ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ স্থাপত্যবিদ জাহা হাদিদ

Zahaজাফর ইকবাল: জাহা হাদিদ। বিশ্বের স্থাপত্যশৈলীতে ইরাকি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ স্থাপত্যবিদ হিসেবে খুব পরিচিত নাম এটি। হাদিদকে বর্তমান দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ নারী স্থাপত্যবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাকে বলা হয় ‘বাঁকের রানী’। তার নকশার বিশেষত্বের কারণেই এমন উপাধি পেয়েছেন। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীকে প্রতিষ্ঠা করার পেছনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
হাদিদ প্রথম নারী এবং মুসলিম হিসেবে স্থাপত্যশিল্পের সর্বোচ্চ সম্মান প্রিটজকার পুরস্কার পেয়েছেন। হাদিদকে গত কয়েক দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী স্থাপত্যবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একজন নারী স্থাপত্যবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতেও লড়তে হয়েছে তাকে। দৃঢ় ও নির্ভীক চিত্তে কাজ করেই প্রথম নারী হিসেবে দুনিয়ার অনেক স্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। হাদিদ দুনিয়ার খ্যাতনামা স্থাপত্যবিদদের গোত্র বলে পরিচিত স্টারর্কিটেক্ট’র একমাত্র নারী সদস্য ছিলেন। স্থাপনার নকশায় দুনিয়াজুড়ে দারুণ প্রশংসিত ও বিখ্যাত জাহা হাদিদের উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ হচ্ছে-  জার্মানির ভাইল আম রাইনের ভিটরা ফায়ার স্টেশন, স্ট্রাসবুর্গের রেলস্টেশন, ইন্সব্রুকে রেস্টুরেন্টসহ স্কি জাম্প স্টেশন, সিনসিনাটির লোয়েস অ্যান্ড রিচার্ড রোজেনথাল সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি আর্ট, জার্মানির ভুলফসবুর্গের ফেনো সায়েন্স সেন্টার, লাইপজিগে বিএমডব্লিউ প্লান্ট সেন্ট্রাল বিল্ডিং, রোমের ন্যাশনাল মিউজিয়াম ফর টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি আর্টস, চীনের গুয়াংঝোউ অপেরা হাউজ, লন্ডন অ্যাকুয়াটিকস সেন্টার।
হাদিদের কাজের মাত্রার পরিধি অবাক করার মতো। তিনি আসবাব, জুতার মতো ছোটখাটো জিনিস থেকে জাদুঘর, স্টেডিয়াম, রেলস্টেশনের মতো বড় স্থাপনার নকশাও করেছেন। ২০০৫ সালে তিনি একটি অ্যাকুয়া টেবিলের নকশা করেছিলেন, যেটি ২ লাখ ডলারে বিক্রি হয়েছিল। টেবিলটি দেখতে তারই নকশা করা লন্ডনের অ্যাকুয়াটিকস সেন্টারের ছাদের মতো। হাদিদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট স্টাইল নেই। তার একটি কাজের সঙ্গে অন্যটির সাদৃশ্য পাওয়া যাবে না। তবে তার সব কাজেই আধুনিক স্নিগ্ধতার দেখা মেলে। তবে ব্যবহৃত উপকরণ (কাচ, স্টিল, কংক্রিট), সরলরেখা (আরবীয় নকশার করিডোর, ছাদের ভার রক্ষায় ব্যবহৃত জেড-আকারের কোণ), স্থাপনা (স্তম্ভহীন স্পেস), ভাস্কর্যসদৃশ ইন্টেরিয়র ও ভবনের সামঞ্জস্যহীন সম্মুখভাগ এসব থিমের ব্যবহারে হাদিদের কাজের নিশানা খুঁজে পাওয়া যায়। হাদিদ তার সব কাজেই চলাচল ও গতির প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন, মানুষ কীভাবে ভবনের মধ্য দিয়ে চলাফেরা করবে এবং চোখের দৃষ্টি কীভাবে ভবনের আলো-আঁধারির মধ্যে দেখবে। আগেভাগে ঠিক করে রাখা নকশার চেয়ে ভবনের ভেতরের ও বাইরের চলাচলের পথের ওপর ভিত্তি করে তিনি বহির্ভাগের নকশা করতেন।
১১-১২ বছর বয়স থেকেই হাদিদ স্থির করেছিলেন যে, তিনি স্থপতি হবেন। কেমব্রিজে পড়তে তিনি আগ্রহী হননি। তার বদলে ১৯৬৮ সালে বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে গণিতে ভর্তি হোন। ১৯৭২ সালে হাদিদ লন্ডনে চলে যান। সেখানে তিনি ভর্তি হোন আর্কিটেকচারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেকচারে। আর্কিটেকচারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেকচার থেকে ১৯৭৭ সালে হাদিদের পড়াশোনা শেষ হয়। এর পর তার জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজটি শুরু হয় ১৯৯৭ সালে সিনসিনাটির সেন্টার ফর কনটেমপোরারি আর্টে। মাঝখানে ২০ বছরের দীর্ঘ সময়কালে হাদিদ একটিমাত্র কাজ করেছেন জার্মানির ভাইল আম রাইনের ভিটরা ফায়ার স্টেশন (১৯৯৪)। এটা পরবর্তীতে জাদুঘরে রূপান্তর হয়েছে। ওই একটি কাজের আগেই তিনি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। মূলত তার ব্যক্তিত্ব আর সেই একটি ভবনের নকশার জন্য যেটি কখনই নির্মাণ হয়নি। এ ২০ বছর সময়কালে তিনি হার্ভার্ড ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিয়েছেন। আর্কিটেকচারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেকচার থেকে পাস করার পরবর্তী প্রথম ১০ বছর তিনি এ প্রতিষ্ঠানেই পড়িয়েছেন এবং একটি স্টুডিও পরিচালনা করেছেন। ১৯৯২ সালে নিউইয়র্কে গাগেনহাইম জাদুঘরে একটি রুশ প্রদর্শনীর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি হংকংয়ে পিক প্রজেক্ট নামে একটি প্রতিযোগিতায় জয়ী হন। কিন্তু ডেভেলপার কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় নকশাটি আর বাস্তবায়ন হয়নি। এ নকশার মাধ্যমে অনেকের কাছে তিনি কাগজ কলমের আর্কিটেক্ট থেকে কর্মক্ষেত্রের স্থাপত্যবিদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
প্রাথমিক বছরগুলোয় হাদিদ কেনসিংটনে নিজের ছোট বাসায় একা একাই কাজ করতেন।মাঝেমধ্যে সহকারী নিযুক্ত করতেন, যার বেশির ভাগই ছিল আর্কিটেকচারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেকচারের শিক্ষার্থী। হাদিদ প্রায়ই সারা রাত জেগে কাজ করতেন। ১৯৯৪ সালে হাদিদ কার্ডিফ বে অপেরা হাউজের নকশা তৈরির প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। ২৬৯টি নকশার মধ্যে হাদিদের নকশাটি নির্বাচিত হয়। কিন্তু আধুনিক ও নতুন ধরনের স্থাপত্য নকশার বিরোধিতাকারীদের কারণে হাদিদের নকশায় অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যায়। বড় আকারের ভবনের প্রতি রক্ষণশীল স্থাপত্যবিদদের বিরোধিতার একটি প্রতীক হয়ে ওঠেন হাদিদ। কার্ডিফ বে অপেরার প্রকল্প ভেস্তে যাওয়ার ঘটনাটি হাদিদকে মানসিকভাবে আক্রান্ত করে, যা তিনি কখনই মন থেকে মুছে ফেলতে পারেননি। আর তাই শুধু ২০১২ সালে অলিম্পিকের জন্য অ্যাকুয়াটিক সেন্টার ছাড়া ইংল্যান্ডে তেমন কোনো কাজ করেননি। প্রকৃতপক্ষে ইংল্যান্ডের করপোরেট হাউজগুলো হাদিদকে এক রকম বয়কট করেছিল। কয়েক বছর আগে লন্ডনের একটা ডেভেলপার কোম্পানি হাদিদকে জানিয়েছিল যে, তারা হাদিদের নকশা বুঝতে পারে না। এ প্রসঙ্গে হাদিদ বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয়, তারা একজন দৃঢ় নারীকে সহ্য করতে পারে না।’ কার্ডিফ বিপর্যয়ের পরবর্তী তিন বছরে হাদিদ পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতায় জয়ী হন এবং তার সে নকশাগুলো বাস্তবায়ন হয়।
১৯৯০ সালে কম্পিউটার মডেলিং সফটওয়্যার হাদিদের অফিসে পৌঁছে। শুরুর দিকে হাদিদ কম্পিউটারে কাজ করা পছন্দ করতেন না। মাউসকে তিনি এক রকম ঘৃণা করতেন। কিন্তু কম্পিউটারে ত্রিমাত্রিক নকশার সুবিধা তাকে আকৃষ্ট করে। কম্পিউটারে কাজ শুরুর পর হাদিদের নকশায় একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। তীক্ষ্ণ কোণগুলো বায়োমরফিক আকার ধারণ করে। হাদিদের নকশা কিংবা রূপকল্পকে বাস্তবায়ন করাটা প্রকৌশলীদের জন্য সবসময়ই একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। হাদিদের ইংল্যান্ডে আবাস গড়ার (১৯৮৯ সালে তিনি ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পান) একটা প্রধান কারণ ছিল দেশটির প্রকৌশলীদের উঁচু দরের দক্ষতা। লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত তার জাহা হাদিদ আর্কিটেকটসে বর্তমানে ৩০০-এর বেশিকর্মী কাজ করছেন। বিশ্ববরেণ্য স্থাপত্যবিদ জাহা হাদিদ মাত্র ৬৫ বছর বয়সে গত ৩১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামির একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button