সিআইএর নির্যাতন ও মার্কিন মানবাধিকার মুখোশ

CIAমুহাম্মদ খায়রুল বাশার:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটের গোয়েন্দা কমিটি সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর জিজ্ঞাসাবাদ কৌশল নিয়ে ছয় হাজার ৭০০ পৃষ্ঠার পূর্ণ প্রতিবেদন এবং ৫০০ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০০১ সালের ‘নাইন-ইলেভেন’ হামলার পর আটক আলকায়েদার সাথে যুক্ত সন্দেহে আটক বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়েছিল সিআইএ। আর এভাবে ভয়ঙ্কর কৌশলের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া ভুল তথ্য দিয়ে আলকায়েদা ও সন্ত্রাসী হুমকি সম্পর্কে হোয়াইট হাউজ ও মার্কিন কংগ্রেসকে বিভ্রান্ত করেছিল সিআইএ। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে বহু বন্দীকে জিজ্ঞাসাবাদে সিআইএ যে গোপন কার্যক্রম চালিয়েছিলÑ প্রতিবেদনটিকে তার বড় প্রমাণ হিসেবে দেখা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বারাক ওবামা ২০০৯ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বিতর্কিত এই জিজ্ঞাসাবাদ পদ্ধতি বাতিল করেন। তিনি এই জিজ্ঞাসাবাদকে নির্যাতন বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন।
এই জিজ্ঞাসাবাদ কৌশল তথা সিআইএর বন্দী নির্যাতনের কিছু নমুনা এখানে উপস্থাপন করা জরুরি মনে করছি। সিআইএর আটক ১১৯ জনের মধ্যে অন্তত ২৬ জনকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। এর মধ্যে নিরপরাধ আবু হুজাইফাকে বরফপানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিল। তাকে ৬৬ ঘণ্টা ঘুম ছাড়া দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। পরে প্রমাণ হয়, ভুল মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সিআইএর হাতে প্রথম আটক আবু জোবাইদাকে ২৬৬ ঘণ্টা একটি ছোট কফিন বক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল। খালিদ শেখ মোহাম্মদকে ১৮৩ বার ঠাণ্ডা পানিতে চুবানো হয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করলে ঠোঁট চেপে ধরে মুখে অবিরাম পানি ঢেলেছে জিজ্ঞাসাবাদকারীরা। ভুল করে আটক ২৬ বন্দীকে নির্যাতন করে তাদের চিৎকার রেকর্ড করে কয়েকজনের আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠিয়েছে সিআইএ। এক হাতকড়া পরানো বন্দীকে উলঙ্গ করে ৭২ ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে তার পুরুষাঙ্গে একটানা ঠাণ্ডাপানি ঢালা হয়েছে। পায়ে গুলি করে এক বন্দীর দুই পা খোঁড়া করে দেয়া হয়। বুলেটবিদ্ধ পায়ের চিকিৎসা দূরে থাক, তাকে নির্দেশ দেয়া হয় দাঁড়িয়ে থাকতে। উলঙ্গ করে দুই হাত বেঁধে ভাঙা পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ১৮০ ঘণ্টা ঘুমহীন রেখে পালাক্রমে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়। এ সময় অট্টহাসি দিয়ে দম্ভ করে বলা হয়, ‘তোকে জীবন্ত বের হতে দেবো না, কিন্তু শিগগির মেরেও ফেলব না। পৃথিবী কোনো দিন জানবে না তোর সাথে আমি কী করেছি।’
এভাবেই বন্দীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। ডেইলি মেইলের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সারা বিশ্ব থেকে সন্ত্রাসী সন্দেহে অন্তত ১০০ ইসলামি ব্যক্তিত্বের ওপর এই ভয়ানক নির্যাতন চালানো হয়েছে। সিআইএর বন্দী নির্যাতন নিয়ে প্রকাশিত সিনেট গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে লিখিত ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, একজন বন্দীকে ২৬৬ ঘণ্টা ছোট কফিন বক্সে হাত-পা মুড়ে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। কাউকে কাউকে মলমূত্র খেতে বাধ্য করা হয়েছে। কারো পায়ুপথে ঢোকানো হয়েছে পানি। এ সময় চিৎকার করে বন্দীর মাকে ধরে এনে যৌন নির্যাতনের হুমকি দেয়া হয়েছে।
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে মানবতার ওপর বর্বর নির্যাতন চালানোর প্রতিবাদে বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বন্দীদের ওপর অমানবিক ও বর্বর নির্যাতন চালানোর দায়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার দাবি করেছে জাতিসঙ্ঘ। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত বেন এমারসন বলেছেন, সিনেটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিআইএর জিজ্ঞাসাবাদের কৌশল সংস্থাটির উচ্চপর্যায় থেকে নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই তাদেরকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় আনা প্রয়োজন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের অনুমতিক্রমেই আটক কথিত জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদে এসব অত্যাচার চলত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সিআইএ জনগণকে মিথ্যা বলে তাদের অপকর্ম আড়াল করার চেষ্টা করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বর্বরতার সাথে জড়িতদের শাস্তি দাবি করে ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন, জার্মানি, চীন, আফগানিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও পাকিস্তান। বন্দীদের ওপর সিআইএর নির্যাতনের সব কিছু সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ জানতেন বলে জানিয়েছেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি। ফক্স নিউজের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কোনো কিছুই প্রেসিডেন্টের অজানা ছিল না।
এ দিকে সিআইএর বর্বর নির্যাতনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন সংস্থাটির বর্তমান পরিচালক জন ব্রনান। তিনি দাবি করেন, সিআইএর কর্মীরা নির্যাতনের মাধ্যমে সঠিক কিছু তথ্য বের করতে সক্ষম হন। তবে জিজ্ঞাসাবাদের কিছু পদ্ধতিকে ‘রূঢ়’ ও ‘জঘন্য’ বলে স্বীকার করেন তিনি। তবে ব্রনানের যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছেন মার্কিন সিনেটর ও প্রতিবেদন সংক্রান্ত কমিটির প্রধান ড্যানি ফেইনস্টেইন। এক টুইট বার্তায় তিনি এই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সিনেটের রিপোর্টে বলা হয়, সিআইএর সিনিয়র কর্মকর্তারা ২০০৫ সালে বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও টেপগুলো ধ্বংস করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তারা বুঝতে পারেন নিরপেক্ষ তদন্ত করলে এসব অপকর্ম বেরিয়ে আসবে।
সিআইএ মনে করে, তারা দেশকে ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী হামলা থেকে রক্ষা করার জন্যই এ ধরনের জিজ্ঞাসাবাদের পথ বেছে নিয়েছিল। তাই আমলাতান্ত্রিকভাবে সিআইএ বন্দীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এ ধরনের নির্যাতনের কৌশল নিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট বুশের আমলের মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি এনবিসি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সিআইএর নির্যাতনের ব্যাপারে সাফাই গেয়ে পৈশাচিক নির্যাতনকারী সিআইএর কর্মকর্তাদের বীর বলে দাবি করেছেন। ডিক চেনি বলেন, ‘আমি পুরোপুরি শান্তি পাবো যদি তাদের প্রশংসা করা হয়’। তিনি তাদের সম্মানিত করা উচিত বলে দাবি করেন।
এট সবাই জানে যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে ইরাকে হামলা চালিয়েছে। এরপর তারা আবুগারিব কারাগারসহ ইরাকের বিভিন্ন কারাগারে কী লোমহর্ষক নির্যাতন চালিয়েছিল, সেসব খবরও বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিল। আবুগারিব কারাগারে নারীরা ধর্ষণেরও শিকার হয়েছিল। বুশ এবং রিপাবলিকানরা কী নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিল বিশ্ববাসী তা দেখেছে। সিআইএর জঘন্য মানবাধিকার লঙ্ঘন বিশ্বব্যাপী ধিকৃত হয়েছে। বিশেষভাবে ইসলামের অনুসারীদের বিরুদ্ধে তথাকথিত ‘ক্রুসেড’ ঘোষণা করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ নিরস্ত্র বন্দীদের ওপর যেভাবে সিআইএর গোয়েন্দাদের লেলিয়ে দিয়েছিলেনÑ তাতে আমেরিকানদের তথাকথিত মানবাধিকারের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশের আমলের সিআইএর এসব জঘন্য কর্মকাণ্ডসংক্রান্ত রিপোর্ট আগামী মার্কিন নির্বাচনেও প্রভাব ফেলতে পারে। এটা রিপাবলিকানদের ফেলতে পারে বেকায়দায়। পর্যবেক্ষক মহল আশা করে, যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে গুয়ানতানামো বে বন্দিশিবিরসহ বিভিন্ন কারাগারে সিআইএর জঘন্য নির্যাতন কৌশল পরিত্যাগ করে সঠিক পথে ফিরে আসবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button