জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু

Mujibur Rahmanড. এ কে আব্দুল মোমেন: ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন এবং সেই ভাষণে তিনি প্রায় ৫০টি ইস্যু তুলে ধরেন যা এখনো মানবজাতিকে নাড়া দেয় এবং সেই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল প্রতিপাদ্য অতিসুন্দরভাবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন যা এখনো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তিনি উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন Ñ  ‘বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার ওপর ভিত্তি করিয়া জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করিয়াছে’। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের নীতি হচ্ছে ‘সকলের প্রতি বন্ধুত্ব,  কারো প্রতি বিরূপ বা শত্রুতা নেই’ এবং এর ফলে বিশ্বসভায় বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত সম্মানের ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। জাতিসংঘে আমাদের  দৃশ্যত শত্রুদেশ না থাকায় গেল ছয় বছরে আমরা জাতিসংঘের প্রায় ৫২টি কমিটি, কমিশন, ব্যুরো বা নেতৃত্বের আসনে নির্বাচিত হই। বস্তুত কোনো  নির্বাচনেই আমরা পরাজিত হয়নি। এর মূল কারণ বঙ্গবন্ধুর নীতি Ñ আমাদের কোনো চিহ্নিত ‘শত্রুদেশ’ নেই। দ্বিতীয়ত, আমাদের নীতি ও উদ্যোগ ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর এবং তৃতীয়ত, আমরা যে সমস্ত কমিটি, কমিশন ইত্যাদিতে নির্বাচিত হয়েছি সে সমস্ত সংস্থায় আমরা সকলকে সঙ্গে নিয়ে, কার্যকরী বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে সকলের আস্থা ও সম্মান অর্জন করতে পেরেছি। এতগুলো নির্বাচনে জয়লাভ বস্তুত শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি বিশ্ববাসীর আস্থা ও বিশ্বাসের ফলশ্রুতি।
বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘ সনদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান এবং অদ্যাবধি আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে তার কোনো ব্যত্যয় হয়নি। তিনি ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন এবং দ্ব্যর্থভাষায় জাতিসংঘে এর সপক্ষে জয়গান গান। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ বা ‘ন্যাম’ সংস্থার অন্যতম নেতা। এ বছরে এই সম্মেলনের চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ বাংলাদেশ পেয়েও কোনো অজ্ঞাত কারণে তা বিসর্জন দেয়। এ বছর ১৩৩ দেশের সমন্বয়ে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার এশিয়া প্যাসিফিক রাষ্ট্রগুলোর ভাগে আসে এবং বাংলাদেশ এর দায়িত্বভার নেওয়ার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করে। বস্তুতঃ, যখন আমাদের প্রার্থিতা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তখন হঠাৎ করে আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলে থাইল্যান্ডের সামরিক সরকারের ভাগ্য খুলে যায়। তারা চেয়ারম্যান নর্বাচিত হয়।  এখানে উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালে ঢাকায় ন্যাম সম্মেলন করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় এবং কনভেনশন সেন্টারও তৈরি হয়। তবে বিএনপি সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতা দখল করেই তা বাদ দেয়।
বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য,  ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে সংগ্রাম করার দৃঢ় প্রত্যয় শুধু ঘোষণা করেননি, তার সঙ্গে সকল দেশকে একত্রিত হয়ে তা দূর করতে আহ্বান জানান। সুখের বিষয় এই যে, আজ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্য দেশনেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ পরিচালনায় দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে এবং গেল বছরে জাতিসংঘের সকল রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সম্মতিতে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা বিশ্ব থেকে চিরতরে নির্মূল করার জন্যে যে ১৭টি টেকসই লক্ষ্যমাত্রা এবং ১৬৯টি টার্গেট নির্ধারিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এখন অবশ্য এই ‘টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ও টার্গেট অর্জনে’ দেশ জুড়ে সকলকে নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করার সময় এসেছে এবং তা করতে পারলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ অর্জন সম্ভব। তাহলেই রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার স্বপ্ন ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি ‘উন্নত, সমৃদ্ধশালী, শান্তিময়, স্থিতিশীল অর্থনীতি’ — যা যে কোনো উন্নত দেশের সমকক্ষ হবে Ñ তা অর্জন সফল হবে।
বঙ্গবন্ধু সম্মিলিত জাতিসংঘে ‘শান্তি ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার’ জোরালো অঙ্গীকার করেন এবং সুখের বিষয়, আজ জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশ এক নম্বরে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের প্রায় ১,৫৪,০০০ শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়োজিত হন এবং দেশ ও দশের জন্যে তাঁরা সুনাম বইয়ে নিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাপের পদাংক অনুসরণ করে পাক-ভারত উপমহাদেশে ‘শান্তির দূত’ হিসেবে সমধিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণের জন্যে উপমহাদেশে আপস-মীমাংসার পদ্ধতিকে আমরা জোরদার করিয়াছি। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস বাংলাদেশের অভ্যুদয় বস্তুতপক্ষে এই উপমহাদেশের শান্তির কাঠামো এবং স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবদান সৃষ্টি করবে’। তার ভাষণটি প্রফেটিক এ জন্যে যে, আজ শেখ হাসিনার কারণে উপমহাদেশে বাংলাদেশ আপোস, ন্যায়নীতি, পরিপক্বতা ও সমঝোতার পররাষ্ট্রনীতি প্রচলন করেছে। বাংলাদেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের সমঝোতায় কোনো প্রকার যুদ্ধ বা ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া আইনের  মাধ্যমে সমুদ্রসীমার সমস্যা সমাধান করতে পেরেছে। ৬৫ বছরের অমীমাংসিত বেরুবাড়িসহ সীমান্ত ছিটমহলগুলোর হস্তান্তর শান্তিপূর্ণভাবে সম্পূর্ণ করেছে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের মধ্যে ট্রানজিট ও যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উদ্ঘাটিত হচ্ছে। আজ বাংলাদেশ ‘ভারত ও নেপাল’ এবং ‘ভারত ও ভুটানের’ মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব গভীর ও অর্থবহ করার ক্ষেত্রে মডাটেরের ভূমিকা পালন করছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও ভবিতব্য আজ হাড়ে-হাড়ে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ শান্তির অগ্রদূত হিসেবে শুধু ভারত উপমহাদেশে স্বীকৃতি লাভ করেনি, আজ সারা বিশ্বে বাংলাদেশ শান্তির মশাল নিয়ে সুনাম বইয়ে নিয়ে এসেছে এবং বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, সারা বিশ্বে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে সম্মিলিত জাতিসংঘে বাংলাদেশের ‘শান্তির সংস্কৃতি’র প্রস্তাব সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। বাংলাদেশ মনে করে, মানবজাতির মধ্যে বর্ণ-ধর্ম-শ্রেণি-গোত্র ইত্যাদিগত বৈষম্যের কারণে হিংসা-দ্বেষ যা তৈরি হয় তা দূর করে একে অপরের  প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই মানুষে-মানুষে সংঘাত, খুনখারাবি, অশান্তি ও যুদ্ধবিগ্রহ কমানো যেতে পারে Ñ বাংলাদেশ এ ব্যাপারে বিশ্ব নেতা।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জাতিসংঘের ভাষণে নিপীড়িত মানবজাতির স্বপক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন এবং বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত দক্ষিণ  আফ্রিকা এবং  প্যালেস্টাইনি নিপীড়িত জনগণের বৈধ অধিকারের প্রতি সমর্থন জানান। আজো বাংলাদেশ তার নীতিতে অবিচল এবং সোচ্চার।
বঙ্গবন্ধু আণবিক বোমার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন এবং ভারত মহাসাগর ও উপমহাদেশকে ‘শান্তি এলাকা’ হিসেবে ঘোষণার স্বপ্ন দেখেন। তিনি মানুষ-বিধ্বংসী মারণাস্ত্র রোধ করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন। তার পদাংক অনুসরণ করে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতিসংঘের সকল সংস্থায় আণবিক বোমা বন্ধ ও নিশ্চিহ্নকরণ এবং অধিকতর মারণাস্ত্র তৈরি বাবদ খরচ বন্ধ করে তা ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা-রোগ নিরাময়ে এবং উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যয়িত করার জোরালো দাবি জানিয়ে আসছে। ২০১৩ সালে বিশ্বের সমরনায়ক দেশগুলো ১৭৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার শুধু প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করে এবং এর ফলে বিশ্বের প্রতিরক্ষা বৃদ্ধির পরিবর্তে বরং শঙ্কা, অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক অধিকতর বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য যে, বিশ্বের ৪৮টি অতিদরিদ্র এলডিসি রাষ্ট্রগুলোর জন্যে ধনিক দেশগুলো প্রতিবছর মাত্র ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রতিরক্ষা বাবদ খরচের মাত্র শতকরা ২.২৮ ভাগ সাহায্য প্রদান করে থাকে।  ‘টেকসই লক্ষ্যমাত্রা’ অর্জনের জন্যে প্রতিবছর যে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে তার কিছুটা এই প্রতিরক্ষা বাবদ খরচ কমিয়ে মেটানো উচিত বলে বাংলাদেশ মনে করে।
বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা ও সহযোগিতার ওপর জোর দেন। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ তা অর্জনের জন্যে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। দু-তিন বছর ধরে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন বাংলাদেশে ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যা’ বিষয়ক জাতিসংঘের একটি দপ্তর স্থাপনের জন্যে উদ্যোগ নেয়। বস্তুতঃ জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ২০১১ সালে যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন তা পেশ করা হয় এবং মহাসচিব তা বিবেচনা করবেন বলে অঙ্গীকার করেন। এসব আলোচনা যখন চলছিল তখন তুরস্ক জাতিসংঘের এই প্রযুক্তিবিষয়ক দপ্তর তার দেশে স্থাপনের জন্যে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেবে বলে ঘোষণা দেয়। তবে উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি প্রযুক্তিবিষয়ক ডাটা ব্যাংক কোথায় হবে তা সুপারিশ করার জন্যে একটি কমিটি কাজ করছে এবং ওই কমিটিতে একজন বাংলাদেশি চৌকস প্রফেশনালকে মহাসচিব নিয়োগ দিয়েছেন। বাংলাদেশ চেষ্টা করলে সে প্রযুক্তি ব্যাংক বাংলাদেশে স্থাপন করতে পারে। তার গ্রাউন্ড ওয়ার্ক করা আছে। তবে তার জন্যে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ অবস্থা জাতিসংঘে তুলে ধরেন এবং সুখের কথা যে, বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্যে এক নম্বর মডেল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো দূর করার জন্যে সকল রাষ্ট্রের বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন এবং বর্তমানে জাতিসংঘ ‘পার্টনারশিপের’ ওপর জোর দিচ্ছে। তবে পার্টনারশিপের সংখ্যা আরো বিস্তৃত হয়েছে Ñ বর্তমানে সকল স্টেকহোল্ডারস; রাষ্ট্র, সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এনজিও, সিভিল সোসাইটি ইত্যাদির নেতৃত্বের সমন্বয়ে ও যৌথ উদ্যোগের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে খাদ্য উৎপাদন ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ওপর জোর দাবি তুলেন এবং বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি কমানোর তাগিদ দেন। তিনি সকল জাতির ঐক্যের প্রতি জোর দেন এবং সকল জাতির পারস্পরিক স্বনির্ভরতার স্বীকৃতি প্রদানে জোরালো ভূমিকা রাখেন।
বঙ্গবন্ধু প্রত্যেক রাষ্ট্রের সার্বভৌম অধিকারকে নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সুবিধা ভোগের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক দায়িত্বের কথা দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করেন। সম্মিলিত জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সকল ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা, তাদের উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি অত্যন্ত জরুরি এবং তাহা সমগ্র বিশ্বের নরনারীর গভীর আকাক্সক্ষারও প্রতিফলন ঘটাইবে এবং ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত শান্তিই দীর্ঘস্থায়ী হইতে পারে।’ তাঁর বক্তব্য ও উপলব্ধি আজো নীরেট সত্য এবং বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সংঘাত ও যুদ্ধের মূলে রয়েছে অন্যায়, অবিচার ও জোর-দখলের প্রতিবাদ।
বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে তেষট্টি হাজার পাকিস্তানি পরিবারকে পাকিস্তানে নিয়ে তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করার জন্যে দাবি তুলেন এবং সেইসঙ্গে তিনি বলেন ‘আরো একটি জরুরি সমস্যা হইল সাবেক পাকিস্তানের পরিসম্পদ বণ্টন।’ তিনি বলেন, ‘উপমহাদেশের জনগণের কল্যাণের স্বার্থে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে এইসব অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান হইবে, যাহাতে স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া সফল হইতে পারে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখ-তার প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী সকল দেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখিবে।’ আজো বাংলাদেশ তাঁর প্রস্তাবিত পথ নির্দেশনা মেনে চলছে। তবে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিবর্জিত সরকারগুলো ক্ষমতায় থাকায় সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন ও বিহারিদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি চাপা পড়ে থাকে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবারের কল্যাণের জন্যে পর্যাপ্ত জীবনযাত্রার ব্যবস্থা নিশ্চিত করিতে হইবে, আমরা ওই ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন যে, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট শুধুমাত্র শান্তি ও আন্তর্জাতিক সমঝোতার পরিবেশেই সমাধান করা সম্ভব।’ বঙ্গবন্ধুর পদাংক অনুসরণ করে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি বিভিন্ন সংকটে ও সমস্যা সমাধানে ‘মডারেটারের’ ভূমিকা পালন করে ‘অসনধংংধফড়ৎ ড়ভ পড়হংবহংঁং’ বা ‘সম্মতি অর্জনের দূত’ উপাধি অর্জন করেন।
বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে ‘আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, অস্ত্রের ঝংঝনানির বিরুদ্ধে, বেআইনিভাবে ভূখ- দখলের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে, বর্ণবৈষম্যবাদ ও মানবতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে, মানবিক মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে এমনকি অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে সোচ্চার আওয়াজ তুলেন এবং একইসঙ্গে নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়কে সমর্থন দেন Ñ তিনি ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগমুক্ত এক উন্নত বিশ্ব গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে বিশ্বের শুধু নেতৃত্ব নয়, সাধারণ জনগণেরও হৃদয় স্পর্শ করেন। তিনি জাতিসংঘে ঘোষণা করেন, ‘জনাব সভাপতি, মানুষের অজেয় শক্তির প্রতি বিশ্বাস মানুষের অসম্ভবকে জয় করার ক্ষমতা এবং অজেয়কে জয় করার শক্তির প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখিয়া আমি আমার বক্তৃতা শেষ করিতে চাই। আমাদের মতো যেই সব দেশ সংগ্রাম ও আত্মদানের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, এই বিশ্বাস তাদের দৃঢ়। আমরা দুঃখ ভোগ করিতে পারি, কিন্তু মরিব না। টিকিয়া থাকার চেলেঞ্জ মোকাবিলা করিতে জনগণের দৃঢ়তাই চরম শক্তি। আমাদের লক্ষ্য স্বনির্ভরতা। আমাদের পথ হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যার শরিকানা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হ্রাস করিবে এবং আমাদের কর্মকা-কেও সহজতর করিবে ইহাতে কোনো সন্দেহ নেই। নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটিতেছে। আমাদের নিজেদের শক্তির উপর আমাদের বিশ্বাস রাখিতে হইবে। আর লক্ষ্য পূরণ এবং সুন্দর ভাবীকালের জন্যে আমাদের নিজেদেরকে গড়িয়া তুলিবার জন্যে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই আমরা আগাইয়া যাইব।’ বঙ্গবন্ধুর কন্যার কণ্ঠে আমরা একি প্রত্যয়ের প্রতিফলন দেখি।
বঙ্গবন্ধুর আত্মবিশ্বাস এবং মানবের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস ও সৃজনীশক্তির ওপর দৃঢ়চিত্ততা সম্মিলিত জাতিসংঘের ভাবাদর্শকে প্রভাবিত করে এবং এর ফলে বর্তমানে জাতিসংঘ সর্বক্ষণ সবার অংশগ্রহণের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে ‘বাংলা ভাষায়’ তাঁর ভাষণ প্রদান করে দেশের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিশ্বসভায় সম্মানিত করেন এবং তাঁরই পদাংক অনুসরণ করে তাঁরই কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা পরপর ছয়বার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে সবাইকে চমকিত করেন। বঙ্গবন্ধু একবার মাত্র জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে তিনি তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির যে নীলনকশা ও দিকনির্দেশনা দিয়ে গেলেন তা আজো আমাদের আলোর দিশারি। মানবজাতির কঠিন সমস্যাগুলো যা তিনি তাঁর ভাষণে তুলে ধরেন সেগুলো আজো বিশ্ববাসীর জীবনকে করে তুলেছে সংকটময় এবং বিপদসংকুল। বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘে ভাষণ তাই এক অনন্য ভাষণ এর ব্যাপ্তি, এর অ্যাপিল, এর আহ্বান আজো অবাক হওয়ার।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু
-অধ্যাপক ড. এ কে আব্দুল মোমেন, রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি। লেখাটি রচিত হয় আগস্ট ৩, ২০১৬

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button