বাংলাদেশে মাদকাসক্ত ৬৫ লক্ষাধিক

সাদেকুর রহমান: ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশে মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় আড়াই লাখ। যদিও মাদক গ্রহণকারীদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য নেই। তবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা মতে, বর্তমানে এ সংখ্যা ৬৫ লক্ষাধিক। মাদকাসক্তদের মধ্যে আবার শিশু-কিশোর ও নারীর সংখ্যা বেশ উদ্বেগজনক। নারী মাদকাসক্তদের মধ্যে ৪৩ শতাংশই ইয়াবাসেবী। এদিকে, মাদক পাচারের বদৌলতে প্রতিবছর বিদেশে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা।
এমন বাস্তবতায় অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ ২৬ জুন রোববার মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করতে ১৯৮৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় দিনটিকে মাদকবিরোধী আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্রথমে শুনুন’। এ উপলক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। দিবসটি পালনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচি নিয়েছে।
বাংলাদেশে মাদকদ্রব্য উৎপাদিত না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সব ধরনের স্মাগলিং এবং মাদকদ্রব্য পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের (এফএইচআই) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের সংখ্যা অর্ধকোটিরও অনেক বেশি। তাদের সমীক্ষা মতে, মাদক গ্রহণকারীদের ১৫ শতাংশের বয়স ২০-এর নিচে, ৬৬ শতাংশ ২০-৩০ বছরের মধ্যে, ১৬ শতাংশ ৩০-৪০ বছর এবং ৪ শতাংশ ৪০ থেকে তদূর্ধ্ব বয়সের। এফএইচআই’র পৃথক পরিসংখ্যান সূত্রে জানা যায়, দেশে সুঁই-সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এ মাদকাসক্তরা শিরায় মাদক গ্রহণ কারায় এইচআইভি ঝুঁকির মধ্যে বেশি থাকে।
নারী মাদকাসক্তদের ৪৩% ইয়াবাসেবী : নারী মাদকাসক্তদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ ইয়াবা সেবন করেন। যাদের বেশির ভাগই পারিবারিক কলহ ও বন্ধুদের প্ররোচণায় নেশায় আসক্ত হন। অন্যদিকে পুরুষ মাদকাসক্তদের মধ্যে ৪১ শতাংশ ইয়াবা সেবী। এদের বেশি ভাগ নিজের আগ্রহ ও বন্ধুদের প্ররোচণায় মাদকসেবন করেন।
নারী মাদকাসক্তদের মধ্যে পারিবারিক কলহের কারণে ৩৭ শতাংশ, বন্ধুদের প্ররোচনায় ৩৩ শতাংশ মাদকগ্রহণ শুরু করেন। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশ নানা কারণে মাদকাসক্ত হন। এদের মধ্যে বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্কীয় অভিজ্ঞতা রয়েছে ২৯ শতাংশের এবং একাধিক যৌন সঙ্গী আছে ২৩ শতাংশ নারী মাদকাসক্তের।
অন্যদিকে পুরুষ মাদকাসক্তদের মধ্যে ৪১ শতাংশ ইয়াবা ও ৩৮ শতাংশ গাঁজা সেবন করেন। এছাড়া ৭ শতাংশ হেরোইন, ৫ শতাংশ ইনজেকশন ও বাকিরা অন্য মাদক সেবন করেন। এদের মধ্যে নিজ আগ্রহে ৪২ শতাংশ, বন্ধুদের প্ররোচনায় ৩৭ শতাংশ মাদক গ্রহণ শুরু করেন। অবশিষ্টরা পারিবারিক কলহসহ অন্য কারণে মাদকসক্ত হন। পুরুষ মাদকসেবীদের মধ্যে বিবাহের আগে যৌন সম্পর্কীয় অভিজ্ঞতা নিয়েছেন ৫৩ শতাংশ, একাধিক যৌন সঙ্গী রয়েছে ৩৩ শতাংশের। এদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ কখনো না কখনো গ্রেফতার হয়েছেন।
চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা : আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধ মাদক আমদানির জন্য প্রতি বছর ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি দেশি মুদ্রা পাচার হচ্ছে। কিন্তু ফ্যামেলি হেলথ ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যানে বলা হয়, প্রতি বছর ভারত থেকে প্রায় ৩৪৭ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরণের মাদকদ্রব্য দেশে আসে। এরমধ্যে শুধু ফেন্সিডিলই আসে ২২০ কোটি টাকার। শতকরা ৬০ ভাগ মাদকাসক্ত মাদকের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে।
৩২ ধরনের মাদক ব্যবহার : দেশে বর্তমানে ৩২ ধরনের মাদক সেবন চলছে। এ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নামের যেসব মাদক উদ্ধার হয়েছে সেগুলো হচ্ছে হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ, দেশি মদ, বিদেশি মদ, বিয়ার, রেক্টিফাইড স্পিরিট, কেডিন, ফেনসিডিল, তাড়ি, প্যাথেডিন, টিডি জেসিক, ভাং, কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড, ওয়াশ (জাওয়া), বনোজেসিক ইনজেকশন (বুপ্রেনরফিন), টেরাহাইড্রোবানাবিল, এক্সএলমুগের, মরফিন, ইয়াবা, আইসপিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট, মিথাইল, ইথানল ও কিটোন। এ ছাড়া ইনোকটিন, সিডাক্সিনসহ বিভিন্ন ঘুমের ট্যাবলেট, জামবাকসহ ব্যথানাশক ওষুধ কিংবা টিকটিকির লেজ পুড়িয়ে কেউ কেউ নেশা করে থাকে। এসব দ্রব্যের নেশাজনিত চাহিদা থাকায় বেশিরভাগই ভেজাল উৎপাদিত হচ্ছে দেশেই।
বিশেষজ্ঞের অভিমত : ইয়াবাসহ সকল মাদক প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগের উপর গুরুত্ব দিয়ে মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা ‘মানস’ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বলেন, ইয়াবা একটি মারাত্মক নেশা যা সেবনের ফলে মনুষ্যত্ব লোপ পায়। ফলে যে কোন ধরণের কাজ করতে পারে। যা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।
কোমলমতি শিশু-কিশোরদের সুন্দর শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে মাদকের বিষাক্ত থাবায়। তারা ধীরে ধীরে দুর্ধর্ষ অপরাধীতে পরিণত হচ্ছে। জেলা শহর-শহরতলী এমনকি গ্রামগঞ্জেও দ্রুত বেড়ে চলছে মাদকাসক্ত শিশু-কিশোর। শুধু গাঁজা নয় এইসব শিশুরা বর্তমানে ড্যান্ডিতেও আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে বস্তি এলাকার শিশু-কিশোরদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা: মোহিত কামাল বলেন, সন্তানের প্রতি পারিবারিক অবহেলা আর শিক্ষার যথোপযুক্ত পরিবেশের অভাবে শিশুদের জন্য মাদক ভয়ঙ্কর সমস্যা হয়ে উঠছে। পরিবারিক ও সামাজিক পরিবেশের কারণে মধ্যবিত্ত ও উচ্চচিত্ত পরিবারের কিশোররাও মাদকাসক্ত হচ্ছে। তারা মাদকদ্রব্য হিসেবে সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করছে ইয়াবা ট্যাবলেট।
‘অনেক পুলিশ মাদক ব্যবসায় জড়িত, সেবনও করেন’ : এদিকে, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, কতিপয় সদস্যদের জন্য পুলিশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে। দেখা যায় অনেক পুলিশ সদস্য মাদকের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারা অনেকে মাদক সেবন করে। ইতিমধ্যে দু’চারজন ধরাও পড়েছে, চাকরিও চলে গেছে এবং মামলার আসামী হয়েছে। ওই সমস্ত সদস্যদের জন্য পুলিশের সমস্ত অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান তিনি। সম্প্রতি মানিকগঞ্জ পুলিশ লাইন্সে বিশেষ কল্যাণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমানের সভাপতিত্বে এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হাসানসহ অন্যরা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button