সত্য-মিথ্যার প্রভেদকারী ঐতিহাসিক বদর দিবস

Madinahআবদুল্লাহ্ আল মেহেদী: ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর সংগঠিত হয় রমজানে। হিজরীর দ্বিতীয় সনে পবিত্র রমজান মাসের মাগফিরাতের সপ্তম দিনে অর্থাৎ রমজানের ১৭ তারিখে, যা ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষার প্রথম রক্তঝরা মহাসংগ্রাম। সত্য-মিথ্যার চূড়ান্ত লড়াই। আর এটা ছিল ইসলামের অস্তিত্বের লড়াই। এক দিকে সংখ্যালঘু ও নব্য মুসলমান অপর দিকে জিহাদ, তা-ও রমজানে। এটি সত্যিই ত্যাগের অনুপম দৃষ্টান্ত। মুসলমানদের গৌরবময় উজ্জ্বল ইতিহাসের স্বর্ণখচিত দিন। তাই এ দিনটি ঐতিহাসিক বদর দিবস নামে খ্যাত। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর দীর্ঘ ১৩ বছর অতিবাহিত করেন মক্কায়। এরপর তিনি আল্লাহর নির্দেশে মক্কায় বসবাসরত সাহাবীদের নিয়ে পর্যায়ক্রমে মদিনায় হিজরত করেন। সেখানে তিনি গঠন করেন একটি ইসলামী রাষ্ট্র। তার সে রাষ্ট্র হিজরী দ্বিতীয় সনেই ইহুদিদের নানা হুমকির মুখে পড়ে। সিরিয়া থেকে ফেরার পথে মক্কার কাফেরদের একটি বাণিজ্য কাফেলা মুসলিম শক্তির প্রতিরোধের মুখে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে মক্কা থেকে এক হাজার কাফের সেনার একটি সশস্ত্র দল মদিনা থেকে ৮০ মাইল দূরে অবস্থিত ‘বদর’ ময়দানে এসে যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু হয়। এ অবস্থায় ৩১৩ জন সাহাবিকে নিয়ে রাসূল (সা.) রণেক্ষেত্র উপস্থিত হন। এ যুদ্ধের আগে আল্লাহর হাবিব মহানবী (সা.) সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। হৃদয় উজাড় করে প্রার্থনা করতে থাকেন। ‘হে প্রভু ! আজ তুমি যদি মুসলমানদের এ ক্ষুদ্র দলটিকে সাহায্য না করো, এরা যদি নিশ্চিহ্নই হয়ে যায়, তাহলে তোমার মহিমান্বিত নামটি কে উচ্চারণ করবে ? আর এ পৃথিবীর বুকে তোমার নাম উচ্চারণের কেউই তো থাকবে না।’ নবী অসাধারণ ধৈর্য ও ত্যাগ-তিতিক্ষার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে ইসলামের শাশ্বত নূরের বাণী প্রচারে অগ্রসর হলেন। একদিকে নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকল। অন্য দিকে সত্যের গতিও হল অপ্রতিরুদ্ধ। যুলুম, নির্যাতন এতটাই বৃদ্ধি পেল যে, শেষ পর্যন্ত তিনি আল্লাহর হুকুমে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হলেন। কুরাইশরা এতেও ক্ষান্ত হল না। তারা ভাবল ইসলামের শক্তি সঞ্চয় প্রকৃতপক্ষে তাদের জাহেলী ব্যবস্থারই মৃত্যু ঘটার শামিল। অপর দিকে মক্কাবাসীদের জীবিকার একটি বড় উপায় ছিল ইয়েমেন ও সিরিয়ায় বাণিজ্য। আর যাতায়াতের পথ ছিল মদীনার উপর দিয়ে। সুতরাং মদীনায় মুসলমানদের শক্তি অর্জনের অর্থ ছিল তাদের চিন্তার কারণ। একদিকে বাণিজ্য পথের নিরাপত্তা অপর দিকে মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান শক্তিকে যেভাবেই হোক, চিরতরে মিটিয়ে ফেলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। বাণিজ্য কাফেলা রক্ষার অজুহাত খাড়া করে মুসলমানদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করল।
হিজরতের পর দু’বছরও অতিক্রান্ত হয়নি। সহায়, সম্বল সব হারিয়ে মুহাজিরগণ রিক্তহস্ত। আনসারগণ যুদ্ধ বিদ্যায় তেমন পারদর্শী নয়। অন্যদিকে ইহুদী গোত্র বিরোধিতার জন্য প্রস্তুত। খোদ মদীনায় মুনাফিক ও মুশরিকদের উপস্থিতি আভ্যন্তরীণ বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনি অবস্থায় কুরাইশরা যদি মদীনা আক্রমণ করে, তাহলে মুসলমানদের এই মুষ্টিমেয় দলটি হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। আর যদি হামলা না-ও করে বরং আপন শক্তিবলে শুধু কাফেলাকে মুক্ত করে নিয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে শত্রুরা মাথা তুলে দাঁড়াবে। ফলে মুসলমানদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। এই চরম সংকট কালে আল্লাহর পক্ষ থেকে হুকুম আসলো “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে, যারা আক্রান্ত হয়েছে; কারণ, তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে; আল্লাহ নিশ্চয় তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম”। (সূরা হাজ্জ-৩৯)। এসব কারণেই রাসূল (সা.) সিদ্ধান্ত নিলেন যতটুকু শক্তি আছে, তা নিয়েই ময়দানে টিকে থাকার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
যুদ্ধের সূত্রপাত দ্বিতীয় হিজরীর শা’বান মাস (ঈসায়ী ৬২৩ সালের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাস) কুরাইশদের এক বিরাট কাফেলা সিরিয়া থেকে মক্কার পথে প্রত্যাবর্তনকালে মুসলিম অধিকৃত এলাকার কাছাকাছি এসে পৌঁছালো। কাফেলাটির সঙ্গে প্রায় ৫০ হাজার আশরাফী মূল্যের সামগ্রী এবং ৩০/৪০ জনের মত রক্ষী ছিল। তাদের ভয় ছিলো, মদীনার নিকটে পৌঁছলে মুসলমানগণ হয়ত তাদের ওপর হামলা করতে পারে। কাফেলার নেতা ছিল আবু সুফিয়ান। সে এই বিপদাশঙ্কা উপলব্ধি করেই এক ব্যক্তিকে সাহায্যের জন্যে মক্কায় পাঠিয়ে দিল। লোকটি মক্কায় পৌঁছেই আরবের প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী উটের কান কেটে ফেলল, তার নাক চিরে দিল, উটের পিঠের আসন উল্টে দিল, নিজের জামা সামনের দিকে ও পিছনের দিকে ছিঁড়ে এই বলে চিৎকার করতে থাকল ‘হে কুরাইশগণ! তোমাদের বাণিজ্য কাফেলার খবর শোন। আবু সুফিয়ানের সাথে তোমাদের যে সম্পদ রয়েছে, মুহাম্মাদ তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে তার পেছনে ধাওয়া করেছে। তোমাদের তা পাবার আশা নেই। সাহায্যের জন্য দৌড়ে চল।’ কাফেলার সঙ্গে যে সম্পদ ছিল, তার সাথে বহু লোকের স্বার্থ জড়িত ছিল। ফলে এই সাহায্যের ডাকে সাড়া দিয়ে কুরাইশদের সমস্ত বড় বড় নেতাগণ যুদ্ধের জন্যে তৈরি হল। এভাবে প্রায় এক হাজার যোদ্ধা রণসাজে সজ্জিত হয়ে পূর্ণ আড়ম্বর ও জাঁক-জমকের সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে রওনা হল। এদের হৃদয়ে একমাত্র সংকল্প মুসলমানদের অস্তিত্ব এবার নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে, যেন নিত্যকার এই ঝঞ্ঝাট চিরতরে মিটে যায়।
মুসলমানদের প্রস্তুতি: কুরাইশদের এই সিদ্ধান্তের পর রাসূল (সা.) মুহাজির ও আনসারগণকে একত্রিত করে তাদের সামনে বর্তমান পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে তুলে ধরে বললেন, “একদিকে মদীনার উত্তর প্রান্তে রয়েছে ব্যবসায়ী কাফেলা আর দক্ষিণ দিক থেকে আসছে কুরাইশদের সৈন্য-সামন্ত। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, এর যে কোনো একটি তোমরা লাভ করবে। বল, এর কোনটির মুকাবিলা করতে চাও?” জবাবে বহু সাহাবী কাফেলার ওপর আক্রমণ চালানোর আগ্রহ প্রকাশ করলেন। কিন্তু রাসূল (সা.)-এর দৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী। তাই তিনি তাঁর প্রশ্নটি পূণরাবৃত্তি করলেন। এরপর মুহাজিরদের ভেতর থেকে মিকদাদ বিন আমর (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন : “হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আপনাকে যে দিকে আদেশ করেছেন, সেদিকেই চলুন। অপর দিকে এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আনসারদেরও মতামত গ্রহণের প্রয়োজন ছিল। এজন্যে নবী (সা.) উল্লিখিত প্রশ্নটি পূণরাবৃত্তি করলেন। সা’দ বিন মায়াজ (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন : “হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার ওপর ঈমান এনেছি। আপনাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছি এবং আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা সবই সত্য বলে সাক্ষ্য দিয়েছি। সর্বোপরি আমরা আপনার আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছি। কাজেই হে আল্লাহর রাসূল! আপনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা কাজে পরিণত করে ফেলুন। সেই সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদের নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন তাহলে আমরা আপনার সাথে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বো। আমাদের একজনও পেছনে পড়ে থাকবে না। উভয় বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ও রণ সম্ভারবাণিজ্য কাফেলার পরিবর্তে সৈন্যদলেরই মুকাবিলা করা হবে, এটা কোন মামুলী সিদ্ধান্ত ছিল না। কারণ কুরাইশদের তুলনায় মুসলমানদের অবস্থা ছিল নেহায়েত দুর্বল। এ সংক্ষিপ্ত সময়ে যারা (মুসলমানরা) যুদ্ধ করতে এগিয়ে এলেন, তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন। এদের মধ্যে মাত্র দু’তিন জনের কাছে ঘোড়া ছিল। আর বাকি লোকদের জন্য ৭০টির বেশি উট ছিল না। রণ সম্ভারও ছিল একে বারেই অপ্রতুল। মাত্র ৬০ জনের কাছে ছিল বর্ম।অপর দিকে কুরাইশরা আবু জাহলের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য নিয়ে রওনা হল। এ বাহিনীতে ১০০টি ঘোড়া, ৬০০টি বর্ম এবং প্রত্যেকেরই তরবারী ছিল। উট সংখ্যায় এতবেশি ছিল যে, প্রতিদিন তারা ৯বা ১০টি করে উট জবেহ করে খেত। সৈন্যরা প্রত্যেকেই যোদ্ধা ও যুদ্ধে পারদর্শী ছিল। সারী গায়িকা বাঁদীদল তাদের বাদ্যযন্ত্রসহ ছিল। তদুপরী সুরাকারূপী ইবলীসকে সঙ্গে নিল। এসব কারণেই কতিপয় মুমিনদের মনে ভীতির সঞ্চার হল। যা সূরা আনফালের (৫-৮) আয়াতে আল্লাহপাক উল্লেখ করেছেন। উভয় বাহিনী বদর প্রান্তরে যুদ্ধ-সম্ভার ও রসদ-পত্রের এই দৈন্যদশা সত্ত্বেও দ্বিতীয় হিজরীর ১২ই রমযান নবী করীম (সা.) আল্লাহর ওপর ভরসা করে মুষ্টিমেয় মুসলিম সৈন্য নিয়ে মদীনা থেকে যাত্রা করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)কে মসজিদে নববীর ইমাম এবং আবু লুবাবা (রা.)কে মদীনার প্রশাসনিক আমীর নিযুক্ত করলেন। নবী করীম (সা.) মুসলিম বাহিনীকে দু’ভাগ করলেন : আনসার ও মুহাজির।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button