অবরোধের একশ দিনে প্রাণ গেল ১৫৩ জনের

Hortalশামছুদ্দীন আহমেদ: বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের ডাকা ‘অনির্দিষ্টকালের অবরোধ’ গতকাল বুধবার ঠিক একশ দিন পূর্ণ করেছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে গত ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া এই অবরোধ এখনও বহাল আছে কী নাই-এনিয়ে অস্পষ্টতা দেখা দিয়েছে। কারণ অবরোধ প্রত্যাহারের বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি। ধুম্রজাল থাকলেও টানা হরতাল-অবরোধে আর্থিক ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে পেট্রোলবোমায় দগ্ধ অনেকে এখনও হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
অবরোধ-হরতালে ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এরইমধ্যে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছে। ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রকাশ উপলক্ষে বিশ্বব্যাংক গত রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, টানা হরতাল-অবরোধ, সহিংসতাসহ রাজনৈতিক অস্থিরতায় চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মোট দেশজ উত্পাদনে (জিডিপি) ১৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। তাই আগামী অর্থবছরে ১ শতাংশ কমে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দেয় বিশ্বব্যাংক।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত ৫ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করে, জানুয়ারি থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত আড়াই মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতায় উত্পাদন ব্যবস্থায় ৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। যা মোট জিডিপি’র দশমিক ৫৫ শতাংশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলে সমপরিমাণ পণ্য ও সেবা উত্পাদিত হতো, যা জিডিপিতে যোগ হয়ে এর আকার বড় করতো বলেও মনে করে সিডিপি।
সিপিডি’র তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৮১দিন অবরোধ ও ৬৭দিন হরতাল হয়েছে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বস্ত্রখাতে। এই খাতে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। এরপর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় পর্যটন খাতে, যার পরিমাণ ৮২৫ কোটি টাকা। সিপিডি এ-ও জানায়, হরতাল-অবরোধে ক্ষতির কারণে বহু কৃষক সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি।
আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি অবরোধে ব্যাপক প্রাণহানি ও আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এবারের অবরোধে পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধসহ বিভিন্নভাবে মারা যান ১৫৩ জন। এদের বেশিরভাগই খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, পেট্রোলবোমায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এখানে মোট ১৮১ জন ভর্তি হয়েছিলেন। এরমধ্যে ২২ জন চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান। চিকিত্সা নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যান ১৪১ জন। এদের ২জন পুনরায় এসে এই হাসপাতালে ভর্তি হন। নারী-শিশুসহ এই ইউনিটে এখনও ২০ জন চিকিত্সাধীন। এরমধ্যে ৩জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই তিনজনের মধ্যে খোকনের শরীরের ২০ শতাংশ, নিরঞ্জনের ৪২ ও রুবেলের শরীরের ২৫ শতাংশ পুড়ে গেছে।
১৪টি মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, পেট্রোলবোমায় দগ্ধদের কারও চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, কারও হাত ও কারও পা কেটে ফেলতে হয়েছে। কারও মুখমণ্ডল বিকৃত হয়ে গেছে। তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে বহু সময় লাগবে। বিশেষ করে তাদের পরিবারগুলোর ভবিষ্যত্ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। কারণ নিহত-আহতদের অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন।
প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে ডাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করে ওইদিন নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যেতে পুলিশি বাধা পেয়ে গুলশান কার্যালয়ের ফটকের ভেতরেই দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সামনে লাগাতার অবরোধের ডাক দেন খালেদা জিয়া। ওইদিন তিনি বলেছিলেন, ‘পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা না করা পর্যন্ত অবরোধ চলতে থাকবে’। এরপর ১৯ জানুয়ারি এবং সর্বশেষ গত ১৩ মার্চ দু’দফায় সংবাদ সম্মেলনেও তিনি বলেছেন, ‘যৌক্তিক পরিণতিতে না পৌঁছা পর্যন্ত অবরোধ চলবে।’
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়া গত ৫ এপ্রিল আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিয়ে গুলশানের বাসায় ফিরে যান। ৩ জানুয়ারি থেকে ঘটনাবহুল টানা ৯২ দিন গুলশানে নিজের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অবস্থানের পর খালেদা জিয়া বাসায় ফেরার দু’তিনদিনের মধ্যেই হরতালের কর্মসূচি দেয়া বন্ধ করে বিএনপিসহ ২০ দল। হরতাল থেকে বের হলেও অবরোধের বিষয়ে কোনো ঘোষণা বা বক্তব্য দেয়া হয়নি। অবশ্য এমনিতেই গত প্রায় এক মাস ধরে অবরোধ অনেকটাই ‘অকার্যকর’।
গত সোমবার খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে আসার পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের কাছে অবরোধ আছে কী নেই-জানতে চেয়ে প্রশ্ন রেখেছিলেন সাংবাদিকরা। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আর স্ট্রাইক (হরতাল) দিচ্ছি না, স্ট্রাইক আছে কিনা আপনারাই তো দেখতে পাচ্ছেন। আমাদের এখন পূর্ণ মনোযোগ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিকে।’ এরপর তিনি টেলিফোনে ইত্তেফাককে জানান, ‘অবরোধের বিষয়ে দলীয় চেয়ারপারসনের সঙ্গে তার কোনো আলাপ হয়নি।’
বাসায় ফিরে যাওয়ার পর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মঙ্গলবার নয়াপল্টনের কার্যালয়ে গেলেও অবরোধের বিষয়ে কিছু বলেননি খালেদা জিয়া। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এলেও অবরোধের মতো কর্মসূচি নিয়ে অস্পষ্টতা থাকা উচিত নয়, সংশ্লিষ্টদের উচিত বিষয়টি পরিষ্কার করা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button