শরণার্থী সঙ্কটে ইউরোপ : নির্বিকার মুসলিম বিশ্ব

USAফেরদৌস আহমদ ভূইয়া: বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে মুসলিম দেশ সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়াসহ এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার মানুষ ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টায় অভিবাসন ক্ষেত্রে এক নতুন সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিগত কয়েক শতকব্যাপী সারা বিশ্ব থেকে বিশেষ করে এশিয়া থেকে উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপে অভিবাসী হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ব বিধ্বস্ত ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান ও লিবিয়া থেকে অসহায় মুসলমানরা জীবনের নিরাপত্তা ও উন্নত জীবনের আশায় দলে দলে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করছে। আর তারা তা করছে ভিসা ছাড়াই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দেয়ার অসাধ্য সাধনের কাজ। তাতে বাধ সাধছে দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়া ও  মেসিডোনিয়া। এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপে আশ্রয় প্রার্থীদের নিয়ে চলমান সঙ্কট ক্রমশ গভীর হচ্ছে। শরণার্থীদের ভাগাভাগি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে জায়গা দেওয়ার ব্যাপারে সমঝোতা হলেও কয়েকটি দেশের অভিযোগ, তাদের কাঁধে তুলনামূলক বেশি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য জাতিসংঘের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় সহিংস ঘটনার জেরে ৫ কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সবচেয়ে মানবিক দুর্দশার শিকার হয় সিরিয়ার সাধারণ জনগণ।
এদিকে অভিবাসী সমস্যা মোকাবেলায় মেসিডোনিয়ার সরকার গত বৃহস্পতিবার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। আর স্লোভেনিয়া মুসলিম শরণার্থীদের নিতে চাইছে না। অভিবাসন-সঙ্কট ক্রমেই গভীর হওয়ায় ইইউর অস্তিত্বের জন্য হুমকি তৈরি হয়েছে বলে ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাওলো গেন্তিলোনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, গ্রিস-মেসিডোনিয়া সীমান্তে যে ধরনের বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে তা ইইউর দেশগুলোতে জনগণের অবাধ চলাচলের জন্য আসলেই হুমকি।
বার্তা সংস্থাগুলো জানায়, গ্রিস-মেসিডোনিয়া সীমান্তে অভিবাসীদের উপস্থিতি বেড়েই চলেছে। পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশের লক্ষ্যে গত ২২ আগস্ট শনিবারও অন্তত দুই হাজার শরণার্থী মেসিডোনিয়া সীমান্তে পৌঁছায়। তাদের প্রবেশে মেসিডোনিয়ার পুলিশ ও সেনারা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলে হাজারো মানুষ ওই সীমান্তে প্রবল বৃষ্টি ও ঠাণ্ডার মধ্যে খোলা আকাশের নিচেই রাত কাটাতে বাধ্য হয়। তাদের অধিকাংশই সিরিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাকের নাগরিক।
বিবিসির খবরে বলা হয়, মেসিডোনিয়ার সীমান্তে অভিবাসীদের লাঠিপেটা করা হলেও দেশটির সরকার তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর ওই কাজের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। সেখানে আশ্রয় প্রার্থীরা যে রকম আচরণ পেয়েছে, তা সাধারণত দাঙ্গাবাজেরাই পেয়ে থাকে বলে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ করেছে। কিন্তু মেসিডোনিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোলা পোপোস্কি বলেন, প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ প্রবেশ করছে। তাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার বাধ্য হয়েছে। তবে কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয়নি।
আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ মানুষ ইউরোপে আশ্রয়ের সন্ধানে বিপজ্জনক উপায়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গ্রিস ও ইতালির উপকূলে যাচ্ছে। গন্তব্য হিসেবে তাদের প্রথম পছন্দ ইউরোপের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ জার্মানি। সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, জার্মান সরকার চলতি বছর সাড়ে সাত লাখ মানুষের কাছ থেকে আশ্রয়ের আবেদন পাবে বলে ধারণা করছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সীমান্তবিষয়ক সংস্থা ফ্রন্টেক্স জানায়, গত মাসে ইইউ সীমান্তে এক লাখ সাত হাজার অভিবাসী পৌঁছানোর রেকর্ড হয়েছে। কেবল গত সপ্তাহেই গ্রিস উপকূলে পা রেখেছে ২০ হাজার ৮০০ শরণার্থী।
ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরনাদ ক্যাজনভ গত ২০ আগস্ট বৃহস্পতিবার বলেছেন, এত বেশি অভিবাসীর ইউরোপে প্রবেশের বিষয়টি কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, তা নিয়ে ইইউভুক্ত দেশগুলোর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অক্টোবরে আলোচনায় বসবেন।
অভিবাসী না শরণার্থী
কাতারভিত্তিক টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদ প্রতিষ্ঠান আল-জাজিরা ঘোষণা দিয়েছে, তাদের উপস্থাপক ও লেখকেরা গ্রিস উপকূলে আশ্রয় প্রার্থী মানুষের খবর পরিবেশনের সময় এখন থেকে আর ‘অভিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করবেন না। এক্ষেত্রে ‘শরণার্থী’ শব্দটিই বেশি উপযোগী। কারণ, এসব শরণার্থীর বেশির ভাগই নিজ দেশে চলমান সহিংসতা থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে ইউরোপমুখী হচ্ছে। ‘অভিবাসী’ শব্দটির সাধারণ অর্থ : মওসুমি কাজের খোঁজে বা উন্নততর জীবনযাত্রার সন্ধানে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ। অন্যদিকে জাতিসংঘ নির্ধারিত সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘শরণার্থী’ শব্দটির অর্থ : বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা এবং কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক সংগঠনের বা মতাদর্শের অনুসারী হওয়ার কারণে দেশান্তরী ব্যক্তি।
মেসিডোনিয়া পেরিয়ে ইইউ সীমান্তের পথে অভিবাসীরা
গ্রিস-মেসিডোনিয়া সীমান্তে দুই দিন অপো করার পর হাজার হাজার শরণার্থী ও অভিবাসী গত ২৩ আগস্ট সার্বিয়া হয়ে আরও উত্তরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সীমানার দিকে এগিয়ে যান। মেসিডোনিয়ার পুলিশ সম্প্রতি দণিাঞ্চলীয় সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর তারা সার্বিয়ার দিকে রওনা হন।
বিপুলসংখ্যক অভিবাসীর প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে মেসিডোনিয়ার কর্তৃপ গত ২৯ আগস্ট জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেও দুই দিন পর তা প্রত্যাহার করে। গত দুই দিন আশ্রয় প্রার্থীদের সঙ্গে সীমান্তে সেনা ও পুলিশ বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। এতে নারী-শিশুসহ অনেকে আহত হয়। এ ছাড়া নিম্ন তাপমাত্রা ও বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে বাধ্য হয় অনেকে।
সার্বিয়ার গণমাধ্যম জানায়, ইতোমধ্যে সাড়ে তিন হাজার শরণার্থী ও অভিবাসী মেসিডোনিয়া পেরিয়ে সার্বিয়ায়  প্রবেশ করে। পরে তারা ট্রেন ও বাসযোগে ইইউর সদস্য রাষ্ট্র হাঙ্গেরির সীমান্তের দিকে যাত্রা করে। মেসিডোনিয়া থেকে সীমান্ত পেরিয়ে আরও বহু মানুষ সার্বিয়ায় প্রবেশ করছে।
মেসিডোনিয়া সীমান্তে দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা গত ২৩ আগস্ট শরণার্থী ও অভিবাসীদের অবাধে প্রবেশের সুযোগ দেয়। এসব মানুষের অধিকাংশই সিরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ থেকে পালিয়ে এসেছে।
৩০০০ অভিবাসী উদ্ধার: ভূমধ্যসাগর থেকে প্রায় তিন হাজার অভিবাসীকে গত ২২ আগস্ট উদ্ধার করা হয়েছে। ইতালির কোস্টগার্ড ওই উদ্ধারকাজ সমন্বয় করে। লিবিয়া উপকূল থেকে আসা যাত্রীবোঝাই ২০টি নৌযানে ওই অভিবাসীরা আরোহী হয়েছিলেন।
শরণার্থী সঙ্কটে ফিনল্যান্ড
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবার ফিনল্যান্ড সবচেয়ে ভয়াবহ শরণার্থী সঙ্কটের মোকাবেলা করছে। ফিনল্যান্ডের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি. পেত্তেরি অরপো গত ২৪ আগস্ট সোমবার একথা জানান। হেলসিংকিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, আকস্মিকভাবে বিপুল সংখ্যায় শরণার্থী আগমনের সময় ‘জরুরি’ পরিস্থিতির মোকাবেলায় ফিনিশ রেডক্রস আরও জরুরি তহবিল পাবে। কেবল এবছরের আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের মধ্যেই ৫২৯৩ জন আশ্রয়প্রার্থী ফিনল্যান্ডে আগমন করেছে। অথচ গত পুরো বছরে এই সংখ্যা ছিল ৩৬৫১।
প্রতিবেশী দেশ সুইডেন হয়ে সিংহভাগ শরণার্থী ফিনল্যান্ড প্রবেশ করে থাকে। তবে সুইডেনে এবছরের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই ৪০ হাজার আশ্রয়প্রার্থী আগমন করেছে। এদের মধ্যে সর্বাধিক শরণার্থীরা হলেন ইরাক, সোমালিয়া, আলবেনিয়া, আফগানিস্তান ও সিরিয়া থেকে। এরমধ্যে অধিকাংশ আশ্রয় প্রার্থীরা যার যার দেশে জাতি, ধর্ম বা রাজনৈতিক মতামতের কারণে নির্যাতিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে।
ফিনিশ অভিবাসন এই সঙ্কটকে কমিউনিজমের পতনের পর এবং ১৯৯০-এর দশকে বলকান সঙ্কটের সময় সংঘটিত গণ দেশত্যাগের চেয়েও ভয়াবহ বলে গণ্য করছে।
এদিকে শরণার্থীদের জরুরি বাসস্থানের জন্য ফিনিশ ইমিগ্রেশন সার্ভিসের অনুরোধে সাড়া দিয়ে রাজধানী হেলসিংকিসহ স্বায়ত্বশাসিত ফিনল্যান্ডের পৌর করপোরেশনগুলো নতুন নতুন অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপনে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।
শরণার্থীদের নিয়ে সঙ্কটে গ্রিস
পর্যটকেরা এখন আর এ এলাকায় নেই। পর্যটকের বদলে রেস্তোরাঁ ও রিসোর্টে আশ্রয় নিয়েছে শরণার্থী ও অভিবাসন প্রত্যাশী লোকজন। তাদের সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার ওপর সস্তা দরে স্যান্ডউইচ ও চা-কফি বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হয়ে উঠছে।’ গ্রিসের বিনোদনকেন্দ্র কসের অলিম্পিয়া গ্রিক রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী ইভা কিতরিনার কণ্ঠে এই হতাশার সুর। এই হতাশার সুর ওই অঞ্চলের প্রায় সব অবকাশ যাপনকেন্দ্র ও রেস্তোরাঁ মালিকের।
বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সম্প্রতি ইউরোপে বিশাল আকারে অভিবাসী-সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে সংঘাতের কারণে সেখান থেকে পালিয়ে ইউরোপের দেশগুলোতে অভিবাসন প্রত্যাশীরা শরণার্থী হিসেবে গ্রিসের দ্বীপ ও পর্যটন এলাকা কসে আশ্রয় নিয়েছে। হাজারো শরণার্থীর ভিড়ে পর্যটকেরা এখন কসের সৈকত ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ক্রমশ কসের বিনোদনকেন্দ্র হয়ে উঠছে শরণার্থীদের আশ্রয়শিবির।
এমনিতে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে এখন গ্রিস। শরণার্থীদের এই ভিড়ের কারণে পর্যটকরা বিনোদনকেন্দ্রগুলো ছেড়ে চলে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ওই এলাকার ব্যবসায়ীরা। হাজারো শরণার্থীর শৌচাগার, সুপেয় পানি এবং বিদ্যুতের সরবরাহও করতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। তবু মুখ ফিরিয়ে নেননি তাঁরা। এই সঙ্কটের মুখেও শরণার্থীদের সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।
অলিম্পিয়া গ্রিক রেস্তোরাঁর স্বত্বাধিকারী ইভা কিতরিনা বলেন, ‘আমাদের রেস্তোরাঁয় এখন আর কোনো পর্যটক আসছেন না। গত সপ্তাহ থেকে ওটা শরণার্থীদের রেস্তোরাঁ হয়ে গেছে। শরণার্থীরা এসে এখানে খুব সস্তা দরের স্যান্ডউইচ, চা ও কফি চাইছে। বাধ্য হয়ে এসব বিক্রি করতে হচ্ছে।’
সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে সংঘাতের কারণে ওই দেশগুলোর বাসিন্দারা পালিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ইউরোপের দেশগুলোতে ঢোকার জন্য তারা পথ হিসেবে ব্যবহার করছে গ্রিসকে। শেষমেশ এখান থেকেও অন্য কোনো দেশে ঢুকতে না পেরে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে গ্রিসের পর্যটন নগর কস এলাকায়। গত সপ্তাহে দেশটির কর্তৃপ হাজারো শরণার্থীকে নিবন্ধনের মাধ্যমে অলিম্পিয়া গ্রিক রেস্তোরাঁর পাশে আশ্রয় দিয়েছে। এ ছাড়া খাবার, পানি ও শৌচাগারের স্বল্পতার কারণে শরণার্থীরা হট্টগোল করলে পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে।
ইভা কিতরিনা বলেন, ‘আমাদের রেস্তোরাঁয় একটি শৌচাগার। কিন্তু শরণার্থী হাজার হাজার। রেস্তোরাঁয় আমরা মাত্র তিনজন মানুষ কাজ করি। আমি বাদে একজন রান্না করে, একজন ঘর পরিষ্কার করে। তাহলে ভাবুন, আমরা এই তিনজন মানুষ কী করে এত এত শরণার্থীকে সাহায্য করব!’ তিনি বলেন, ‘এটা শরণার্থীদের দোষ নয়। আবার এই ছোট্ট একটা দ্বীপে আমাদেরও কোনো দোষ নেই।’
কসের ইয়াচ ক্যাফে নামের আরেকটি রেস্তোরাঁর মালিক থিওডোর জাগাসের হতাশা অন্য রকম। ৩৫ বছর বয়সী গ্রিসের এই নাগরিক বলেন, ‘এখন পর্যটক আসার সময়। অথচ এই সময় গত বছরের তুলনায় লাভ অনেক কম হচ্ছে। গত বছরের আগস্ট মাসের চেয়ে এবার ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ লাভ কম হচ্ছে।’ তিনি বলেন, অভিবাসী ও শরণার্থীদের জন্য আমার দরদ আছে ঠিকই, তাদের আমি সাধ্যমতো সাহায্যও করব, কিন্তু আমাকে শ্রমিকদের মজুরি দিতে হয়, কর দিতে হয়। এটাও মনে রাখতে হবে।’
ব্যবসার এই তি পুষিয়ে দিতে স্থানীয় কর্তৃপরে কোনো উদ্যোগ আছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে থিওডোর জাগাস বলেন, ‘শরণার্থীরা যদি এই মুহূর্তে থাকার জন্য অন্য কোথাও ভালো জায়গা পায়, তাহলে পর্যটকেরা আবার এই সৈকতে আসবেন, আবার তাঁরা আনন্দ উপভোগ করবেন। এটাই আমাদের জন্য ভালো।’
তবে এই সৈকতে এখনো যেসব পর্যটক রয়েছেন, তাঁরা শরণার্থীদের সহমর্মী হয়েছেন। সৈকতে দেখা গেছে, একজন জার্মান তরুণী সৈকতে খাটানো তাঁবুতে থাকা শরণার্থীদের নিজ উদ্যোগে খাবার ও পানি সরবরাহ করছেন। কস সৈকতের পাশেই ক্যাপ্টেন ইলিয়াস হোটেলেও অনেক শরণার্থী মানবেতর জীবন যাপন করছে। সেখানে মার্কিন এক দম্পতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
এমনই একজন পর্যটক হলেন হেলেন ব্রনকানো। কোপেনহেগেন থেকে স্বামী ও দুই সন্তান সঙ্গে নিয়ে একটু অবসর কাটাতে এসেছেন কসে। তিনি বলেন, ‘পর্যটন সংস্থাগুলো একজনের সঙ্গে ২০ কিলোগ্রাম ওজনের ব্যাগ বহন করার অনুমতি দেয়। এই ব্যাগে করে আমরা শরণার্থীদের জন্য কাপড় নিয়ে এসেছি।’
নিজেই ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে স্থান সঙ্কটে পড়া হেলেন ব্রনকানো বলেন, ‘অবসর কাটাতে আসা এই সময়টার কথা অবশ্যই মনে থাকবে। কারণ এই সময়টাই কিছু মানুষ (শরণার্থী) সম্পর্কে একটু ভিন্নভাবে ভাবার সুযোগ করে দিয়েছে। আমি ডেনমার্কে ফিরে গিয়ে অনলাইনে সিরিয়ার সংঘাত সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। এ বিষয়ে আমি তেমন কিছুই জানি না। তাই জানার চেষ্টা করব, আসলেই সেখানে কী ঘটছে? কী কারণে হাজারো মানুষ এখানে শরণার্থী হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।’
আশ্রয় প্রার্থীদের গন্তব্য কোথায়?
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গ্রিসের উপকূলে পৌঁছানো শরণার্থীরা ওই দেশটিতে থাকতে চান না। কারণ, গ্রিস নিজেই অর্থনৈতিক সঙ্কটে নিমজ্জিত। তাই শরণার্থীরা দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত পেরিয়ে মেসিডোনিয়ায় প্রবেশ করেন। সেখান থেকে তাঁরা ট্রেনে করে আরও উত্তরে সার্বিয়া হাঙ্গেরি পার  হয়ে ইউরোপের তুলনামূলক বেশি সমৃদ্ধ দেশ জার্মানি, নেদারল্যান্ডস বা সুইডেনে যেতে চান।
মেসিডোনিয়ার কর্তৃপ সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করলে বিপাকে পড়েন হাজারো শরণার্থী। তাঁরা প্রবল বৃষ্টি ও নিম্ন তাপমাত্রার মধ্যেই সীমান্তে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে বাধ্য হন। তাঁদের মধ্যে বহু নারী ও শিশুও রয়েছেন। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে সীমান্তে নারী-শিশুসহ হাজারো শরণার্থী এবং অভিবাসীর অরতি অবস্থায় দিন কাটানোর বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
গ্রিস ও মেসিডোনিয়ার সীমান্তে এখনো বহু ফাঁকফোকর রয়েছে। কারণ, দুটি দেশেই সীমান্তে টহল সীমিত। এই সুযোগে অভিবাসীরা গ্রিস ও মেসিডোনিয়াকে তাঁদের ‘গন্তব্যে’ পৌঁছানোর পথ হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁদের অনেকে তুরস্ক থেকে যাত্রা শুরু করেন। এরপর নৌপথে গ্রিসে বা হেঁটে বুলগেরিয়ায় গিয়ে সেখান থেকে মেসিডোনিয়া ও সার্বিয়ার ওপর দিয়ে আরও উত্তরের পথে এগিয়ে যান। এই দীর্ঘ যাত্রায় মেসিডোনিয়া পার হওয়াটাই তাঁদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্ব। কারণ, সেখানে রয়েছে সশস্ত্র দুর্বৃত্ত ও মাফিয়াদের দৌরাত্ম্য। তাই, শরণার্থীরা অনেক সময় অপো করেন এবং আরও লোকজন জড়ো হয়ে দল ভারী করে আবার উত্তরের পথে যাত্রা শুরু করেন।
চলতি বছর এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫০০ লোক ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। এঁদের মধ্যে গ্রিসে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫৬, ইতালিতে প্রায় ১ লাখ ৪ হাজার, স্পেনে ১ হাজার ৯৫৩ এবং মাল্টায় ৯৪ জন অবস্থান করছেন।
আমরা তাদের অভিবাসী বলি আর শরনার্থী বলি এদের অধিকাংশই হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের, অথচ মুসলিম দেশগুলো তাদের সহযোগিতা করার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না।  এটাই মুসলিম বিশ্বের জনগণের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। মুসলিম বিশ্বের নেতারা আছে তাদের ক্ষমতা আকড়ে থাকার লিপ্সায়। তাদের জনগণ কি অবস্থায় কোথায় আছে তার খোঁজ-খবর নেয়ার কোনো দায়বোধ তাদের আছে বলে মনে হয় না। সাধারণ মুসলমানরা বলছেন সারা বিশ্বে কোটি কোটি মুসলমান আছে কিন্তু নেই মুসলমানদের কোনো অভিভাবক নেই। প্রতিটি রাষ্ট্রে মুসলমানরা অভিভাবকহীন। পর্যবেক্ষকমহল বলছেন মুসলিম শরণার্থীদের ব্যাপারে মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন।
৮ হাজার সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দেবে যুক্তরাষ্ট্র
আগামী বছর আট হাজার সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দেবে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র গত সোমবার এ কথা জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শরণার্থী ব্যবস্থার বিধিবিধান শিথিল করতে ফ্রান্স ও জার্মানির আহ্বানের পর যুক্তরাষ্ট্রের প থেকে এ কথা জানানো হলো।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জন কিবরি বলেন, শরণার্থীদের গ্রহণ এবং তাদের পুনরায় বসবাসের জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে সিরিয়ার চলমান সঙ্কট নিরসন শেষে বাস্তুহারারা যাতে নিজ দেশে ফিরতে পারে সে ব্যবস্থা করার দিকেই মনোযোগ যুক্তরাষ্ট্রের।
এর আগে অভিবাসী সঙ্কট ইস্যুতে বার্লিনে এক জরুরি বৈঠকে বসেন জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ। ওই বৈঠক থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শরণার্থী ব্যবস্থা সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়। এ ছাড়া সিরিয়ার শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার সুপারিশও করা হয়।
২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় চলা গৃহযুদ্ধে প্রায় ৪০ লাখ লোক বাস্তুহারা হয়। গত ডিসেম্বরে ওয়াশিংটন জানিয়েছিল, জাতিসংঘ যুক্তরাষ্ট্রে নয় হাজার শরণার্থী পাঠাতে চায়। এর মধ্যে দুই হাজার লোককে এ বছর অশ্রয় দিতে রাজি হয় ওয়াশিংটন। পাশাপাশি ২০১৬ সালে এই সংখ্যা বাড়ানো হবে বলেও জানায়।
তবে বেশি সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় না দেওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়ে মার্কিন প্রশাসন। যদিও সিরিয়ার যুদ্ধে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তায় প্রায় ৪০০ কোটি মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তা দিয়েছে দেশটি।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button