হারিয়ে যাচ্ছে সকালের মক্তব

Maktabমুনীরুল ইসলাম: আমরা মুসলমান। আমাদের ধর্মীয় গ্রন্থ পবিত্র কোরআন। কোরআন আমাদের জীবন বিধানও বটে। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সারাজীবন কীভাবে কাটাতে হবে এর যাবতীয় বিষয় রয়েছে কোরআনে। এগুলো কোরআনের তর্জমা ও তাফসির পড়লে জানতে পারব। কোরআন এমন গুরুত্বপূর্ণ কিতাব, এর অর্থ না বুঝে পড়লেও প্রতি হরফের বিনিময়ে দশটি করে নেকি পাওয়া যায়। যেমন-কেউ যদি শুধু ‘আলিফ-লাম-মীম’ তেলাওয়াত করে, এই তিনটি হরফের বিনিময়ে তার আমলনামায় ৩০টি নেকি লেখা হবে। হজরত রাসূলে কারিম (সা.) বলেছেন, ‘নফল ইবাদতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উত্তম ইবাদত হলো কোরআন তেলাওয়াত করা।’ তাছাড়া এর বিশুদ্ধ তেলাওয়াত ছাড়া নামাজ হয় না।
এমন গুরুত্বপূর্ণ কোরআন তেলাওয়াত শেখার জন্য প্রয়োজন মানুষের শিশু বয়স এবং সকালবেলার মক্তব। মক্তব আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ পাঠশালা বা বিদ্যালয়। ছোট ভাইবোন, ছেলেমেয়ের কোরআন শেখার এবং ইসলাম সম্পর্কে প্রাথমিক মৌল জ্ঞানার্জনের উত্তম শিক্ষাকেন্দ্র হলো এ কোরআনি মক্তব। এখান থেকেই শিশুরা কোরআনের তেলাওয়াত শেখার পাশাপাশি নামাজ-রোজার নিয়ম-কানুন, জরুরি মাসআলা-মাসায়িল, দোয়া-কালাম ইত্যাদি শিখতে পারে। যারা মাদ্রাসায় পড়ে না, শিশুকালে তারা মক্তবে না গেলে পরে তাদের জন্য কোরআন-কালাম শেখা অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। এমনকি একশ্রেণীর মাদ্রাসায়ও কোরআনের তেলাওয়াত শেখার কোনো ক্লাস নেই। সে জন্য অনেকের এ ব্যাপারে অজানাই থেকে যায়। বর্তমানে অনেক মুরবি্বকে কোরআন পড়তে না পারায় আফসোস করতে দেখা যায়। অতি দুঃখে চোখের পানি ফেলতেও দেখা যায় কখনও কখনও। তাই সকালবেলার এই মক্তবের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা লিখে শেষ করার মতো নয়।
মক্তবের পরবর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো মাদ্রাসা। এখানে ইসলামী উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হয়। মুসলিম শাসনামলে বাংলায় মক্তব ও মাদ্রাসা চালু ছিল। তখন এগুলো সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হতো। সুলতানি ও মোগল আমলে শাসকরা মক্তব-মাদ্রাসা পরিচালনায় উদার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। বিখ্যাত দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল (রহ.) অনেক আফসোস করে যা বলেছেন এর সারমর্ম হলো, যদি এ মক্তব-মাদ্রাসাগুলো না থাকত, মুসলমানের সন্তানরা পশ্চিমা ইহুদি-খ্রিস্টানদের অন্ধ অনুকরণে নিজেদের মুসলমান পরিচয়ও হারিয়ে ফেলত। মুছে যেত মুসলমানদের আদর্শ, স্বকীয়তা, আত্মগৌরব। আমাদের দেশের বুজুর্গ মনীষী আলেম মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) এজন্যই বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার কোরআনি মক্তব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিছু কিছু গ্রামে করেছিলেনও। কিন্তু অত্যন্ত কষ্টের কথা হলো, এমন দরকারি মক্তবগুলো আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। এই শুভ্র-শান্ত সকালটাকে গিলে ফেলেছে আধুনিক শিক্ষার নামে নানা প্রতিষ্ঠান। যে সময়টাতে ছোট সোনামণিরা কায়দা-কোরআন বুকে জড়িয়ে যাওয়ার কথা মক্তব-মাদ্রাসায়, তখন একগাদা বইয়ে ঠাসা ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে ভিন্ন কোনো শিক্ষালয়ে।
কোথাও কোথাও মক্তবগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও যা-ও চালু আছে, সেগুলোতেও আগের মতো জৌলুস নেই। শিশুদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। নামেমাত্র চলছে সেগুলো। এভাবে চলতে থাকলে ইসলামী বুনিয়াদি শিক্ষার এ অবারিত ও ঐতিহ্যগত প্রতিষ্ঠান চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। পরিণত হতে পারে অতীত ইতিহাসে।
তাই আসুন, আমরা নিজ নিজ এলাকার ইসলামপ্রিয় সমাজপতি এবং দায়িত্ববান অভিভাবকদের সঙ্গে পরামর্শ করে এ প্রভাতি মক্তবগুলো জমজমাট রাখার ব্যবস্থা করি। চালু করি বন্ধ হয়ে যাওয়া মক্তবগুলো। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে তুলি নতুন নতুন কোরআনি মক্তব। আগামী প্রজন্মকে গড়ে তুলি আফসোসহীন বিশুদ্ধ কোরআন তেলাওয়াতকারী হিসেবে। আর নূরানি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ শিক্ষকের মাধ্যমে এ মক্তবগুলো পরিচালনার উদ্যোগ নিই। এতে আমাদের দ্বারা দেশ ও দেশের মানুষ খুবই উপকৃত হবে এবং ইসলামের বিশাল খেদমতের ব্যবস্থা হবে। -আলেম ও কবি

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button