স্নেহভাজন। বিভিন্ন সাহিত্য সভায় তার কবিতা পাঠ নির্ধারিত। এক বেতার আলোচনায় আমি কবি আল মাহমুদ সম্পর্কে কিছু কথা বললাম, যা তার পছন্দ হয়েছে বলে জানলাম। তখনই তার শব্দচয়ন ও উপমা ব্যবহারে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম ভীষণভাবে।
১৯৭০ সাল। একপর্যায়ে ঢাকা এলে আমার ছোট ভাই ডাকসু নেতা আকবর শাহ ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজউদ্দিন হোসেনের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে নিয়ে যায় আমাকে। তখন আবার আল মাহমুদকে পেলাম ইত্তেফাকের সারিবদ্ধ ডেস্কে। কিছুক্ষণ চলল কুশল বিনিময়।
এরপর মুক্তিযুদ্ধ। একবার কি দু’বার সামান্য সাক্ষাৎ কবি আল মাহমুদের সাথে। সেসময় তাকে খুব উত্তেজিত দেখি। সেই উত্তেজনার রেশ চলে আসে যুদ্ধ সমাপ্তির পরও। তখন ‘গণকণ্ঠ’-এর কাল।
পরবর্তীতে তার সাথে দেখাশোনা শিল্পকলা একাডেমিতে। সে সময় তাকে যথেষ্ট প্রসন্নচিত্ত দেখি। বন্ধু আসাফউদ্দৌলা তখন সেখানে মহাপরিচালক। তার সাথে চীনে যাওয়ার প্রাক্কালে (১৯৭৮) তারই অনুরোধে আল মাহমুদ আমার দু’টি কাজ করে দেন। একটা হলো অধ্যাপক মনসুরউদ্দিনের হারামণির সাম্প্রতিক (সম্ভবত সপ্তম) খণ্ডের একটা সমালোচনামূলক নিবন্ধ ইত্তেফাক পত্রিকায় এবং অন্যটি হলো অতীশ দীপঙ্করের ওপর আমার একটি রচনা সচিত্র সন্ধানীতে ‘ঘরে ফেরা’ শিরোনামে প্রকাশের ব্যবস্থা।
এ সময়টায় আমি থাকি রাজশাহীতে। আল মাহমুদের সাথে যোগাযোগ প্রধানত আমার শ্যালক ও তার সহকর্মী সৈয়দ আলী কাযেম (মেহরাব) মারফত। শিল্পকলা পত্রিকার জন্য বাংলা ও ইংরেজি প্রবন্ধ রচনা, কোনো গ্রন্থের ‘রিভিউ’ আমি তাদের জন্য করি। তবে স্মরণযোগ্য এক দুপুর কেটেছে তার অফিসের কাছে চিটাগাং রেস্তোরাঁয় বিশালাকৃতির সুস্বাদু মৎস্যসহকারে মধ্যাহ্নভোজনে। আল মাহমুদ আমাকে তার কাব্য সঙ্কলনের একটি কপি উপহার প্রদান করেন।
তারপর দীর্ঘকাল প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে না। এমনকি আমি বাংলা একাডেমিতে বছরাধিক সময় মহাপরিচালকের পদে অধিষ্ঠিত থাকার কালেও অনেকানেক কবিদের সাথে সাক্ষাৎ হলেও আল মাহমুদের স্মৃতি খুঁজে পাচ্ছি না। পরবর্তী যোগাযোগ আল মাহমুদ যখন পালাবদল পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক। তিনি আমাকে ফোনে জানালেন, স্যারের একটা ‘ইন্টারভিউ’ নিতে হবে আমাকে। ‘স্যার’ রূপে তখন খুব পরিচিত জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। পরদিন সকালে আমি রাজশাহী ফিরে যাচ্ছি। ‘স্যার’ই মুশকিল আসান করলেন। বললেন, ‘তুমি প্রশ্ন লিখে রেখে যাও, আমি উত্তর লিখে দেব খন।’ এতে সুবিধা হলো আমার। কিছু দুঃসাহসী এবং অনেকটা দুর্বিনীত প্রশ্ন লিখে তার কন্যার হাতে দিয়ে আমি রাজশাহী রওনা দিলাম। যথারীতি জবাব ছাপা হয়েছিল এবং মৃদু আলোড়নও হয়তো হয়েছিল। মাঝখানে আল মাহমুদের একটি সংবর্ধনাও হয়েছিল বলে মনে পড়ে। কখন, কারা করেছিলেন বিস্মৃত হয়েছি। সম্ভবত তরুণ অনুরাগী ইশাররফ এর সাথে জড়িত ছিলেন এবং আমার কাছ থেকেও একটি সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছাজ্ঞাপক বক্তব্য লিখিয়ে নিয়েছিলেন।
যা হোক, সবকিছু প্রমাণ করে যে, কখনো বিচ্ছিন্নপ্রায় হয়ে দূরবর্তী অবস্থান সত্ত্বেও আল মাহমুদের সাথে আমার একটা আন্তরিক নৈকট্য ছিল।
কবি ও কথাশিল্পী : প্রাশস্ত্য
মানুষটি ছোটখাটো, স্বাস্থ্যগতভাবে একটু নড়বড়ে মনে হলেও আল মাহমুদ আজ সর্বত্র এক অতি শক্তিমান কবিরূপে প্রতিভাত। এটা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে, ছোট বড়, ডান-বাম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আল মাহমুদের কবিতা, শুধু কবিতা কেন পদ্যও ভীষণ জনপ্রিয়। আমরা কি অনুসন্ধান করেছি কেন এই জনপ্রিয়তা? তিনি কি আমাদের হারানো গ্রাম, লুকিয়ে থাকা লোকজ সংস্কৃতির ধারাকে তুলে ধরেন বলে, না নগর সভ্যতার ভালো-মন্দ নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে দেন বলে, কিংবা জীবন ও জগতের বহুবিধ বিষয়ে গভীর আত্মজিজ্ঞাসা ধ্বনিত করে তোলেন বলেই কি তার পাঠকপ্রিয়তা? কখনো বা দেখি সব জিজ্ঞাসার মীমাংসা আল মাহমুদের তেজোদীপ্ত বিশ্বাসী কবিকণ্ঠেই ধ্বনিত।
তবে তিনি বিভিন্ন সময়ে আমাদের একাধিকবার সচেতন করে দেন তার যথার্থ কবিসত্তা সম্পর্কে।
‘আমার কবিতার আধেয় বা বিষয় হলো রহস্য সৃষ্টি শেষ পর্যন্ত সুন্দর শব্দের নিগূঢ় রহস্য নির্মাণই আমার কবিতা’ (বিচিত্রা, ‘লেখালেখি’, মাহবুব হাসান গৃহীত সাক্ষাৎকার, ১৯৯০, পৃ. ৪১)।
আসলে আল মাহমুদ একজন ব্যতিক্রমধর্মী কবি। উত্তর তিরিশ, চল্লিশের কবিকূল থেকে তিনি ভিন্ন। পঞ্চাশের মাঝামাঝি তার কাব্য প্রয়াসের আধুনিক পর্বের সূত্রপাত। এর আগে উত্তীর্ণ হয়েছে বাল্য রচনার কাল। লোকজ শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা তিনি আধুনিক কাব্যের ভাষায় সহজে মিশিয়ে দিয়েছেন। প্রথম দুটি কাব্যে তার সাফল্য লক্ষ্যযোগ্য। হিন্দু-বৌদ্ধ ঐতিহ্য একসময় তিনি সানন্দে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ সোনালী কাবিন (১৩৮০) তাকে পূর্ণাঙ্গ কবি মহিমায় আসীন করেছে। এ নিয়ে বহুজন বহু কথা বলেছেন। আমার ধারণা, তার চতুর্দশপদীগুলোতে রয়েছে বোদ্লেরীয় গঠনসৌষ্ঠব, তা ছাড়া তিনি আদ্যোপান্ত মৌলিক। কিছু পরে, ১৯৮১ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে কবীর চৌধুরী তাকে One of the most important poets of bangladesh and that his poetry is unique in many ways বলে মন্তব্য করতে দ্বিধা করেননি।
সোনালী কাবিন কাব্যে আমরা দেখি কবি তার বাগদত্তা প্রেমিকাকে সরাসরি বলে দিচ্ছেন
দেনমোহর দিতে পারবেন না। দেবেন যা তা আমরা সবাই জানি। নানা সম্বোধন ও আপ্তবাক্যে বিভিন্ন রূপ-আকৃতি ধারণ করছে তার ফিঁয়সে : হরিণী, সখি, নারী, পানোখী, কলাবতী, বুনো হংসিনী, অষ্টাদশী, সাপিনী, সুন্দরী, বন্যবালিকা, বধূ, বালা, প্রাণের শর্বরী,পক্ষিনী, পড়শী, একতারা, কাতরা, অবলা, চঞ্চলা, সতী, বেহুলা, কন্যা, মানিনী, শ্যামাঙ্গী, প্রিয়তমা, সাহসিনী, সুকণ্ঠি, মেয়ে, সুশীলা, বিহ্বলা, ভদ্রে, রূপবতী, কপোতী, দেখন হাসি, মহিয়সী, বিবি, বিদ্যুতের ফলক, বানু ইত্যাদি। ‘চলার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ’ দিয়ে কবি তার ফিঁয়সের মান ভাঙান বা প্রেম নিবেদন করেন।
আল মাহমুদের কাব্যজগতে আবির্ভাব বিস্ময়কর না হলেও কাব্যক্ষেত্রে দ্রুত স্বকীয়তা অর্জন ও সাফল্য তাঁর কঠোর পরিশ্রমের ফসল। ঢাকা-কলকাতার বহু সাহিত্যপত্রে অবিরাম তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকল। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় ও সিকান্দার আবু জাফরের সমকালে ক্রমাগত কবিতা ছাপা হতে থাকলে তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। বলাবাহুল্য, অতি অল্প সময়ে, লোক লোকান্তর (১৩৭০) ও কালের কলস (১৩৭৩) দু’টি মাত্র কাব্যগ্রন্থ
প্রকাশের পর তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন (১৯৬৮)। উল্লেখ্য, ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমৃত্যু (২০০২) অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের সহানুভূতি ও নৈকট্য তিনি পেয়েছেন। চট্টগ্রামে শুধু কাব্য পাঠের আসর নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পিকনিকে ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানেও আল মাহমুদ থাকতেন তাঁর আমন্ত্রিত অতিথি।
সোনালী কাবিন প্রকাশের পর একের পর এক মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে (১৯৭৬), অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না (১৯৮০), বখতিয়ারের ঘোড়া (১৯৮৫) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। জনপ্রিয়তার জোয়ার দেখে অনেকে অবশ্য বিস্মৃত হন যে, আল মাহমুদ ইতোমধ্যে তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর ও আশির দশকের প্রধান কবিদের চৌহদ্দী অতিক্রম করে নিজস্ব ভুবনে সার্বভৌম কবিরূপে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। এ সম্পর্কে ইতোমধ্যে অসংখ্য প্রবন্ধ, আলোচনা ও গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো হবে। তাঁর জীবন দর্শন তাঁকে আরো স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। উদ্ধৃতি প্রদানের প্রলোভন থেকে রেহাই পেতে চাই আমি, পাঠক স্বতন্ত্রভাবে আল মাহমুদের কবিতা, কবিতা সমগ্র প্রভৃতি গ্রন্থে আকণ্ঠ ডুবে থাকতে পারেন।
সংযোগে আমার অভিজ্ঞতায় আমি বুঝতে পারি আল মাহমুদ জীবনকে নিজের জন্য, মানুষের জন্য উপভোগ্য করে তুলতে চেয়েছেন। দেশের এবং বিশ্বের কল্যাণে তাঁর কলমকে অনলস শাণিত ও সতেজ রেখেছেন। তিনি সৌন্দর্যকে আত্মস্থ করতে প্রয়াসী হয়েছেন আবার তাঁর ‘প্রিয় প্রভু’র প্রতি শর্তহীনভাবে সমর্পিত থেকেছেন। এমন বিনয়ী, সাহসী এবং সৎ মানুষ ও কবি একালে দুর্লভ বলে আমার ধারণা।
তবে সবচেয়ে বড় কথা- জানি না ‘বেশি দেখার দৈব বিমার থেকে’ কিনা, কবিতা লিখতে লিখতে আল মাহমুদ অনুভব করলেন ভাষার আরেকটি অনুশীলনে তিনি তাঁর মনোমত উপায়ে প্রকৃতি ও মানুষের বিভিন্ন রূপের যথার্থ পরিণতি তুলে ধরতে সক্ষম। সম্ভবত এটি তাঁকে নিয়ে আসে গল্পের ভুবনে। ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘কালো নৌকা’, ‘জলবেশ্যা’ প্রভৃতিতে এ ধরনের অনুভূতির অনুরাগ সৃষ্টি করেছে।
তাঁর ছোটগল্পের ভূগোল সুবিস্তৃত। বাংলাদেশ, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন অঞ্চলের প্রকৃতি ও মানুষ নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে, পুরান ঢাকা থেকে রাজধানীর অত্যাধুনিক মানুষের মনন ও অনুভূতি, এমনকি সমুদ্রের আবহও রূপায়িত হয়েছে আল মাহমুদের স্বতন্ত্র মনোভঙ্গি ও দৃষ্টিকোণ থেকে। আমাদের অন্যতম সেরা কথাশিল্পী ও সমালোচক আবু রুশদ তাই তাঁর গল্পের বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়েছেন।
কিন্তু কল্পনা রাজ্যের কাজই এরকম যে, একটু এগুলো আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার বাসনা জাগে। তাই শুরু হলো তাঁর উপন্যাস রচনা। দীর্ঘ জীবনের যাপিত দিবস-রজনী-মাস নানা সত্যকে উদ্ভাসিত করে তোলে। কবি অবশ্যই তা উপেক্ষা করতে পারে না। রচিত হয় কাবিলের বোন, উপমহাদেশ প্রভৃতির মতো উপন্যাস।
ব্যক্তিগত সমস্যার ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এসে কবি এক নির্ভেজাল সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন :
‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ,
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।’
(দোয়েল ও দয়িতা)
আল মাহমুদকে কেউ কেউ খুব প্রশংসা কিংবা মাত্রাতিরিক্ত নিন্দা করেছেন তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য বা ভূমিকার জন্য। কিন্তু কবি শিল্পীদের মাতৃভূমি প্যারিস গ্রন্থে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছেন :
‘আমি তো আগেই বলেছি, আমি রাজনীতিক নই, আমি একজন কবি মাত্র। আর কবিতা হলো জগতের সবচেয়ে সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম।’ (পৃ. ১১)
তিনি উদার বিশ্ব দৃষ্টির প্রবক্তা। এবং তাঁর সুস্পষ্ট উচ্চারণ :
‘আমরা মূলত আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী সাংস্কৃতিক পটভূমি প্রতিধ্বনিত করতে চাই- যে ধরনের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি আমাদের বিশ্বাসের অনুকূল।
… এখানে বলা উচিত আমি যেখানে যেভাবেই থাকি আমার বিশ্বাসের কথা বলি কবিতায়, অভিভাষণ এবং প্রবন্ধে। আমার মধ্যে কোনো ক্ষুদ্রতা নেই। আমি বিশ্ব বিচরণশীল আধুনিক মানুষ। আমি সবসময়ই চেয়েছি আমাদের তরুণ কবিরা বিচরণশীল আধুনিক কবি প্রতিভার অধিকারী হোক। সঙ্কীর্ণ হৃদয় নিয়ে আদর্শকে, বিশ্বাস-বিভূতিকে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। মানুষকে ভালোবাসতে হয়।’ (সমগ্রন্থ, পৃ. ১২)
প্যারিস-ভ্রমণ কবিকে এই ধারণা দিয়েছে- ‘প্যারিস না দেখলে ইউরোপের মর্মমূল স্পর্শ করা যায় না’। তিনি যা বলেননি অথচ জানেন তা হলো : ইউরোপকে না জানলে বিশ্বকে পুরোপুরি বোঝা যাবে না, বিশ্বদর্শনজাত জীবনোপলব্ধি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
অতএব, আল মাহমুদের প্রশংসা করতে হলে তাঁর লেখার অর্থাৎ পদ্য এবং গদ্যের শিল্পমূল্য বিচার করেই তা করতে হবে এবং তাঁর রচনায় ভালো-না-লাগা অংশেরও কারণ নির্ধারণ করতে হবে যথার্থ সমালোচকের দৃষ্টিকোণ থেকে। যেহেতু কবি ও কথাশিল্পীরূপে বর্তমানে তিনি এমন এক প্রাশস্ত্য অর্জন করেছেন, যা তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বিস্তৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তাই সব দিক বিবেচনা করে আমি নিজেকে তাঁর পূর্ণাঙ্গতার অন্যতম সাক্ষ্যদাতা মনে করি।মিতা শব্দের অর্থ আমার জানা ছিল মনে হয়- ‘বন্ধু’, ‘সুহৃদ’। কিন্তু শব্দটির ব্যবহার ছিল অজানা। আল মাহমুদের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হওয়ার পর তিনিই আমাকে জানালেন, আমরা একে অপরের মিতা। আমাদের নামে মিল রয়েছে, আমাদের সাহিত্যচর্চার আকাক্সক্ষা সেই সম্পর্ককে জোরদার করেছে। বিষয়টি আমি বিস্মৃত হয়েছিলাম। চার বছর আগে কবি ফজল শাহাবুদ্দীন এসেছিলেন আমার বাসায়। যাওয়ার সময় রেখে যাচ্ছেন একটা মোটা বই। বললেন, ‘কোরেশী, বইটি এনেছিলাম আপনার জন্য’ আমার কবিতা! খুশি মনে বইটির পাতা উল্টিয়ে দেখি কিছু লেখা নেই। বললাম, ‘অন্তত একটা স্বাক্ষর দেয়া কি সম্ভব? স্বভাবসিন্ধ দুষ্টমির হাসি ছড়িয়ে ফজল একটু ভাবলেন, তারপর লিখলেন : ‘মাহমুদ শাহ কোরেশীকে কাফেলা ও আল মাহমুদ – সেই দিনগুলোকে মনে করে ভালোবাসা।’ ফজল শাহাবুদ্দীন ২৬-৩-২০১০ ইং। লেখাটা দেখে চমকে উঠল অন্তরাত্মা। যতবার দেখি, ততবারই। শরীর মনে এক প্রবল শিহরণ, কম্পন দেখা দিলো। অবশ্য ভাবতে ভালো লাগল। স্মরণে এলো পুরনো দিনের কথা। যেখানে আজ মাহমুদের কথা মনে হলেই আমার স্মৃতিতে জাগে পাটুয়াটুলী ‘কাফেলা’ অফিস অথবা নবাবপুর রোডের দোতলায়, তাঁর ছোট্ট আবাসস্থল। সেটা ১৯৫৪ সালের কথা। সে বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমি ঢাকায় আসি। সেই ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ সাল অবধি রাজধানীতে কাটাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বাংলা বিভাগে। প্রথম তিন মাস ছিলাম নীলক্ষেত ব্যারাকে- যা বর্তমানে অদৃশ্য। পরিচয় হলো অগ্রজপ্রতিম দুই কবির সঙ্গে- আবদুস সাত্তার ও আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী। পরে প্রায় দু’বছর কাটল লালবাগ আমলিগোলায় আর দু’বছর রমনায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। লালবাগ অবস্থানকালে আমার ছোটবোন হোস্নে আরা লিলি ও তার স্বামী সৈয়দ বদিউল আলম নিশ্চয়ই আপ্যায়নের সুযোগ গ্রহণ করেছেন বন্ধু আল মাহমুদকে। তারা ছিলেন খুবই অতিথিপরায়ণ দম্পতি। অবশ্য আল মাহমুদ ইতোমধ্যে আমার আকর্ষণ ছাড়াও তার কাজের প্রয়োজনে আসতেন কবি হাবীবুর রহমানের কাছে। খুব কাছেই থাকতেন এই প্রখ্যাত সনেট-রচয়িতা। এক সময়ে ‘কাফেলা’ সাময়িকীর দায়িত্বভারও ছিল তার ওপর। তা ছাড়া তার ছোট ভাই সাইফুর রহমান, গল্পলেখক, ছিলেন আমাদের দু’জনের বন্ধু। আমার মিতা আল মাহমুদ তখন চুটিয়ে কবিতা লিখছেন। পাঠক-শ্রোতারূপে মুগ্ধ হচ্ছি আমরা। নিজে কবি নই তাই কাব্য ঈর্ষার জন্ম হয়নি। কখনো অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো দু’চারটা গল্প, আরেকটু বেশি অনুবাদ, সাহিত্য ও সিনেমা-সমালোচনা লিখে কাউকে কাউকে অবাক করে দিচ্ছি। হাবীব ভাই, আবদুল গাফফার চৌধুরী, আল মাহমুদ ও আহমেদুর রহমান সেগুলো যতœ করে ছাপছেন। সে এক অবিশ্বাস্য দিন বটে! আমাদের তারুণ্যদীপ্ত প্রহরগুলো অতিক্রান্ত হতো নানা আলাপ আর অট্টহাসিতে। তারপর যোগাযোগ নেই দীর্ঘ দিন। আমি বিদেশবাসী, প্যারিসে। ফিরলাম ১৯৬৮ সালের আগস্টে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আল মাহমুদও তখন চট্টগ্রামে। আমাদের বন্ধু সৈয়দ মোহাম্মদ শফির আর্ট প্রেসে কর্মরত। তবে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের একান্ত স্নেহভাজন। বিভিন্ন সাহিত্য সভায় তার কবিতা পাঠ নির্ধারিত। এক বেতার আলোচনায় আমি কবি আল মাহমুদ সম্পর্কে কিছু কথা বললাম, যা তার পছন্দ হয়েছে বলে জানলাম। তখনই তার শব্দচয়ন ও উপমা ব্যবহারে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম ভীষণভাবে। ১৯৭০ সাল। একপর্যায়ে ঢাকা এলে আমার ছোট ভাই ডাকসু নেতা আকবর শাহ ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক সিরাজউদ্দিন হোসেনের সাথে আলাপ করিয়ে দিতে নিয়ে যায় আমাকে। তখন আবার আল মাহমুদকে পেলাম ইত্তেফাকের সারিবদ্ধ ডেস্কে। কিছুক্ষণ চলল কুশল বিনিময়। এরপর মুক্তিযুদ্ধ। একবার কি দু’বার সামান্য সাক্ষাৎ কবি আল মাহমুদের সাথে। সেসময় তাকে খুব উত্তেজিত দেখি। সেই উত্তেজনার রেশ চলে আসে যুদ্ধ সমাপ্তির পরও। তখন ‘গণকণ্ঠ’-এর কাল। পরবর্তীতে তার সাথে দেখাশোনা শিল্পকলা একাডেমিতে। সে সময় তাকে যথেষ্ট প্রসন্নচিত্ত দেখি। বন্ধু আসাফউদ্দৌলা তখন সেখানে মহাপরিচালক। তার সাথে চীনে যাওয়ার প্রাক্কালে (১৯৭৮) তারই অনুরোধে আল মাহমুদ আমার দু’টি কাজ করে দেন। একটা হলো অধ্যাপক মনসুরউদ্দিনের হারামণির সাম্প্রতিক (সম্ভবত সপ্তম) খণ্ডের একটা সমালোচনামূলক নিবন্ধ ইত্তেফাক পত্রিকায় এবং অন্যটি হলো অতীশ দীপঙ্করের ওপর আমার একটি রচনা সচিত্র সন্ধানীতে ‘ঘরে ফেরা’ শিরোনামে প্রকাশের ব্যবস্থা। এ সময়টায় আমি থাকি রাজশাহীতে। আল মাহমুদের সাথে যোগাযোগ প্রধানত আমার শ্যালক ও তার সহকর্মী সৈয়দ আলী কাযেম (মেহরাব) মারফত। শিল্পকলা পত্রিকার জন্য বাংলা ও ইংরেজি প্রবন্ধ রচনা, কোনো গ্রন্থের ‘রিভিউ’ আমি তাদের জন্য করি। তবে স্মরণযোগ্য এক দুপুর কেটেছে তার অফিসের কাছে চিটাগাং রেস্তোরাঁয় বিশালাকৃতির সুস্বাদু মৎস্যসহকারে মধ্যাহ্নভোজনে। আল মাহমুদ আমাকে তার কাব্য সঙ্কলনের একটি কপি উপহার প্রদান করেন। তারপর দীর্ঘকাল প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে না। এমনকি আমি বাংলা একাডেমিতে বছরাধিক সময় মহাপরিচালকের পদে অধিষ্ঠিত থাকার কালেও অনেকানেক কবিদের সাথে সাক্ষাৎ হলেও আল মাহমুদের স্মৃতি খুঁজে পাচ্ছি না। পরবর্তী যোগাযোগ আল মাহমুদ যখন পালাবদল পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক। তিনি আমাকে ফোনে জানালেন, স্যারের একটা ‘ইন্টারভিউ’ নিতে হবে আমাকে। ‘স্যার’ রূপে তখন খুব পরিচিত জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান। পরদিন সকালে আমি রাজশাহী ফিরে যাচ্ছি। ‘স্যার’ই মুশকিল আসান করলেন। বললেন, ‘তুমি প্রশ্ন লিখে রেখে যাও, আমি উত্তর লিখে দেব খন।’ এতে সুবিধা হলো আমার। কিছু দুঃসাহসী এবং অনেকটা দুর্বিনীত প্রশ্ন লিখে তার কন্যার হাতে দিয়ে আমি রাজশাহী রওনা দিলাম। যথারীতি জবাব ছাপা হয়েছিল এবং মৃদু আলোড়নও হয়তো হয়েছিল। মাঝখানে আল মাহমুদের একটি সংবর্ধনাও হয়েছিল বলে মনে পড়ে। কখন, কারা করেছিলেন বিস্মৃত হয়েছি। সম্ভবত তরুণ অনুরাগী ইশাররফ এর সাথে জড়িত ছিলেন এবং আমার কাছ থেকেও একটি সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছাজ্ঞাপক বক্তব্য লিখিয়ে নিয়েছিলেন। যা হোক, সবকিছু প্রমাণ করে যে, কখনো বিচ্ছিন্নপ্রায় হয়ে দূরবর্তী অবস্থান সত্ত্বেও আল মাহমুদের সাথে আমার একটা আন্তরিক নৈকট্য ছিল। কবি ও কথাশিল্পী : প্রাশস্ত্য মানুষটি ছোটখাটো, স্বাস্থ্যগতভাবে একটু নড়বড়ে মনে হলেও আল মাহমুদ আজ সর্বত্র এক অতি শক্তিমান কবিরূপে প্রতিভাত। এটা এখন সর্বজনস্বীকৃত যে, ছোট বড়, ডান-বাম, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আল মাহমুদের কবিতা, শুধু কবিতা কেন পদ্যও ভীষণ জনপ্রিয়। আমরা কি অনুসন্ধান করেছি কেন এই জনপ্রিয়তা? তিনি কি আমাদের হারানো গ্রাম, লুকিয়ে থাকা লোকজ সংস্কৃতির ধারাকে তুলে ধরেন বলে, না নগর সভ্যতার ভালো-মন্দ নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে দেন বলে, কিংবা জীবন ও জগতের বহুবিধ বিষয়ে গভীর আত্মজিজ্ঞাসা ধ্বনিত করে তোলেন বলেই কি তার পাঠকপ্রিয়তা? কখনো বা দেখি সব জিজ্ঞাসার মীমাংসা আল মাহমুদের তেজোদীপ্ত বিশ্বাসী কবিকণ্ঠেই ধ্বনিত। তবে তিনি বিভিন্ন সময়ে আমাদের একাধিকবার সচেতন করে দেন তার যথার্থ কবিসত্তা সম্পর্কে। ‘আমার কবিতার আধেয় বা বিষয় হলো রহস্য সৃষ্টি শেষ পর্যন্ত সুন্দর শব্দের নিগূঢ় রহস্য নির্মাণই আমার কবিতা’ (বিচিত্রা, ‘লেখালেখি’, মাহবুব হাসান গৃহীত সাক্ষাৎকার, ১৯৯০, পৃ. ৪১)। আসলে আল মাহমুদ একজন ব্যতিক্রমধর্মী কবি। উত্তর তিরিশ, চল্লিশের কবিকূল থেকে তিনি ভিন্ন। পঞ্চাশের মাঝামাঝি তার কাব্য প্রয়াসের আধুনিক পর্বের সূত্রপাত। এর আগে উত্তীর্ণ হয়েছে বাল্য রচনার কাল। লোকজ শব্দ, উপমা, উৎপ্রেক্ষা তিনি আধুনিক কাব্যের ভাষায় সহজে মিশিয়ে দিয়েছেন। প্রথম দুটি কাব্যে তার সাফল্য লক্ষ্যযোগ্য। হিন্দু-বৌদ্ধ ঐতিহ্য একসময় তিনি সানন্দে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ সোনালী কাবিন (১৩৮০) তাকে পূর্ণাঙ্গ কবি মহিমায় আসীন করেছে। এ নিয়ে বহুজন বহু কথা বলেছেন। আমার ধারণা, তার চতুর্দশপদীগুলোতে রয়েছে বোদ্লেরীয় গঠনসৌষ্ঠব, তা ছাড়া তিনি আদ্যোপান্ত মৌলিক। কিছু পরে, ১৯৮১ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে কবীর চৌধুরী তাকে One of the most important poets of bangladesh and that his poetry is unique in many ways বলে মন্তব্য করতে দ্বিধা করেননি। সোনালী কাবিন কাব্যে আমরা দেখি কবি তার বাগদত্তা প্রেমিকাকে সরাসরি বলে দিচ্ছেন দেনমোহর দিতে পারবেন না। দেবেন যা তা আমরা সবাই জানি। নানা সম্বোধন ও আপ্তবাক্যে বিভিন্ন রূপ-আকৃতি ধারণ করছে তার ফিঁয়সে : হরিণী, সখি, নারী, পানোখী, কলাবতী, বুনো হংসিনী, অষ্টাদশী, সাপিনী, সুন্দরী, বন্যবালিকা, বধূ, বালা, প্রাণের শর্বরী,পক্ষিনী, পড়শী, একতারা, কাতরা, অবলা, চঞ্চলা, সতী, বেহুলা, কন্যা, মানিনী, শ্যামাঙ্গী, প্রিয়তমা, সাহসিনী, সুকণ্ঠি, মেয়ে, সুশীলা, বিহ্বলা, ভদ্রে, রূপবতী, কপোতী, দেখন হাসি, মহিয়সী, বিবি, বিদ্যুতের ফলক, বানু ইত্যাদি। ‘চলার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ’ দিয়ে কবি তার ফিঁয়সের মান ভাঙান বা প্রেম নিবেদন করেন। আল মাহমুদের কাব্যজগতে আবির্ভাব বিস্ময়কর না হলেও কাব্যক্ষেত্রে দ্রুত স্বকীয়তা অর্জন ও সাফল্য তাঁর কঠোর পরিশ্রমের ফসল। ঢাকা-কলকাতার বহু সাহিত্যপত্রে অবিরাম তাঁর কবিতা প্রকাশিত হতে থাকল। কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকায় ও সিকান্দার আবু জাফরের সমকালে ক্রমাগত কবিতা ছাপা হতে থাকলে তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। বলাবাহুল্য, অতি অল্প সময়ে, লোক লোকান্তর (১৩৭০) ও কালের কলস (১৩৭৩) দু’টি মাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন (১৯৬৮)। উল্লেখ্য, ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে আমৃত্যু (২০০২) অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানের সহানুভূতি ও নৈকট্য তিনি পেয়েছেন। চট্টগ্রামে শুধু কাব্য পাঠের আসর নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পিকনিকে ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানেও আল মাহমুদ থাকতেন তাঁর আমন্ত্রিত অতিথি। সোনালী কাবিন প্রকাশের পর একের পর এক মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে (১৯৭৬), অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না (১৯৮০), বখতিয়ারের ঘোড়া (১৯৮৫) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে। জনপ্রিয়তার জোয়ার দেখে অনেকে অবশ্য বিস্মৃত হন যে, আল মাহমুদ ইতোমধ্যে তিরিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর ও আশির দশকের প্রধান কবিদের চৌহদ্দী অতিক্রম করে নিজস্ব ভুবনে সার্বভৌম কবিরূপে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন। এ সম্পর্কে ইতোমধ্যে অসংখ্য প্রবন্ধ, আলোচনা ও গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো হবে। তাঁর জীবন দর্শন তাঁকে আরো স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়ক হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। উদ্ধৃতি প্রদানের প্রলোভন থেকে রেহাই পেতে চাই আমি, পাঠক স্বতন্ত্রভাবে আল মাহমুদের কবিতা, কবিতা সমগ্র প্রভৃতি গ্রন্থে আকণ্ঠ ডুবে থাকতে পারেন। সংযোগে আমার অভিজ্ঞতায় আমি বুঝতে পারি আল মাহমুদ জীবনকে নিজের জন্য, মানুষের জন্য উপভোগ্য করে তুলতে চেয়েছেন। দেশের এবং বিশ্বের কল্যাণে তাঁর কলমকে অনলস শাণিত ও সতেজ রেখেছেন। তিনি সৌন্দর্যকে আত্মস্থ করতে প্রয়াসী হয়েছেন আবার তাঁর ‘প্রিয় প্রভু’র প্রতি শর্তহীনভাবে সমর্পিত থেকেছেন। এমন বিনয়ী, সাহসী এবং সৎ মানুষ ও কবি একালে দুর্লভ বলে আমার ধারণা। তবে সবচেয়ে বড় কথা- জানি না ‘বেশি দেখার দৈব বিমার থেকে’ কিনা, কবিতা লিখতে লিখতে আল মাহমুদ অনুভব করলেন ভাষার আরেকটি অনুশীলনে তিনি তাঁর মনোমত উপায়ে প্রকৃতি ও মানুষের বিভিন্ন রূপের যথার্থ পরিণতি তুলে ধরতে সক্ষম। সম্ভবত এটি তাঁকে নিয়ে আসে গল্পের ভুবনে। ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘কালো নৌকা’, ‘জলবেশ্যা’ প্রভৃতিতে এ ধরনের অনুভূতির অনুরাগ সৃষ্টি করেছে। তাঁর ছোটগল্পের ভূগোল সুবিস্তৃত। বাংলাদেশ, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন অঞ্চলের প্রকৃতি ও মানুষ নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে, পুরান ঢাকা থেকে রাজধানীর অত্যাধুনিক মানুষের মনন ও অনুভূতি, এমনকি সমুদ্রের আবহও রূপায়িত হয়েছে আল মাহমুদের স্বতন্ত্র মনোভঙ্গি ও দৃষ্টিকোণ থেকে। আমাদের অন্যতম সেরা কথাশিল্পী ও সমালোচক আবু রুশদ তাই তাঁর গল্পের বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়েছেন। কিন্তু কল্পনা রাজ্যের কাজই এরকম যে, একটু এগুলো আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার বাসনা জাগে। তাই শুরু হলো তাঁর উপন্যাস রচনা। দীর্ঘ জীবনের যাপিত দিবস-রজনী-মাস নানা সত্যকে উদ্ভাসিত করে তোলে। কবি অবশ্যই তা উপেক্ষা করতে পারে না। রচিত হয় কাবিলের বোন, উপমহাদেশ প্রভৃতির মতো উপন্যাস। ব্যক্তিগত সমস্যার ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে এসে কবি এক নির্ভেজাল সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন : ‘আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ, এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ, যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।’ (দোয়েল ও দয়িতা) আল মাহমুদকে কেউ কেউ খুব প্রশংসা কিংবা মাত্রাতিরিক্ত নিন্দা করেছেন তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য বা ভূমিকার জন্য। কিন্তু কবি শিল্পীদের মাতৃভূমি প্যারিস গ্রন্থে তিনি সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছেন : ‘আমি তো আগেই বলেছি, আমি রাজনীতিক নই, আমি একজন কবি মাত্র। আর কবিতা হলো জগতের সবচেয়ে সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম।’ (পৃ. ১১) তিনি উদার বিশ্ব দৃষ্টির প্রবক্তা। এবং তাঁর সুস্পষ্ট উচ্চারণ : ‘আমরা মূলত আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী সাংস্কৃতিক পটভূমি প্রতিধ্বনিত করতে চাই- যে ধরনের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি আমাদের বিশ্বাসের অনুকূল। … এখানে বলা উচিত আমি যেখানে যেভাবেই থাকি আমার বিশ্বাসের কথা বলি কবিতায়, অভিভাষণ এবং প্রবন্ধে। আমার মধ্যে কোনো ক্ষুদ্রতা নেই। আমি বিশ্ব বিচরণশীল আধুনিক মানুষ। আমি সবসময়ই চেয়েছি আমাদের তরুণ কবিরা বিচরণশীল আধুনিক কবি প্রতিভার অধিকারী হোক। সঙ্কীর্ণ হৃদয় নিয়ে আদর্শকে, বিশ্বাস-বিভূতিকে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। মানুষকে ভালোবাসতে হয়।’ (সমগ্রন্থ, পৃ. ১২) প্যারিস-ভ্রমণ কবিকে এই ধারণা দিয়েছে- ‘প্যারিস না দেখলে ইউরোপের মর্মমূল স্পর্শ করা যায় না’। তিনি যা বলেননি অথচ জানেন তা হলো : ইউরোপকে না জানলে বিশ্বকে পুরোপুরি বোঝা যাবে না, বিশ্বদর্শনজাত জীবনোপলব্ধি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। অতএব, আল মাহমুদের প্রশংসা করতে হলে তাঁর লেখার অর্থাৎ পদ্য এবং গদ্যের শিল্পমূল্য বিচার করেই তা করতে হবে এবং তাঁর রচনায় ভালো-না-লাগা অংশেরও কারণ নির্ধারণ করতে হবে যথার্থ সমালোচকের দৃষ্টিকোণ থেকে। যেহেতু কবি ও কথাশিল্পীরূপে বর্তমানে তিনি এমন এক প্রাশস্ত্য অর্জন করেছেন, যা তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বিস্তৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তাই সব দিক বিবেচনা করে আমি নিজেকে তাঁর পূর্ণাঙ্গতার অন্যতম সাক্ষ্যদাতা মনে করি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button