ফেসবুকেও শীর্ষে হানিফ সংকেত

সুধাময় সরকার: Hanifসামাজিক যোগাযোগে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকের সেলিব্রেটি মানদণ্ড হলো, ফেসবুক ভেরিফাইড পেজে ভক্তদের লাইক বা পছন্দ সংখ্যা। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে প্রিয় গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, পরিবেশ ও সমাজ উন্নয়নকর্মী হানিফ সংকেত জনপ্রিয়তার দিক থেকে ফেসবুক পেজেও শীর্ষে অবস্থান করছেন। তার ফেসবুক পেজে ভক্তের সংখ্যা এখন ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে হানিফ সংকেতই একমাত্র গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, উপস্থাপক, নির্মাতা ও টিভি সাংবাদিক- যার ফেসবুক পেজে ভক্ত সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি।
একজন হানিফ সংকেত। যিনি গেল ৩৭ বছর ধরে নিরলস প্রয়াস, সততা ও নিষ্ঠা দিয়ে মিডিয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। একাধারে তিনি একজন পরিচালক, উপস্থাপক, নাট্যকার, নির্মাতা, লেখক, নির্দেশক। আপোষহীন, স্পষ্টবাদী ও সমাজ সচেতন মানুষ হিসাবে সবাই তাকে ভালোবাসেন। বাংলাদেশে টিভি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নির্মাণের আইকন তিনি। তেমনি উপস্থাপনায় পুরানো ধারা ভেঙ্গে আধুনিক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তিনি নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন। অনবদ্য প্রতিভা, কর্ম নৈপূণ্য ও সাহসিকতায় তিনি এখন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। তাকে বলা হয় দেশীয় মিডিয়া ম্যাজেশিয়ান।
তার ‌‘ইত্যাদি’ জনপ্রিয়তার দিক থেকে টিভির সর্বকালের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে বিটিভিতে চলছে। ১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে পাক্ষিক হিসাবে যাত্রা শুরু হয় দেশের সবচাইতে দীর্ঘমেয়াদী এই অনুষ্ঠানটির। ১৯৯৪ সালে ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় আরেকটি মাইলফলক। কারণ ১৯৯৪ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে প্যাকেজ অনুষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে অনুষ্ঠানটি। এটাই ছিল বেসরকারীভাবে নির্মিত প্রথম কোনও প্যাকেজ অনুষ্ঠান। তখন একমাত্র বিটিভি ছাড়া কোনও টিভি চ্যানেল ছিল না। তাই বেসরকারীভাবে অনুষ্ঠান নির্মানের পথ প্রদর্শকও বলা যায় ‘ইত্যাদি’ তথা এর জনক হানিফ সংকেতকে।
শুধু তাই নয়, এতগুলো চ্যানেলের ভীড়ে তখন থেকে এখন পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানটি টিভি গাইড ও পত্র পত্রিকার পাঠক জরিপ, বিবিসি জরিপ কিংবা হালের টিআরপি জরিপেও শ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠানের মর্যাদা পেয়ে আসছে নিয়মিত।
কোয়ানটিটি নয়, কোয়ালিটিতে বিশ্বাসী হানিফ সংকেত তার প্রতিটি অনুষ্ঠানের মৌলিকতা, সৃষ্টিশীলতা ও উচ্চমানের কারণেই সাড়া জাগিয়েছেন সব মহলে। নিজেকে জানা, নিজের শেকড় অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে ‘ইত্যাদি’কে স্টুডিওর চারদেয়াল থেকে বের করে নিয়ে এসেছেন দেশের বিভিন্ন সভ্যতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্মৃতিবিজড়িত গৌরবময়স্থানে। সেই সঙ্গে তুলে ধরছেন সেইসব স্থানের কৃষ্টি, সংস্কৃতিসহ গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য।
সামাজিক আন্দোলনেও হানিফ সংকেত এক অনন্য চরিত্র। সমাজের অবক্ষয় চিত্র তুলে ধরছেন নির্ভয়ে। ছুটে বেড়াচ্ছেন গ্রামগঞ্জে সমাজে নিষ্পেষিত বঞ্চিত মানুষের দ্বারে। গ্রামগঞ্জ থেকে তুলে নিয়ে আসছেন অসহায় সুপ্ত প্রতিভা। সেইজন্য শেকড় সন্ধানী ‘ইত্যাদি’র একটি প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হলো প্রতিবেদন। সামাজিক দায়বদ্ধতা, মানবিক অঙ্গীকার ও মূল্যবোধের চেতনা থেকেই ‘ইত্যাদি’তে বিভিন্ন বিষয় ও আঙ্গিকে প্রতিবেদন প্রচার হয়ে আসছে নিয়মিত এবং সমাজে তার একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
‘ইত্যাদি’র প্রতিবেদন যেমন বহুমুখী তেমনি সমাজ সচেতনতায়ও থাকে বহুমাত্রিকতা। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিবেদিত প্রাণ মানুষের অনুসন্ধানে হানিফ সংকেত ছুটে বেড়ান সারাদেশে এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তুলে আনেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রচার বিমুখ অনেক সৎ সাহসী, জনকল্যাণকামী, নিভৃতচারী আলোকিত মানুষদের। যাদের অনেকেই পরবর্তীতে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় সম্মান। প্রতিবন্ধী মানুষদের কর্মমূখর জীবন যাতে কর্মবিমুখ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে সেজন্যে প্রতিবন্ধীদের নিয়েও ‘ইত্যাদি’তে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রচার করে আসছেন হানিফ সংকেত।
প্রতিবেদনের পাশাপাশি ‘ইত্যাদি’ এই দীর্ঘসময়ে নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে তুলেছে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রচার বিমুখ হানিফ সংকেত এর সবটাই করেছেন বিবেকের শুভ প্রেরণায় নিজের দায়বোধ থেকে।
হানিফ সংকেত টেলিভিশনের সর্বাধিক সফল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের পরিকল্পক ও উপস্থাপক। তাকে বলা হয় এ দেশের মৌলিক অনুষ্ঠানের জনক। এনটিভির ‘সময়ের সাথে, আগামীর পথে’, এটিএন বাংলার ‘অবিরাম বাংলার মুখ’-এর মতো শ্লোগান তারই দেয়া।
পৃথিবীর ২২টি দেশে প্রদর্শণের জন্য নেদারল্যান্ডের মার্ক ভারকার্ক ও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হানিফ সংকেত এর যৌথ পরিচালনায় নির্মিত আন্তর্জাতিক প্রামান্য চিত্র ‘ব্রিজিং টু ওয়ার্ল্ডস’ এর জন্য তিনি ব্যাপক প্রশংসিত হন। ‘ইত্যাদি’র গ্রহণযোগ্যতা ও সামাজিক সচেতনতার কারণে পৃথিবীর সবচাইতে জনপ্রিয় ও সম্মানজনক টেলিভিশন চ্যানেল ‘এআরটিই’ টিভিতে পৃথিবীর ৪০টি দেশের জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলোর উপর নির্মিত ‘ওয়ার্ল্ড টিভি’ অনুষ্ঠানের জন্য ‘ইত্যাদি’ ও ‘হানিফ সংকেত’ এর উপর একটি প্রামান্য চিত্র প্রচারিত হয়।
নাট্যকার হিসেবেও হানিফ সংকেত যথেষ্ট দর্শকপ্রিয়তা লাভ করেছেন। তার প্রতিটি নাটকই ঈদের বিশেষ অনুষ্ঠানমালায় প্রচারিত ও প্রশংসিত হয়ে আসছে।
একজন সফল লেখক ও কলামিষ্ট হিসাবেও রয়েছে তার যথেষ্ট সুখ্যাতি। গল্প, উপন্যাস, ছোট গল্প ও রম্য রচনা মিলিয়ে এ পর্যন্ত তার ২৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকাশনী হতে।
দেশের মতো বিদেশেও রয়েছে তার যথেষ্ট সুখ্যাতি। প্রবাসী বাঙালীদের আমন্ত্রণে ১৯৮৩ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত তিনি প্রায় অর্ধশতাধিক দেশ ভ্রমন করেন। সেখান থেকে তুলে ধরেন বাংলাদেশের ঐতিহ্য।
দেশে বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এছাড়াও সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ হানিফ সংকেত ২০১০ সালে পান রাষ্ট্রের মর্যাদাকর ‘একুশে পদক’। পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা ও প্রচার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৪ সালে পরিবেশ শিক্ষা ও প্রচার (ব্যক্তিগত) বিভাগে পান জাতীয় পরিবেশ পদক। এজন্য তাকে বলা হয় ‘সমাজ ও পরিবেশ উন্নয়ন কর্মী’। উল্লেখ্য, ‘দৈনিক প্রথম আলো’ আয়োজিত পাঠক জরিপে তিনি সর্বাধিক ৮বার পুরস্কার পেয়েছেন। পরবর্তীতে নুতনদের উৎসাহিত করার জন্য তিনি তাকে আর পুরস্কার না দেয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানান সংশ্লিষ্টদের। এছাড়াও তিনি দেশ-বিদেশের প্রায় অর্ধশতাধিক পুরস্কার পেয়েছেন।
টেলিভিশনের মূলমন্ত্র অর্থাৎ শিক্ষা, তথ্য, বিনোদন- এই তিনটি বিষয় সবসময়ই খুঁজে পাওয়া যায় তার অনুষ্ঠানে। বিভিন্ন অসংগতি তুলে ধরে সমাজকে পরিশুদ্ধ করতে তিনি যেমন নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন তেমনি আমাদের নাগরিক সচেতনতা এবং কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখতেও ভূমিকা রাখছেন আন্তরিকতার সঙ্গে।
সেই সূত্রে পৃথিবীর অন্যতম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ৩০ লাখেরও বেশি ফলোয়ারের মাইলফলক অর্জন করেছেন খুব সহজেই। হানিফ সংকেত তার এই ভক্তদের উদ্দেশ্যে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘ত্রিশ লক্ষাধিক’ এটি আমাদের কাছে কেবলমাত্র একটি সংখ্যাই নয় বরং ভালোবাসার প্রতিধ্বনির মতো মনে হয়। আসলে আমি ভক্তদের এই ভালোবাসার মূল্যায়ন করি অন্তর দিয়ে, আমার কাজ  কিংবা কথা দিয়ে নয়। আপনাদের মতামত, উৎসাহ, সহযোগিতা, সমর্থন- সর্বোপরি আপনাদের ভালোবাসাকে আমরা যে কী পরিমাণ মূল্যায়ন করি তা আপনারা নিশ্চয়ই ‘ইত্যাদি’ দেখে বুঝতে পারেন। আপনাদের কাছাকাছি আসার জন্য টেলিভিশন অনুষ্ঠানকে স্টুডিওর চার দেয়াল থেকে বের করে এনেছি সেই দুই যুগ আগেই। আপনারা হয়তো লক্ষ করেছেন আমার এই ফেসবুক পেজ থেকে অনুষ্ঠান সম্পর্কিত তথ্য জানানো ছাড়া আত্মপ্রচারমূলক কোনও পোস্ট দেওয়া হয় না। কোনও চ্যানেলে, পত্র-পত্রিকায় আমরা কখনও আত্মপ্রচার করি না। নিজেদের অনুষ্ঠানকে সেরা বলে দাবি করি না। যা বলার আপনারাই বলেন। আমরা সবসময়ই বলি, ‘দর্শকদের রায়ই আমাদের কাছে চুড়ান্ত’। যে কারণে বিগত ২৮টি বছর প্রতিটি ইত্যাদি’ই আমি কোটি কোটি দর্শকের সঙ্গে বসে দেখেছি, পেয়েছি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। সে এক অন্যরকম অনুভূতি।
হানিফ সংকেত আরও বলেন, ‘‘ইত্যাদি’র কোটি কোটি দর্শক ভক্তের প্রতিনিধি হচ্ছেন ফেসবুক পেজের এইসব বন্ধুরা। আমি এবং আমাদের অ্যাডমিন প্যানেল নিয়মিত সবার সব মতামত নিয়ে আলোচনা করি এবং সেই আলোকে নতুন ‘ইত্যাদি’কে নিত্য নুতনভাবে সাজানোর চেষ্টা করি। আপনারা জানেন ‘ইত্যাদি’ শুধুমাত্র কোনও একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী বা পেশার মানুষের জন্য নয়। এটি সব বয়সের, সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য-একটি তথ্য, শিক্ষা ও বিনোদন বিদ্যালয়, যা টেলিভিশনেরও প্রধান মূলমন্ত্র।’’
‘ইত্যাদি’তে প্রচারিত ক’জন গুণী মানুষদের কয়েকটি তথ্য সমৃদ্ধ রিপোর্টিং নিম্নে তুলে ধরা হলো। যে রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে হানিফ সংকেত ও তার ‘ইত্যাদি’ পৌঁছে গেছে শহর থেকে গ্রামে, দেশ থেকে পুরো বিশ্বে।
গহের আলীর তাল সম্রাজ্য
নওগাঁ জেলার ভিমপুর ইউনিয়নের শিকারপুর গ্রামের এক শতোর্ধ বয়সী বৃদ্ধ গহের আলী, সোজা হয়ে চলতে পারেন না, তবু একের পর এক লাগিয়ে চলেছেন তালগাছ। এই বয়সে তার জীবিকা নির্বাহের সুযোগ নেই। তাই সামর্থ্য নেই অন্য ফলজ বা বনজ গাছের চারা কেনার। ফলে চাল-ডালের সঙ্গে তালের আঁটি ভিক্ষা হিসেবে চান তিনি। পুঁতে দেন সরকারি রাস্তার দু’পাশে। এভাবে ১৮ হাজারেরও বেশি তালের গাছ লাগিয়েছেন তিনি। তার লাগানো সেই গাছ আজ সবাইকে ছায়া দিচ্ছে- এতেই তার তৃপ্তি। ৩০ জানুয়ারি ২০০৯ সালে গহের আলীর ওপর একটি প্রতিবেদন প্রচার করে ‘ইত্যাদি’। জীবন সাধনার সামান্য স্বীকৃতি হিসেবে তার হাতে দুই লক্ষ টাকার একটি চেক তুলে দেওয়া হয়। ইত্যাদি’তে প্রচারের পর সেই বছরেরই ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে প্রথমবারের মতো জাতীয় পরিবেশ পদক-২০০৯ প্রদান করা হয় তাকে। গহের আলী পরিবেশ সংরক্ষণ বিভাগে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন। ২৭ ডিসেম্বর ২০১০ সালে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেন।
পলান সরকারের বই পড়ার আন্দোলন
২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রচারিত ‘ইত্যাদি’তে আলোকিত মানুষ হিসাবে তুলে ধরা হয় ৮৬ বছরের বৃদ্ধ বইপ্রেমী পলান সরকারকে। বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য তিনি নিজের টাকায় কেনা বই বিলি করেন সবাইকে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নতুন পাঠকের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন তিনি, পুরানো বই ফেরৎ নিয়ে নতুন বই দিয়ে আসেন। তার এই বইপড়া আন্দোলনে সহযোগিতা করার জন্য ইত্যাদি’র মাধ্যমে তাকে দুই সেলফ ভর্তি বই উপহার দেওয়া হয়েছিল। ইত্যাদি’তে প্রচারের পর তাকে নিয়ে নির্মিত হয় বিজ্ঞাপন, রচিত হয় নাটক, অনুষ্ঠিত হয় ‘পলান মেলা’। ২০১১ সালে তিনি লাভ করেন একুশে পদক। শুধু তাই নয় গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার ওপর বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাই বলা যায় ইত্যাদি’র এই আবিষ্কার পলান সরকার পেয়েছেন বিশ্ব স্বীকৃতি।
ফসলের ডাক্তার এ.কে.এম জাকারিয়া
কৃষি বিজ্ঞানী এ.কে.এম জাকারিয়ার উদ্ভাবন- ‘ফসলের ডাক্তার’। এই ক্ষেত্রে তার অবদানের জন্য পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ‘ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশন অ্যাওয়ার্ড’। তার ওপর নির্মিত হয়েছে প্রমাণ্যচিত্র। বগুড়া জেলার শাহজাহানপুর উপজেলার আমরুল ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম, যেখানে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ‘ফসল ক্লিনিক’। আর এইসব ক্লিনিক পরিচালনা করছেন ঐ গ্রামেরই ক’জন স্বল্প শিক্ষিত নারী। এইসব নারীদের এখন বড় পরিচয় ফসলের ডাক্তার। ফসলের রোগ বালাই চিহ্নিত করে দিচ্ছেন লিখিত ব্যবস্থাপত্র। আর এর জন্য ফি হিসেবে পান নমুনা প্রতি ৫ টাকা। এইসব ব্যবস্থাপত্রে রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। পাশাপাশি এইসব তৈরি ও ব্যবহার পদ্ধতিও শিখিয়ে দেন। তাই তাদের ক্লিনিকগুলি পরিচিতি পেয়েছে কৃষকপ্রিয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সবচেয়ে বড় কথা হল এই ফসল ক্লিনিক যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্লোবাল প্ল্যান্ট ক্লিনিকের স্বীকৃতিও লাভ করেছে।
টিম র‌্যাপচার
পৃথিবীর বড় বড় সমস্যা সমাধানে সারা পৃথিবীর মেধাবী শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে শুরু হয় বিশ্বের সবচাইতে বড় সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট প্রতিযোগিতা ‘মাইক্রোসফট ইমাজিন কাপ’। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশের ১৪০টি দল এতে অংশ নেয়। প্রথমবার অংশগ্রহণ করেই সারা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের ভোটে বাংলাদেশের ‘টিম র‌্যাপচার’ জিতে নেয় ‘পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড’। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন হলিউড অভিনেত্রী ইভা লঙ্গরিয়া। তাদের এই বিজয় বাংলাদেশের নাম পৌঁছে দেয় বিশ্ব দরবারে। টিম র‌্যাপচার এর এই বিজয়গাঁথা নিয়ে ইত্যাদি’তে প্রতিবেদন প্রচার করা হয় ৩০ ডিসেম্বর ২০১১ সালে।
এভারেস্টজয়ী এম.এ মুহিত
এম.এ মুহিত বাঙালীদের মধ্যে প্রথম- যিনি পর পর দু’বার পৃথিবীর সর্বোচ্চশৃঙ্গ এভারেস্ট জয় করেছেন। একবার ২০১১ সালে সবচেয়ে কষ্টসাধ্য নর্থ ফেইস অর্থাৎ তিব্বতের দিক থেকে আর পরের বছরই অর্থাৎ ২০১২ সালে সাউথ ফেইস অর্থাৎ নেপালের দিক থেকে। উল্লেখ্য দ্বিতীয়বারে এভারেস্ট বিজয়ে তার সঙ্গী ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা এভারেস্টজয়ী নিশাত মজুমদার। এভারেস্টে চূড়ায় উঠে ‘ইত্যাদি’ লেখা একটি ব্যানার প্রদর্শন করেছেন তারা এবং পরবর্তীতে ছবিটি ‘ইত্যাদি’ পরিবারকে উপহার দিয়েছেন। ঝুঁকিপূর্ণ একটি অভিযানের মধ্যে থেকেও এভারেস্ট চূড়ায় ‘ইত্যাদি’র ব্যানার প্রদর্শন প্রসঙ্গে মুহিত বলেন, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশের যত টিভি অনুষ্ঠান আছে তার মধ্যে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ইত্যাদি এভারেস্ট চূড়ার মতোই উচ্চতায় পৌঁছেছে। সেই অনুভূতি থেকেই এভারেস্টের চুড়ায় ‘ইত্যাদি’র লোগো নিয়েছি।’
সুপার হিউম্যান ম্যাক ইউরি
১৯৯২ সালের ৬ এপ্রিল প্রথম ‘ইত্যাদি’তে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষক ম্যাক ইউরি’র ওপর একটি প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। যা দেখে সেসময় দর্শকরা বিস্মিত হয়েছিলেন। বিশ বছর আগে ‘ইত্যাদি’তে প্রদর্শিত সেই ইউরিকে আবারও দেখানো হয় গত ৩০ নভেম্বর ২০১২ সালের ‘ইত্যাদি’তে। যিনি শিন কিক অর্থাৎ পায়ের শক্তির জন্য বিশ্ব রেকর্ড করেছেন। তাকে বলা হয় এই গ্রহের সবচাইতে শক্তিশালী পদাঘাতশক্তি সম্পন্ন মানুষ। তাই ডিসকভারি চ্যানেলে প্রদর্শিত পাঁচজন সুপার হিউম্যানদের তালিকায় ইউরিও স্থান করে নিয়েছেন। ইউরি তার অসাধারণ শক্তিসম্পন্ন পায়ের সাহায্যে একবারেই তিনটি বেসবল ব্যাট ভেঙ্গে ফেলেন। যা বিস্মিত করে সবাইকে। পশ্চিমা বিজ্ঞানীরা তাকে আখ্যায়িত করেছেন সুপার হিউম্যান হিসেবে।
গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে আবদুল হালিম
১৯৯৫ সালের ৩১ মার্চ প্রচারিত ইত্যাদি’তে প্রথম তুলে ধরা হয় আবদুল হালিমকে। যিনি তার ফুটবল যাদু দিয়ে বিমোহিত করেছিলেন কোটি কোটি দর্শকদের। শেষ পর্যন্ত হালিম পৌঁছেছিলেন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে। করেছেন বিশ্বজয়। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ তার নাম ওঠে। মাথায় বল রাখা নয়, বল নিয়ে কতটুকু পথ অতিক্রম করতে পারে সেই রেকর্ড করেছেন আবদুল হালিম। ২০১১ সালের ২২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে বল মাথায় নিয়ে ১৫.২ কিলোমিটার পথ হেঁটে অতিক্রম করেন হালিম। আর এর জন্যে তিনি সময় নেন ২ ঘন্টা ৪৯ মিনিট ৫৩ সেকেন্ড।
আহসান রনি ও গ্রিন সেভারস
আমাদের এখন ইট পাথরে ঘেরা যান্ত্রিক নগরীর মানুষগুলো সবুজকে ভালোবেসে বাড়ির ছাদে, বারান্দা, কার্ণিশে গড়ে তুলছেন বাগান। ছাদে বাগান করার এই ধারনাটি যিনি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করে সবাইকে সবুজের প্রতি, সর্বোপরি গাছের প্রতি ভালোবাসায় উদ্বুদ্ধ করেছেন- তিনি হচ্ছেন আহসান রনি ও তার প্রতিষ্ঠান গ্রিন সেভারস। তার এই কার্যক্রমের নাম ‘ছাদ বাগান’ বা ‘ছাদ কৃষি’ কার্যক্রম। রনিই প্রথম নাগরিক জীবনে নগর কৃষির ধারনাটিকে পরিচিত করেন। ‌‌‘ইত্যাদি’ সেই উদ্যোগে সমর্থন দেয়। পরিবেশ রক্ষায় অবদানের জন্য ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। পর পর দুইবার পুরস্কৃত হয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও।
এড্রিক বেকার-ডাক্তার ভাই
টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরগড়ে অবস্থিত ব্যতিক্রমী চিকিৎসাকেন্দ্র কাইলাকুড়ি হেলথ কেয়ার সেন্টারটি যিনি গড়ে তুলেছেন তিনি হচ্ছেন নিউজিল্যান্ডের অধিবাসী ৭৪ বছর বয়স্ক ডাক্তার এড্রিক বেকার। গ্রামের সবার কাছেই যিনি ‘ডাক্তার ভাই’ হিসাবে পরিচিত। আর্তমানবতার সেবায় যারা জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পান এড্রিক বেকার তাদেরই একজন। গত ৩২ বছর ধরে এই ভিনদেশী মানুষটি বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে। গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১১ সালে এড্রিক বেকারের ওপর একটি প্রতিবেদন তুলে ধরা হয় ইত্যাদি’তে। এই অনুষ্ঠানে বেকারকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্যও অনুরোধ জানানো হয়। ইত্যাদি’তে প্রতিবেদনটি প্রচারের পর ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে এড্রিক বেকারকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। এটিও ইত্যাদি’র একটি বড় প্রাপ্তি। ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানের পক্ষ থেকে এড্রিক বেকারের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গরীব ও অসহায় রোগীদের চিকিৎসার সাহাযার্থে দুই লাখ টাকা প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, গত ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালে সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
উপকূলের নেভিগেশন লাইট ‘জয়দেব দত্ত’
এ কথা সবাই জানেন, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ংকরি ঘূর্ণিঝড় সিডর এর আঘাতে দেশের উপকূলীয় এলাকার একটি বড় অংশ বিশেষ করে বরগুনার ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রাণহানি ঘটেছে কয়েক হাজার মানুষের। সেসময় ইত্যাদি’তে তুলে ধরা হয় এমন একজন মানুষকে যিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিডরের সময় মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সিডরের আগাম সংবাদ পৌঁছে দিয়েছেন। আর তিনি হচ্ছেন জয়দেব দত্ত। বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির অধীনে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে কাজ করছেন ৪৮ বছর বয়সের এ মানুষটি। ঘূর্ণিঝড়ের পর উপকূলের হাজার হাজার মানুষের কাছে জয়দেব ছিলেন একটি প্রিয় নাম। স্থানীয়রা তাকে বলেন উপকূলের নেভিগেশন লাইট।
জয়দেবের এই সাহসিকতা এবং মানসিকতার প্রতি সম্মান জানিয়ে তার কাজে সহযোগিতা করার জন্য ইত্যাদি’র পক্ষ থেকে তাকে একটি মোটর সাইকেল উপহার দেওয়া হয়। ইত্যাদি’তে জয়দেব দত্তের এই প্রতিবেদন প্রচারের পর- গত ৮ মে বিশ্ব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট দিবস উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে জয়দেবকে রেড ক্রিসেন্ট অ্যাওয়ার্ড-২০০৮ প্রদান করা হয়।
বিষমুক্ত সবজি ও ইত্যাদি
আমরা জানি আজকাল অনেক পণ্যই আইনসম্মতভাবে বাজারজাত করা হয় না। পণ্যও মান সম্মত না, ভেজালযুক্ত এবং বিষাক্ত হয়। দেশের বিশিষ্ট কৃষিবিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা জানতে পেরেছি সবজি ও ফলের নামে এখন বিষযুক্ত সবজি খাচ্ছি।
একজন কৃষক বলেন- ‘বিষমুক্ত সবজির ব্যাপারে কেউ তাদেরকে অবগত করেনি তাই কীটনাশক প্রয়োগের কতক্ষন পর সবজি তুলতে হবে সে সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই।’
এত নিরাশার মধ্যেও আশার কথা হচ্ছে এখন আর বিষযুক্ত সবজি নয় বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন সম্ভব। গবেষণাগার আর মাঠ পর্যায়ে অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশের ক’জন কৃষি বিজ্ঞানী উদ্ভাবন করেছেন ‘ফেরোমন ট্রাপ’। যা হতাশাগ্রস্থ কৃষকদের সামনে আশার আলো হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মাধ্যমে কীটনাশক ব্যবহার না করে চাষ করা হচ্ছে বিষমুক্ত সবজি।
৩০ মে ২০০৮ সালে ইত্যাদি’র মাধ্যমে প্রথমে এই ফেরোমন ট্রাপের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী ব্যাপকতা লাভ করে এবং কৃষকদের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এবং বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হন।
অস্কারে নাফিজ বিন জাফর
অস্কারের ৮০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাদেশের নাম যুক্ত হওয়া ছিল দেশের জন্য গর্বের, সম্মানের। আর এই দুর্লভ সম্মান বয়ে এনেছে বাংলাদেশী যুবক নাফিজ বিন জাফর। ২০০৮ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি হলিউডের Beverly Wilshire মিলনায়তনে অস্কার কমিটি ১০ জন বিজয়ীকে Scientific and Technical Achievement Awards  প্রদান করে। তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশে রাজবাড়ির তরুণ নাফিজ-বিন-জাফর। ২০০৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ইত্যাদি’তে নাফিজের একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়।
ভেজাল বিরোধী আন্দোলন
দেশে ভেজাল বিরোধী আন্দোলন প্রথম শুরু হয় ‘ইত্যাদি’র মাধ্যমে। আজ থেকে ১০ বছর আগে ২০০৫ সালের জুলাই মাসে প্রচারিত ‘ইত্যাদি’তে ভেজালবিরোধী একটি প্রতিবেদন দেখানো হয়েছিল অর্থাৎ বাজারে যেসব পণ্য পাওয়া যায় তা আইনসম্মতভাবে বাজারজাত করা হয়েছে কিনা, পণ্য মান সম্মত, ভেজালমুক্ত কিম্বা বিষমুক্ত কিনা। সেই থেকে বাংলাদেশে ভেজাল বিরোধী আন্দোলন এবং মোবাইল কোর্ট শুরু হয়।
‘ইত্যাদি’ গত ২৮ বছর ধরে এক নাগাড়ে এই ধরণের তথ্য সমৃদ্ধ টিভি রিপোর্টিং বা টিভি সাংবাদিকতা করে চলেছে। মানুষের কল্যানে, সচেতনতা বৃদ্ধি, নাগরিক অধিকার, সামাজিক মূল্যবোধ এবং মানবিক মূল্যবোধকে সামনে রেখে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button