গার্ডিয়ানের নিবন্ধে ক্যামেরনের বক্তব্যের সমালোচনা

George Monbiotব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন গত সোমবার ‘ইসলামিক এক্সট্রিমিজম’ বা ‘ইসলামী উগ্রপন্থা’ বিষয়ে তার সরকারের মারাত্মক উদ্বেগের কথা জানিয়ে এক বক্তৃতা দিয়েছেন। সেখানে তিনি ‘ইসলামি উগ্রপন্থা’র বিরুদ্ধে লড়াইকে ব্রিটেনের ‘নতুন প্রজন্মের সংগ্রাম’ বলে অভিহিত করেন। একই সাথে ক্যামেরন দেশবাসীকে এই ‘ভয়াবহতম’ (ইসলামি উগ্রপন্থা) শত্রুর মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ‘ইসলামী উগ্রপন্থা’কে ক্যামেরন কর্তৃক ফুলিয়ে ফাপিয়ে ব্রিটেনের ‘সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে দেখানোকে ভালভাবে নেননি দেশটির অনেকে। বক্তৃতার পর ক্যামেরনের সমালোচনায় সরব হয়েছেন। বিখ্যাত দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা কলামিস্ট জর্জ মনবায়োটের এমন একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। যেখানে লেখক কথিত ‘ইসলামী উগ্রপন্থা’র জুজুর ভয়কে ফুলিয়ে প্রচার করায় ক্যামেরনের কড়া সমালোচনা করেছেন। নিবন্ধটির চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হল।
“পার্লামেন্ট স্কয়ার (ব্রিটেনের) থেকে স্যার উইন্সটন চার্চিলের ভাস্কর্য সরিয়ে কোনো জাদুঘরে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। আর পার্লামেন্টের ভেতরে এবং প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে তার সবগুলো আবক্ষ মূর্তি ও পোট্রেইট সরিয়ে গুদামঘরে ঢুকিয়ে রাখা প্রয়োজন। কেন ? চার্চিলের উত্তরসূরিদের তার জুতায় পা ঢুকাতে নিরুৎসাহিত করার জন্য ! ১৯৪০ সালের জুনে চার্চিল যখন বলেছিলেন, ‘আমাদের ব্রিটিশ জীবনের টিকে থাকা নির্ভর করছে এই যুদ্ধের ওপর’, তখন তিনি সঠিক ছিলেন। কিন্তু এরপর যারা তার এই সেন্টিমেন্ট ধার করতে গিয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা ভুল ছিল।
তালেবান, আল কায়েদা, সাদ্দাম হোসেইন, আইএসআইএস এবং ইসলামী উগ্রপন্থা এসবের কোনোটিই ব্রিটেনের অস্তিত্বের জন্য হুমকি ছিল না এবং এখনো নেই। কিন্তু সবক্ষেত্রেই দেশটির একাধিক প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা ‘অস্তিত্বের জন্য হুমকি’ কথাটি বাড়িয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল তা ভুল প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত। ইরাকের ক্ষেত্রে এমন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর পরিণতি শেষমেশ আমরা আবিষ্কার করলাম খুবই ভয়াবহভাবে।গত সোমবার ডেভিড ক্যামেরন বললেন, “ইসলামী উগ্রপন্থ মোকাবিলা করা আমাদের ‘বর্তমান প্রজন্মের সংগ্রাম’। হিটলারকে পরাজিত করার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এই সংগ্রাম আমাদের চালিয়ে যেতে হবে।” হ্যাঁ, এটা একটা মারাত্মক সমস্যা এবং বড় হুমকিও বটে। কিন্তু এটাকে ‘বর্তমান প্রজন্মের সংগ্রাম’ হিসেবে দাবি করা দেখে মনে হচ্ছে প্রাসঙ্গিকতার মারাত্মক ভুল ব্যাখ্যা হচ্ছে। ব্রিটেনে মানুষের মৃত্যু ঝুঁকির বিবেচনায় ইসলামী উগ্রপন্থা সম্ভবত প্রথম ৫০টি কারণের তালিকায় স্থান পাবে। তবে প্রথম দিকে এর অবস্থান নয় মোটেও। প্রথম দিকে যেগুলোর অবস্থান সেগুলোর মধ্যে আছে ডায়েট, ধূমপান, অ্যালকোহল, একাকীত্ব, স্বাস্থ্যসেবার অবনতি, শিশু দারিদ্র্য, বায়ু দূষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, শরীর চর্চার ঘাটতি ইত্যাদি রয়েছে। এমনকি শয়নকক্ষে ভুল ধরনের মোজা পরার কারণে সৃষ্ট রোগে যত মানুষ মারা যায় তা ইসলামী উগ্রপন্থার কারণে মারা যাওয়া সংখ্যার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। সর্বশেষটি ছাড়া বাকি সব কারণ দূর করতে ইসলামী উগ্রপন্থার চেয়ে বেশি জাতীয় সম্পদ এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপ প্রয়োজন।
দীর্ঘমেয়াদে লক্ষ্য করলে জলবায়ু পরিবর্তন, এন্টিবায়টিক প্রতিরোধ, ভূমি হারানো এবং পরমাণু শক্তির বৃদ্ধি (ব্রিটেনসহ) উগ্রপন্থার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। কিন্তু অশরীরি শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ার চেয়ে চার্চিলের মতো করে চর্মচক্ষে দেখা যায় এমন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়া অপেক্ষাকৃত সহজতর এবং তাতে দেখানোর মতো ‘গৌরব’ও আছে। আবার এতে টাকাও লাগে কম। ফলে এই উদ্যোগের জন্য করপোরেশন এবং বিলিয়নেয়ারদেরও আলাদা করে ফান্ড দিতে হয় না।
সাবেক মার্কিন রিপাবলিকান বিশ্লেষক মাইক লফগ্রেন তার দলের প্রতি বিরক্ত হয়ে মার্কিন অর্থনৈতিক এলিটদের ব্যাপারে বলেছিলেন, “লুট করার সুযোগ না থাকলে সবসময়ই এই ধনীরা জাতীয় নাগরিক জীবন এবং এ ক্ষেত্রে কোনো কল্যাণ সাধনের থেকে নিজেদের দূরে রাখে। আমাদের ধনতন্ত্র উপনিবেশ আমলের ভারতে ব্রিটিশদের মতো বসবাস করছে। তারা যে এলাকাটিকে শাসন করছে সেখানে অবস্থান করছে ঠিকই কিন্তু তারা ‘সেখানকার লোক’ নয়।” আমরা আজ ব্রিটেনেও একই অভিশাপ বহন করছি। এখানে এমন একটি শাসক শ্রেণী আছে যারা তাদের সম্পদ সাগরের অপারে রাখে আর নিজেদের এখানকার গরিব মানুষের থেকে ভিন্ন এবং ভিনদেশীভাবে। তাদের কল্যাণে সরকার বছরে ৯৩ বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করে। ঠিক মতো (ধনীদের কাছ থেকে) ট্যাক্স আদায় করতে না পারা বাড়ির দাম বৃদ্ধি এত মারাত্মকভাবে ঘটিয়েছে যে, পুরো ইংল্যান্ড এখন গরিব লোকদের জন্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে।
ক্যামেরন যখন বলেন, ‘আমাদের নানা কমিউনিটির মানুষের মধ্যে এমন বিভাজন দেখা দিয়েছে যে, অন্য ধর্ম এবং ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষ সারা জীবন কাজ করেও সেই বিভাজন কমাতে পারবে না।’ ক্যামরন বিভাজনের কথা ঠিকই ধরতে পেরেছেন; কিন্তু সেটা ধর্মীয় নয় বরং অর্থনৈতিক। সমাজে তরুণ এবং অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মাঝে চরম বৈষম্য এবং বিভাজন বিরাজ করছে। সরকার শুধু এসব বিভাজনকে প্রসারিত করছে। বিষয়টি বুঝতে আরেকটু বাইরে তাকানো যাক। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী এক জরিপ করেছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার। তারা জানিয়েছে, নর্থ আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ফ্রান্স এবং জার্মানির মানুষ মনে করছে, আইএসআইএস তাদের দেখা সবচেয়ে বড় হুমকি। অন্যদিকে, দরিদ্র এলাকা তথা আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং এশিয়ার দেশগুলোর মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনকে হুমকির তালিকায় প্রথমে রেখেছেন। এমনিক গত সোমবারের বোমা হামলার পরও তুরস্কের মতো দেশে মানুষজন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। মিডিয়া প্রভাবিত এই পাগলামিকে বড় করে দেখিয়ে সরকারগুলো বেশ খুশি। ক্যামেরন, টনি অ্যাবট (অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী) এবং স্টিফেন হারপারের (কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী) মতো ব্যক্তিরা জলবায়ু হুমকির মতো বাস্তবিক হুমকি মোকাবিলায় ব্যস্ত হবে না তাদের স্পন্সরদের (করপোরেশনগুলো) বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে। তারা চার্চিলের কাছ থেকে খারাপ সবকিছু শিখেছে কিন্তু তার ভাল গুণ- যেমন দুর্যোগ সময়ে দেশের স্বার্থকে তার শ্রেণীর উপরে প্রধান্য দেয়ার শিক্ষাটা তারা নিতে পারেনি। অতএব, প্রতি ছয় মাস পর পর হিটলারের চেহারা নিয়ে ‘প্রজন্মের সংগ্রাম’ হিসেবে নতুন নতুন হুমকি হাজির হচ্ছে। কিন্তু এসবকে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা করা হচ্ছে।’’
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত কলামিস্ট জর্জ মনবায়োটের নিবন্ধটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button