স্বাগত হিজরি নববর্ষ

hijriমুহাম্মদ এনামুল হক ছিদ্দিকী: ১৪৩৭ হিজরি সনের বিদায়ের সাথে সাথে কালপরিক্রমায় এলো আরেকটি নতুন বছর। স্বাগত হিজরি নববর্ষ ১৪৩৮। বিশ্বের কোটি মুসলমানের মধ্যে আজ বয়ে যাচ্ছে খুশির আনন্দধারা। বছর ঘুরে ফিরে এসেছে হিজরি সন। বিশ্বের কোটি মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও জীবনধারার সাথে মিশে আছে হিজরি সন। অতীতে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায় নানা উপলক্ষ ঘিরে সন তারিখ গণনার সুবিধার্থে বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করে তা অনুসরণ করে এসেছে। যেমন খ্রিষ্টান সম্প্রদায় তাদের ধর্মগুরু হজরত ঈসা আ:-এর জন্মবার্ষিকীর দিনক্ষণ ধরে ঈসায়ি বা খ্রিষ্টাব্দ সন প্রবর্তন করে এবং নিজেদের জীবনধারায় খ্রিষ্টাব্দ সন মেনে চলে। একইভাবে বঙ্গাব্দ, শকাব্দ, মঘী সনসহ নানা বর্ষপঞ্জি পৃথিবীতে নানা ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে চালু আছে।
মুসলমানেরা ফরজ বিধান পালনে নানা আচার-উৎসব উদ্যাপনের ক্ষেত্রে হিজরি সন তথা চান্দ্র মাসকে অনুসরণ করে থাকে। চাঁদের উদয়ের ভিত্তিতে দিনক্ষণ নির্ধারিত হয় ১০ মহররম আশুরা, ১ মহররম হিজরি নববর্ষ, ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সা:, ১৪ শাবান শবেবরাত ইত্যাদি ইসলামি তাৎপর্যমণ্ডিত দিবস। তাই হিজরি সনের উদ্ভব পটভূমিকা ও এর আবেদন বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ইসলামের সোনালি যুগে আমিরুল মুমেনিন হজরত ওমর ফারুক রা:-এর বিশেষ আগ্রহ ও ভূমিকায় হিজরি সন প্রবর্তিত হয়। খোলাফায়ে রাশেদার শাসনকালে মদিনাকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন হলে অফিসিয়াল তথ্যাদির নথি ও দিনক্ষণের হিসাব রাখতে গিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নররা বিপাকে ও অসুবিধায় পড়েন। যেহেতু তখন ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য কোনো বর্ষপঞ্জি বা একক সন চালু ছিল না। রাষ্ট্রীয় অফিসিয়াল কার্যাদি নির্বিঘ্নে ও যথানিয়মে সম্পন্ন করার প্রয়োজনে নতুন সন প্রবর্তন তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। তারিখ না থাকায় প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে তাদের নানা অসুবিধা হচ্ছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রের কেন্দ্র হতে খলিফা কর্তৃক যেসব নির্দেশনা ও পরামর্শ প্রদান করা হয় তাতে কোনো তারিখ ও সন উল্লেখ না থাকায় সময় ও কাল নির্ধারণে বিঘ্ন ঘটছে। বিভিন্নভাবে এ ধরনের অভিযোগ ও সমস্যার কথা শুনে খলিফা হজরত ওমর রা: শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কেরাম ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যক্তিদের সাথে বিশেষ বৈঠকে মিলিত হন। আলাপ আলোচনায় একটি বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের ওপর সবাই মতৈক্যে পৌঁছালেও কখন থেকে কি নামে বর্ষপঞ্জি করা হবে তা নিয়ে নানা মত ব্যক্ত করেন সাহাবায়ে কেরাম। কেউ বললেন মহানবী সা:-এর জন্ম দিবসের দিন ধরে বর্ষগণনা শুরু করতে, কেউ অভিমত দিলেন প্রিয় নবী সা:-এর নবুয়ত প্রকাশের বছর থেকে, আবার কেউ পরামর্শ দিলেন মহানবী সা:-এর মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরতের দিন থেকে বর্ষগণনা শুরু করা যায়। গণতান্ত্রিক উপায়ে ব্যাপক আলোচনা-পর্যালোচনা এবং যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে অবশেষে মহানবী সা:-এর হিজরতের ঘটনাকে মহিমান্বিত করার জন্য মহররম মাস থেকে হিজরি নামে একটি স্বতন্ত্র সন চালু করার ঘোষণা দেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমেনিন হজরত ওমর ফারুক রা:। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে হিজরি সন মুসলমানদের জীবনধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। হিজরি সন হয়ে উঠেছে তাদের গৌরব ও ঐতিহ্যের প্রতীকরূপে। বাংলা ও খ্রিষ্টীয় সন যেমন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনধারার বড় অনুষঙ্গ, তেমনি হিজরি সনকে আমরা অনুসরণ করে থাকি ইসলামি নানা দিবস ও আচার অনুষ্ঠান পালনের ক্ষেত্রে। অথচ দুঃখজনক যে, বাংলা ও খ্রিষ্টীয় নববর্ষ আমাদের দেশে নানা মহল থেকে বেশ ঘটা করে বড় আয়োজনে পালন করা হলেও হিজরি নববর্ষ উদযাপন করা হচ্ছে না। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম ডিসি হিলে দেশে প্রথমবারের মতো বৃহত্তর আয়োজনে হিজরি নববর্ষ উদযাপন করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ইসলামি ফ্রন্ট। ২০১১ সালে হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ গঠন করে এবারসহ সাত বছর ধরে হিজরি নববর্ষ পালিত হয়ে আসছে।
হিজরি নববর্ষ সবার জীবনে অশেষ শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনুক এই প্রত্যাশা। ১৪৩৮ হিজরি নতুন বছরে সংঘাতমুক্ত শান্তিময় বাসযোগ্য পৃথিবীর স্বপ্ন পূরণ হোক।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব, হিজরি নববর্ষ উদযাপন পরিষদ

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button