বিয়ে শাদি পরিবার

Islamশাহ নজরুল ইসলাম: বিয়ে শাদি কোন খেল-তামাশা নয়। এটা মহান আল্লাহর নিদর্শনাবলীর বহি:প্রকাশ। কুরআন মাজীদে মহান আল্লাহ বলছেন-‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংগিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।’ (সূরা রূম : ২১) এই আয়াতটিতে মহান আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অতুলনীয়, সংক্ষিপ্ত এবং সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দিয়ে এই সম্পর্ককে তাঁর একটি নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন। এই পবিত্র সম্পর্ক সম্বন্ধে মহান আল্লাহ্ কি বলেছেন তা দেখা যাক। ‘যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক’ যে কেউ তার ভালবাসার ব্যক্তির সাথে থাকার সময় প্রশান্তির এই অনুভূতি তীব্রভাবে অনুভব করে। আনন্দ, সন্তুষ্টি আর প্রশান্তির এই অনুভূতি স্বামী-স্ত্রীর প্রতি ভালবাসাকে আরো তীব্র ও গাঢ় করে তোলে। আর এই প্রশান্তি এগিয়ে নিয়ে যায় সম্পর্কের দ্বিতীয় ধাপের দিকে। দ্বিতীয় পর্যায়টি বর্ণনা করেন মহান আল্লাহ এভাবে : ‘তিনি তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন পারস্পরিক সম্প্রীতি (ভালোবাসা)’ যাতে একে অপরের সাথে থাকার সময় প্রশান্তি অনুভব করে, তার প্রতি আবেগের উচ্ছ্বাস অনুভব করে। এভাবে স্বামী স্ত্রীর এই যাত্রা যতই এগিয়ে যেতে থাকে আবেগের উচ্ছ্বাস ক্রমশ কমতে থাকে। দুজনেই আরো পরিণত হয় এবং তাদের কল্পনার স্বপ্নগুলো ফিকে হতে শুরু করে। এই পথচলায় অনিবার্যভাবেই কিছু বাধা-বিপত্তি আসে। প্রথম দিকে উভয়েই আবেগে অন্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে একে অপরের দোষ-ত্রুটিগুলো খুঁজে পেতে শুরু করে।
মহান আল্লাহ এই ধাপের সমাধান দিয়ে বলেন- ‘এবং তিনি তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন দয়া’ সময়ের পরিক্রমায় আবেগের উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়তে শুরু করেছে এটা-সেটা নিয়ে খুনসুটি আর ঝগড়ার কারণে আগের সেই অখ- প্রশান্তি ও হয়ত সবসময় থাকেনা তাই মহান আল্লাহ্ বললেন যে তিনি উভয়ের হৃদয়ে দিয়েছেন একে অপরের জন্য ‘রাহমত’ বা দয়া। যাতে করে মান-অভিমানে জড়িয়ে পড়লেও তারা যেন একে অপরকে গভীর মমতায় ক্ষমা করে দিতে পারে। এই ‘রাহমা’ ই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যায় কারণ যত কিছুই হোক না কেন বুকের গভীরে আমরা কখনোই চাইনা আমাদের ভালবাসার মানুষটা কষ্ট পাক। আয়াতের শেষে মহান আল্লাহ বলেছেন- ‘নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।’ মহান আল্লাহর এই সুন্দর নিদর্শন নিয়ে আমরা কোন দিন চিন্তা করেছি কি? জীবনান্দ দাস তাঁর এক কবিতায় বিয়েকে বোধের জন্ম বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন-
আলো-অন্ধকারে যাই-মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়-ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে
সে আমার হাত রাখে হাতে;
বিয়ে বরের মাঝে এক নবতর বোধ জন্ম দেয়। এই বোধ তাকে কেবল তার নববধুর প্রতিই দায়িত্বশীল করে না বরং তাকে তার পরিবার সমাজ ও দেশের প্রতিও দায়িত্ববান করে তুলে। দায়িত্বের প্রতি উদাসিনতা দূর করে। এজন্য হাদীস শরীফে বিয়েকে ঈমানের অর্ধেক বলা হয়েছে। অলসতা অবসাদ দূর হয়ে একজন দায়িত্বশীল পুরুষ হিসেবে প্রতিটি স্বামীর আভির্ভাব আমাদের কাম্য।
মানুষ মহান আল্লাহর সেরা সৃষ্টি। পৃথিবীতে মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছে পারিবারিকভাবে। পৃথিবীর প্রথম পরিবার আদম ও হাওয়ার পরিবার। প্রথম মানুষ ও প্রথম পুরুষ আদম আ.। দ্বিতীয় মানুষ ও প্রথম স্ত্রী হাওয়া আ.। তাঁরাই প্রথম স্বামী ও স্ত্রী, প্রথম পরিবার। তাঁদের দু’জনেরই বংশধর পৃথিবীর তাবৎ মানুষ। পরিবার হচ্ছে মানুষের মূল এবং ক্ষুদ্রতম ইউনিট। পরিবার গঠিত হয় বিয়ে-শাদির মাধ্যমে। বৈধ পরিবার গঠনে বিয়ে-শাদির কোন বিকল্প নেই। সকল ধর্মে বিয়ে-শাদিই হচ্ছে পরিবার গঠনের একমাত্র ব্যবস্থা। আজকের প্রবন্ধে বিয়ে-শাদি পরিবার নিয়ে যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করা হলো।
বিয়ের সংজ্ঞা : ইসলামে বিয়ে হচ্ছে একটি সামাজিক ও ধর্মীয় পবিত্র চুক্তি, যে চুক্তি বলে একজন নারী ও পুরুষ দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করে, তাদের পরস্পরের প্রতি পরস্পরের নির্ধারিত দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপিত হয় এবং সমাজে তারা স্বামী ও স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি ও পরিচিতি লাভ করে।
বিয়ে উদ্দেশ্য : পবিত্র দাম্পত্য জীবন যাপন করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
বিয়ে লক্ষ্য : বিয়ের লক্ষ্য চারটি ১. নৈতিক চরিত্র সংরক্ষণ করা। ২. প্রশান্তি লাভ করা। ৩. ভালোবাসার আদান প্রদান। ৪. বংশধারা বজায় রাখা।
বিয়ে রুকন : বিয়ের রুকন দুটি। ১. ইজাব ২. কবূল। ইজাব বলা হয় বিয়ের প্রস্তাবকে এবং কবূল বলা হয় বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করাকে। ইজাব নারী পুরুষ এর যে কোন পক্ষ থেকে হতে পারে। তেমনি কবূল ও উভয়ের যে কোন পক্ষ থেকে হতে পারে। এছাড়া তাদের নিয়োজিত উকিলের পক্ষ থেকেও হতে পারে।
বিয়ের শর্ত : বিয়ের শর্ত দুটি ১. দু’জন পুরুষ সাক্ষি বা একজন পুরুষ ও দুজন নারী সাক্ষি থাকতে হবে। ২. মহরানা দিতে হবে।
কোন প্রকার হারাম সম্পর্ক নয়, কোন প্রকার হারাম দৃষ্টি বিনিময় নয়, কোন প্রকার হারাম যোগাযোগ নয় বরং চলমান সমাজের এসব কলুষতাকে এড়িয়ে এক পবিত্র সম্পর্কে দু’জনার আবদ্ধ হওয়ার প্রতিটি মূহুর্ত যেন ইবাদাত হয় সেই জন্য দু‘আ করা দরকার। মহান আল্লাহর দেওয়া প্রশান্তি আর ভালোবাসা অর্জনের অভিপ্রায় বুকে নিয়ে ক্রমাগত চাইতে থাকা উচিত। চাওয়ার আবেগ আর তীব্রতা বেশি থাকলে কেঁদে কেঁদে জায়নামাজ ভিজিয়ে ফেলা চাই। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ সমস্ত দু’আ শুনেন।
বিয়ে একটি সামাজিক পবিত্র ও ধর্মীয় বন্ধন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যেক ধর্মেই বিয়ের অপরিহার্য। কোন ধর্মেই বিয়ে বিহীন সহবস্থান গ্রহণ করে না, সভ্য সমাজে বিয়ে বিহীন জোটিকে অন্য নজরে দেখা হয়। ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
মানুষ সমাজে একে অন্যের সাহচর্য নিয়ে বসবাস করে থাকে। পরিবার ও সমাজ ছাডা নিজে একাকী বসবাস কষ্টকর ও বলতে গেলে অসম্ভব। ছোট থেকে যুব ও পরিণত বয়সে সুখ-দুঃখ, মায়া-মমতা, সেবা-শুশ্রুষাসহ সব কার্যক্রম পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের মধ্য দিয়ে হয়ে থাকে। সুশৃঙ্খল ও স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহের জন্য প্রয়োজন পবিত্র ও সুসভ্য সামাজিক ব্যবসস্থা। যে ব্যবসস্থার মধ্যে থাকা চাই পরিপূর্ণ ও সব পর্যায়ে মঙ্গলজনক নির্দেশনা। আর এ নির্দেশনা পাওয়া যায় ইসলামে। তাই ইসলাম পৃথিবীর একমাত্র পরিপূর্ণ জীবনব্যবসস্থা।
ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে সুন্দর ও পবিত্র জীবনযাপনের জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওযার ব্যবসস্থা করেছে। বল্গাহীন স্বেচ্ছাচারী জীবনের উচ্ছৃঙ্খলতামুক্ত ও নোংরামির অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির মায়া-মমতার বন্ধনে আবদ্ধিত জীবনের সন্ধান দিয়েছে। নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিবাহ হচ্ছে একমাত্র বৈধ উপায় এবং মানুষের চরিত্র ও সতীত্বকে রক্ষার হাতিয়ার। বিয়ের মাধ্যমে পারিবারিক জীবনে সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং পরস্পরের মধ্যে অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের অপরিহার্যতা আরোপিত হয়।
মুসলিম আইন উৎসের দিক থেকে কুরআন, হাদীস, ইজমা, কিয়াসের উপর নির্ভরশীল। শরীয়া আইন থেকেই বিয়ে সংক্রান্ত বিধানসমূহ অনুসৃত হয়ে থাকে। ইসলামে বিয়ের একটি আইনগত, সামাজিক ও ধর্মীয় মর্যাদা রয়েছে। ছেলে ও মেয়ের একসাথে জীবন-যাপন ও সংসার পালনকে আইনগত, ধর্মীয় ও সামাজিক সুরক্ষা দিতেই বিবাহ শাদীর প্রচলন। মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে হলো একটি দেওয়ানী চুক্তি। এখানে খুব বেশি আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয় না। অন্যান্য চুক্তির মতই এতে দুটি পক্ষ থাকে। সাক্ষীদের উপস্থিতিতে একপক্ষ বিয়ের প্রস্তাব করলে এবং অন্যপক্ষ তা গ্রহণ করলে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়। মুসলিম বিয়েতে মহর বাধ্যতামূলক, আর বিয়ের পর ছেলের বাড়িতে অলিমা করা সুন্নত।
বৈধ সম্পর্ক স্থাপন না করে যৌন চাহিদা পূরণ করা ইসলামে হারাম। এমন যৌনাচারকে ব্যভিচার বলা হয়। ব্যভিচার এমন এক ধ্বংসাত্মক কলুষতা যা মানুষকে সবদিক দিয়ে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি যে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করা প্রয়োজন তা বিবেকবান ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন। শুধু প্রতিরোধ করাই যথেষ্ট নয় বরং এর জন্য প্রয়োজন এক স্বতন্ত্র আইন-কানুন ও বিধি-বিধান। ইসলাম তাই করেছে। সে মানুষের প্রকৃতি পরখ করেছে এবং সেই মুতাবিক চিকিৎসা ও সতর্কতার তাকীদ দিয়েছে। ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মতো  বাড়াবাড়ির পথ অবলম্বন করেনি, বরং মানব-প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য করে ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা পছন্দ করেছে।
ব্যভিচারের অপকারিতা বর্ণনা করার পর মহান আল্লাহ মানব জাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, পুরুষ ও নারী যারই বিয়ের প্রয়োজন দেখা দেবে, সে-ই অবশ্যম্ভাবীরূপে বিয়ে করবে। কেননা, বিয়েই হচ্ছে যৌন পবিত্রতা সংরক্ষণ ও যৌন ক্ষুধা নিবারণের সবচেয়ে বড় উপায় ও মাধ্যম। তাই আল্লাহ রব্বুল আলামীন বিয়ের নির্দেশ দিতে গিয়ে বলেছেন- ‘তোমাদের মধ্যে যারা জুড়িহীন, তাদের বিয়ে করিয়ে দাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা উপযুক্ত তাদেরও।’ (সূরা নূর : ৩২)
মহান আল্লাহ বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের তাকীদ দান করেছেন এবং যে-সব নারী-পুরুষের বিয়ে করা প্রয়োজন, তাদের সবাইকে বিয়ে করানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আর এ দায়িত্ব আল্লাহ অর্পণ করেছেন গোটা জাতির ওপর, যাতে তারা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে। এ ব্যবস্থার দ্বারা মহান আল্লাহ এটাই বুঝাতে চান যে, বিয়ে-শাদীর দরুন যে উপকার লাভ হয়, গোটা জাতি তার দ্বারা উপকৃত হয়। আর বিয়ে না করার দরুন যে ক্ষতি সাধিত হয়, তাও গোটা জাতিকেই বহন করতে হয়। বস্তুত বৈধ বিবাহ বিধান রহিত করে দিলে গোটা জাতীয় চরিত্রই যে তাতে পুঁতিগন্ধময় হয়ে উঠবে, কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তিই তা অস্বীকার করতে পারবেন না। উক্ত আয়াতের পরবর্তী অংশে মহান আল্লাহ আরো বলেছেন যে, কোনো কল্পিত আশঙ্কাকে অজুহাত হিসাবে দাঁড় করিয়ে এই শুভ পরিণয় থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
উক্ত আয়াত থেকে এ কথা পরিষ্কারভাবেই জানা গেলো যে, যে নারী কিংবা পুরুষ বিয়ের যোগ্য হবে, তাকে বিয়ে করাতে হবে।
নারী পুরুষের সৃষ্টি রহস্য : মহান আল্লাহ মানুষকে দুটি প্রজাতিতে সৃষ্টি করেছেন। পুরুষ ও নারী। তাদেরকে এক ভারসাম্যপূর্ণ আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। মালিকের সৃষ্টি কৌশল মোতাবেক অসংখ্য নারী-পুরুষ নিজেদের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট ও বিশেষত্ব নিয়ে দুনিয়ার সর্বত্র এক নির্দিষ্ট অনুপাত সহকারে জন্ম গ্রহণ করছে। এই ব্যবস্থার মধ্যে বিরাট রহস্য ও তাৎপর্য নিহীত আছে। এ ব্যবস্থায় পুরুষ স্বীয় দাবি নারীর নিকট এবং নারী স্বীয় দাবি পুরুষের নিকট পুরণ করতে পারে। উভয়ই পরস্পরের নিকট পরম তৃপ্তি, স্বস্তি, শান্তি লাভ করতে পারে। এছাড়া মানব বংশ সংরক্ষণ এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। তাই নারী ও পুরুষের মাঝে কামনা-বাসনা ও উদ্যম, ব্যগ্রতা ব্যকুলতা ভালোবাসা অনুরাগ সংস্থাপন করার মূল উদ্দেশ্য হল সমগ্র প্রাণীজগতের মুকাবেলায় মানবজাতির মধ্যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তোলা। মহান আল্লাহ সূচনাতেই এমন অবস্থার সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, ভালোবাসা ও প্রশান্তি লাভের পিপাসাই তাহাদেরকে পরিবার গড়ে তুলতে উদ্ধুদ্ধ করে, বাধ্য করে। ফলে বংশ ও গোত্র গড়ে উঠে মানবতার বিকাশ ঘটে ।
নারীকে পুরুষের চেয়ে সুন্দর করে সৃষ্টি করা হয়েছে। সৌন্দর্য্যরে কারণে নারীকে একান্তভাবে পাওয়ার স্রষ্টা প্রদত্ত্ব আকাক্সক্ষা পুরুষের মাঝে কাজ করে। পুরুষকে কর্মট ও শক্তিশালী করে সৃষ্টি করা হয়েছে। শক্তির প্রতি নারীর আকর্ষন দুুর্ণিবার। উভয়ের আকাক্সক্ষা নিবারণের বৈধ ব্যবস্থা হচ্ছে ‘বিয়ে’। বিয়ে মানুষের বাস্তব প্রয়োজন, প্রেম-প্রীতি, ভালবাসা ও মনের প্রশান্তি লাভই হচ্ছে বিয়ের প্রধানতম উদ্দেশ্য। একটি নারী ও একটি পুরুষ বিবাহ সূত্রে একত্রিত হয়ে সুশৃংখল, সুষ্ট জীবন যাপনকেই বলা হয় দাম্পত্য জীবন। নারী পুরুষের সৃষ্টি যত পুরাতন বিয়েও তত পুরাতন, এক মানবিক ধর্মীয় আবশ্যিক বিধান।
ইসলামে কুরআন হাদীসের আলোকে বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। আর ইসলামে এ বিষয়ে রয়েছে প্রয়োজনীয় সুস্পষ্ট পথ নির্দেশনা। সর্বোপরি বিয়ে একটি ইবাদত, বিবাহ পূর্ব ও পরবর্তী করণীয় এবং বর্জনীয় দিক সম্পর্কে শরীয়তে রয়েছে বিস্তারিত বিধান-প্রবিধান। যা জানা আমাদের জন্য ফরজ।
বিয়ের প্রয়োজনীয়তা
বিয়ে ধর্মীয় ও সামাজিক সব দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ, ইসলামে বিয়েকে বলা হয়েছে ঈমানের অর্ধেক। বিয়ের মাধ্যমে ঈমানের পূর্ণতা পায়। তাছাড়া বিয়ে মানব জীবনের অন্যতম চাহিদাও বটে। এ কারণে ব্যক্তি যখন বিয়ের উপযুক্ত হয় তখন বিয়ের তাগিদ দিয়েছে ইসলাম। বিয়ে যে কেবল শারীরিক চাহিদা বা ঈমাণ পূর্ণ করে তাই নয়, তা নারী-পুরুষের ব্যক্তিত্বেরও বিকাশ ঘটায়। সমাজে গ্রহণ যোগ্যতা তৈরি করে। এজন্য সময়মতো বিয়ে করাকে গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম।
অনেক সক্ষম ও স্বাবলম্বী পুরুষও মনে করে, বিয়ে করলে স্ত্রীর ভরণ পোষণ দিতে পারবে না। সামান্য আয়ে দু’জনের সাংসারিক চাহিদা পুরণে ব্যর্থ হবে। এ জন্য বিয়ে থেকে দূরে থাকে বা বিলম্ব করে। এটা উচিত নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা স্বামী/স্ত্রী বিহীন আছে এবং দাস দাসীদের মধ্যে যারা নেককার তাদের বিয়ের ব্যবস্থা কর। যদি তারা অভাবগ্রস্ত থাকে আমি (আল্লাহ্) নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছলতা দান করবো। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও সবকিছু জানেন।’ (সূরা নূর : ৩২)
রাসূলুল্লাহ সা. বিবাহিত ব্যক্তির সাহায্য প্রাপ্তির আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তিন ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহর কর্তব্য, এক. আযাদীর জন্য চুক্তিবদ্ধ গোলাম অর্থাৎ যে কৃতদাস তার মুক্তি মূল্য আদায় করতে চায়, দুই. পবিত্রতার মানসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তি, তিন. আল্ল¬াহর পথে যুদ্ধকারী।
হযরত আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তিগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুঃশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন।’ (আবূ দাঊদ : ১৫২০)
এ সম্পর্কিত একটি হাদীস হযরত আবূ যর রা. থেকে বর্ণিত। একবার রাসুলুল্লাহ সা. আক্কাফ রা. কে বললেন, হে আক্কাফ! তোমার স্ত্রী আছে? তিনি বলেন, না। রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, তোমার কি সম্পদ ও স্বচ্ছলতা আছে? তিনি বললেন, আমার সম্পদ ও স্বচ্ছলতা আছে। রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, ‘তুমি এখন শয়তানের ভাইদের দলভূক্ত। যদি তুমি খ্রিস্টান হতে তবে তাদের রাহিব (ধর্ম গুরু) হতে। নিঃসন্দেহে বিয়ে করা আমাদের ধর্মের রীতি। তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি যে অবিবাহিত। মৃত ব্যক্তিদের মধ্যেও নিকৃষ্ট ব্যক্তি যে অবিবাহিত। তোমরা কি শয়তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাও। শয়তানের কাছে নারী হলো অস্ত্র। সবাই নারী সংক্রান্ত ফিৎনায় জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যারা বিয়ে করেছে তারা নারীর ফিৎনা থেকে পবিত্র। নোংড়ামি থেকে মুক্ত। তারপর বলেন, আক্কাফ! তোমার ধ্বংস অনিবার্য। তুমি বিয়ে কর নতুবা তুমি পশ্চাৎপদ মানুষের মধ্যে থেকে যাবে। (মুসনাদে আহমদ, ইমদাদুল ফাতওয়া খন্ড ২, পৃষ্ঠা ২৫৯)। এ হাদীস অনুাযায়ী অবিবাহিত স্বাবলম্বী পুরুষকে পশ্চাৎপদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিয়ের প্রকার : বিয়ে ছয় প্রকার ১. ফরজ ২. ওয়াজিব ৩. সুন্নাতে মুআক্কাদা ৪. মুস্তাহাব ৫. হারাম ৬. মওকূফ।
ইসলামে ব্যক্তির যোগ্যতা ও সক্ষমতা বিচারে বিয়েকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
ফরজ : যদি যোগ্যতা ও সামর্থ থাকার সাথে সাথে শারীরিক চাহিদা এতো বেশি থাকে যে, বিয়ে না করলে ব্যাভিচার বা হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়ে তবে বিয়ে করা ফরজ। ব্যাভিচারের আওতায় যেগুলো পড়ে তা হলো- কুদৃষ্টি, পর্নগ্রাফী আসক্ততা, অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক বা লিভটুগেদার, হস্ত মৈথুনের মতো হারাম কাজ ইত্যাদি।
ওয়াজিব : যদি যোগ্যতা ও সামর্থ থাকার সাথে সাথে শারীরিক চাহিদা বেশি থাকে যে, বিয়ে না করলে ব্যাভিচার বা হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার আশংকা তৈরি হয় তবে বিয়ে করা ওয়াজিব। উভয় অবস্থায় বিয়ে থেকে বিরত থাকলে গুণাহগার হতে হবে।
সুন্নাতে মুআক্কাদা : যদি যোগ্যতা ও সামর্থ থাকে কিন্তুব্যাভিচার বা হারাম কাজে লিপ্ত হওয়া অনিবার্যতা বা আশংকা না থাকে সাভাবিক জীবন যাপন করে  তবে এ অবস্থায় বিয়ে করা সুন্নাতে মুআক্কাদা।
মুস্তাহাব : যদি যোগ্যতা ও সামর্থ থাকে কিন্তু তিনি কোন সামাজিক জাতীয় বা ধর্মীয় কাজে সদা ব্যস্ত থাকেন, যেমন গবেষণা, পঠন পাঠন, দাওয়াত ও তাবলীগ, জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ, উদ্ভাবন-আবিষ্কার ইত্যাদি। এ অবস্থায় তার জন্য বিয়ে করা মুস্তাহাব। করলে ভাল না করলে কোন গুনাহ হবে না।
নিষিদ্ধ/হারাম :- যদি কেউ শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম অসামর্থ হয় তখন তার জন্য বিয়ে করা নিষিদ্ধ/হারাম।
মওকূফ : যদি কেউ আর্থিকভাবে অক্ষম অসামর্থ হয় তখন তার জন্য বিয়ে করা মওকূফ/স্থগিত থাকবে যত দিন না মহান আল্লাহ তাকে সচ্ছলতা দান করবেন। অবস্থা যদি এমন হয় যে কোনো পুরুষ এতটাই অসামার্থ যে, সে একে বারে নিঃস্বম্বল, অক্ষম। নিজের মাথা গোজার মতো এতটুকু ঠাই নেই, তবে এক্ষত্রে তাকে রোজা রাখতে হবে। বিয়ের ইচ্ছে থাকলেও এহেন পুরুষদের বিয়ে না করে রোজা রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে হাদীস শরীফে। কারণ রোজা দৈহিক কাম-উত্তেজনা দূর করে। তবে এ সময় সক্ষমতা অর্জনের জন্য বেশি বেশি কাজ ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে।
বিয়ের প্রস্তুতি : সুন্দর সংসার গড়ার জন্য পূর্ব পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি থাকা খুবই প্রয়োজন। পিতা মাতার মতামতের সাথে নিজের পছন্দের সমন্বয় করা এবং মালিকের দরবারে সৎ ও নয়নপ্রীতিকর সংগীর জন্য দু’আ করা ইসলামের শিক্ষা। বিবাহ পূর্ব প্রেমের বিয়ে টেকসই হয় না। সুতরাং প্রেম করে বিয়ের পরিকল্পনা পরিহার করা বাঞ্চনীয়। কেননা মহান আল্লাহর হুকুম পর্দা রক্ষা করে কখনো প্রেম করা সম্ভব হয় না। নফসের খপ্পরে পড়ে প্রেম করে পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ে প্রেমিক-প্রেমিকা নিজেরাই বা বন্ধু-বান্ধবের সহযোগীতায় বিয়ে পর্ব সমাপ্ত করে থকে। বিয়ে-শাদিতে পিতা মাতাকে উপেক্ষা করা কখনো কাম্য হতে পারে না। তারা সন্তানকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসেন। সন্তান পিতা মাতা ছাড়া বিয়ে করলে তারা বড় ধরনের আঘাতপ্রাপ্ত হন। তাই নিজের পছন্দকে পিতা মাতার পছন্দের সাথে সমন্বয় করে বিয়ে করাই উত্তম বিয়ে।
আমাদের প্রতিটি স্বামী স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন শান্তি সুখে ভরে উঠুক, মহান মালিকের দরবারে এই দু‘আ করি।
১১ রজব ১৪৩৭ হি.
উপশহর, সিলেট।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button