বাগদত্তার মৃত্যুতে যেভাবে ইসলামের পথে মারিয়া

Mariaআমেরিকার কলোরাডোর মেয়ে মারিয়া। আমেরিকার অন্যান্য খ্রিস্টান কিংবা নাস্তিক মেয়েদের মতই তিনিও পার্টিতে যেতেন, নাচ গান কিংবা মদপানে মেতে উঠতেন।
হঠাৎ ভাগ্যচক্রে এক পাকিস্তানি যুবকের সাথে পরিচয় ঘটে তার। তার স্কুলজীবনের ঠিক শেষের দিকটায়।
পরিচয়ের পর সখ্য, তারপর একসময় তাদের মধ্যে বাগদান সম্পন্ন হয়। কিন্তু একদিন মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন সেই পাকিস্তানি যুবক।
যুবকটির উত্তম চরিত্র ও ব্যবহার তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পরে কালেমা পাঠ করে মুসলিম হন মারিয়া।
মারিয়া তার জীবনের এই পটপরিবর্তন নিয়ে অনইসলাম ডটকমকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। তার এই সাক্ষাৎকারটি পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হল-
আমি মারিয়া। এক বছর আগে আমি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছি। আমার জন্ম কলোরাডোর বোল্ডার শহরে। এখানেই আমি আমার স্কুল জীবন কাটিয়েছি।
আমার বাবা-মা দু’জনেই দক্ষিণ আফ্রিকান। তারা এখানে অভিবাসী। তাদের দু’জনেরই ধর্মে বিশ্বাস নেই। তারা উভয়েই নাস্তিক। সঙ্গত কারণেই আল্লাহর প্রতি তাদের কোন বিশ্বাস নেই।
আমার একমাত্র ভাই যিনি কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিষয়ে অধ্যয়নরত। তিনি একজন ক্যাথলিক।
ইসলাম গ্রহণের আগে বাবা-মার মত আমারও আল্লাহতে কোনো বিশ্বাস ছিল না। আমারও কোনো ধর্ম ছিল না এবং ধর্মের প্রতি কোনো বিশ্বাসও ছিল না।
আমার বাবা-মা আমাকে যা শিক্ষা দিয়েছে তাই শিখে বড় হয়েছি। যে কারণে আল্লাহর প্রতি আমার বিশ্বাস জন্মায়নি। ধর্ম বলে যে কোনো কিছু আছে তা মোটেই বিশ্বাস করতাম না।
মনে পড়ে, আমাদের পরিবারে যদি ধর্ম নিয়ে কোনো আলোচনা হত, তবে প্রায় এর নেতিবাচক দিকগুলো নিয়েই আলোচনা হত। ধর্ম যে প্রকৃতই ভাল কিছু, আগে তা বুঝতে পারিনি। তখন আমি ভাবতাম, এটি সেই জিনিস যা অনেক সমস্যার কারণ। এটিকে পৃথিবীর সকল যুদ্ধ এবং যুদ্ধের উপাদান বলে মনে করতাম। এককথায় ধর্মকে পুরোপুরি নেতিবাচক হিসেবে দেখতাম।
ইসলামের সাথে পরিচয়
দু’ থেকে তিন বছর আগে প্রথম ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারি। পাকিস্তানি এক তরুণের সাথে আমার পরিচয় হয় এবং এর পর আমরা উভয়েই ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে যাই। তিনি ছিলেন আমার বাগদত্তা। পাকিস্তান থেকে তার সাথে আমার কথা হত এবং তার মাধ্যমেই আমার ইসলামের সাথে প্রথম পরিচয়।
তার কারণেই আমি ইসলাম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হই। এরপর থেকেই ইসলামকে নেতিবাচকভাবে না ভেবে ইতিবাচকভাবে দেখতে থাকি। আমি আসলে এ বিষয়ে মোটেই জানতাম না। তার সাথে এবং আরো অন্যান্য লোকের সাথে কথা বলার পর আমি ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠি।
এ সম্পর্কে নানাবিধ তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি। আমি কুরআনের একটি ইংরেজি কপি কিনে এটি পড়তে শুরু করি।
যখন আমি আমার বাগদত্তার সাথে কথা বলতাম, আমরা ধর্ম সম্পর্কে কোনো কথা বলতাম না। আমি তাকে মুসলিম কিংবা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতাম না।
আমি তাকে কেবল একজন মহৎ ও দয়ালু লোক হিসেবেই ভাবতাম। আমার দেখা ভাল মানুষগুলোর মধ্য তিনি ছিলেন সবচে’ ভাল মানুষ। তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্রের এবং সবার প্রতি দয়াশীল।
কাউকে তিনি অপছন্দ করলেও তাদের কারো সাথে কখনও খারাপ আচরণ করতেন না। যে কারণে তিনি ছিলেন তাদের কাছে প্রিয়পাত্র। তিনি সরাসরি কারো মুখের দিকে তাকাতেন না।
আমি তাকে নিয়ে ভাবলেও তার এই গুণাবলী সর্ম্পকে ভাবতাম না। আমি কেবলমাত্র ভাবতাম, ভাল মানুষ হওয়ার কারণেই তিনি এই গুণাবলীর অধিকারী।
কিন্তু পরে আমি যতই এটি সম্পর্কে চিন্তা করতাম, ততই আমি উপলব্ধি করতে পারি যে, তার মধ্যে থাকা এই গুণাবলী কেবলমাত্র ইসলাম বিংবা একজন মুসলিম হওয়ার কারণেই।
কারণ তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মুসলিম। প্রকৃতপক্ষে জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন অনেক বেশি হৃদয়বান ও খোলা মনের এবং শ্রেষ্ঠ একজন মানুষ।
আসলে তার এই গুণাবলীর কারণেই আমি ইসলামকে পছন্দ করতে শুরু করি এবং আমি সিদ্ধান্ত নেই মুসলিম হওয়ার। এর পর তার সাথে আমার বাগদান হয়।
তিনি ছিলেন আমার বাগদত্তা। একদিন আমি আরিজোনায় আমার স্কুলে যাচ্ছিলাম। এমনি সময় তিনি আমার সাথে দেখা করতে আসছিলেন।
কিন্তু তার সেই আসা আর হয়নি। আসলে তিনি বোল্ডার থেকে ড্রাইভিং করে আরিজোনায় আসার পথে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েন এবং মারা যান।
এটি ছিল মৃত্যুর সঙ্গে আমার প্রথম বাস্তব অভিজ্ঞতা। তার এই মৃত্যুর ঘটনাই আমাকে অনুপ্রাণিত করে আরো বেশি করে ইসলামকে জানার জন্য। কারণ আমি তার সর্ম্পকে যতটুকু জানতাম, তার মাঝে এর চেয়েও বেশি কিছু ছিল।
কুরআনের প্রভাব
আমি কুরআন এবং ইসলাম সর্ম্পকিত একাধিক বই পড়েছি। এ সম্পর্কে অনেক লোকের সাথে কথা বলেছি।
যত দূর মনে পড়ে, তিনি মারা যাওয়ার ২ মাস পর একদিন আমি কুরআন পড়ছিলাম এবং এটি পড়ার পর আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হতে থাকে।
আমি এটি পড়ে বুঝতে পারি যে, সবকিছুই সৃষ্টি হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান দিয়ে। এটি পাঠ করার পর মুহূর্তেই আমার সামনে অনেক কিছু উন্মোচিত হয়ে পড়ে। আমি বুঝতে পারি যা আমি দেখেছি, তার সম্পর্কে যা কিছু জেনেছি এবং যে সমস্ত ঘটনা ঘটেছে তার সবকিছু সম্পর্কে।
এরপর আমি একটি সিদ্ধান্তে আসি, এই পবিত্র গ্রন্থ থেকে যা জানলাম তার সবটাই সঠিক।
আমার মনে আছে, প্রথমবার আমার কালেমা পাঠ করার সময় আমি একাকিই এটি পাঠ করেছিলাম। কেননা ঐ সময়ে আমি অনুভব করতে পারি যে, সবকিছুই তৈরি হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান দিয়ে।
পরে বিষয়টি নিয়ে আমি আমার কয়েকজন মুসলিম বন্ধুর সাথে কথা বলি। তারা আমাকে ডেনভারের এক শেখের কাছে যেতে উৎসাহিত করে। এর পর আমি সেখানে যাই এবং তার সাথে কথা বলি।
আমি তার সাথে কথা বলার পর কালেমা পাঠ করতে চাইলাম। কিন্তু তিনি একটি বিষয় নিশ্চিত হতে চাইলেন যে, আমি এটি কারো জন্য করছি কিনা।
আমি তাকে নিশ্চিত করলাম, ‘হ্যাঁ, এটি আমার জন্যই।’ এর পর আমার দু’জন বন্ধুকে সাক্ষী রেখে, আমি তার সাথে কালেমা পাঠ করলাম।
আমার এ বিষয়টি নিয়ে আমার পিতা-মাতার সাথে খুব বেশি কথা হতো না, কারণ আমি মনে করতাম ধর্মের প্রতি তারা খুব বেশি আগ্রহী নয়।
গত রমজানে তারা বুঝতে পারে যে, আমি ইসলাম সম্পর্কে কতটা সিরিয়াস এবং আমি রমজানের প্রতিটি রোজাই পালন করেছি।
এটি ছিল আমার প্রথম রোজা পালন এবং যে কারণে এটি আমার জন্যে একটু কঠিন ছিল। তবে কষ্ট হলেও আমি সবগুলোই পালন করেছি।
পরিবারে এই সম্পর্কে আমরা খুব বেশি কথা বলতাম না। কিন্তু তারা একসময় এটিকে মেনে নেয়।
আমি মনে করি, আমার ভালবাসার মানুষটির সাথে যদি আমার সাক্ষাত না হতো, তাহলে হয়তো ইসলাম সম্পর্কে আমার কখনও জানা হতো না এবং আমার ইসলাম গ্রহণ করাও হতো না।
ধর্মান্তরিত হওয়ার পূর্বে আমি বিভিন্ন পার্টিতে যেতাম এবং পার্টিতে সাধারণত যা হয় তাই করতাম। আমি বলতে চাচ্ছি যে আমি ছিলাম ভিন্ন রকমের।
ধর্মান্তরিত হওয়ার পর বুঝতে পারি, আমারও একটি নিষ্কলঙ্ক অতীত ইতিহাস ছিলো কিংবা থাকতে পারত। আমিও একটি নিষ্কলঙ্ক পথে জীবন শুরু করতে পারতাম।
মুসলিম হওয়ার পূর্বে যে খারাপ কাজগুলো আমি করেছি তা অনুভব করতে পারি।
আমার মা-বাবা ও বন্ধুরা
ধর্মান্তরিত হওয়ার পর আমার পরিচিত অনেককেই ইসলামের পথে আনতে সক্ষম হয়েছি। আমার বন্ধুদের অধিকাংশই এখন মুসলিম।
আমরা সব বন্ধুরা মিলে একসাথে চলি, একই সাথে কোনো অনুষ্ঠানে যাই এবং প্রতি শুক্রবার রাতে আমরা একসাথে মিলিত হই। আমার বন্ধুরা সবাই অনেক ভাল। তারা আমাকে ব্যাপকভাবে সাহায্য করে।
আমি বিয়ে নিয়ে মাঝে মাঝে ভাবি। আমি এ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নই। আমার বিশ্বাস ঠিকই আমি আমার যোগ্য ব্যক্তিকে পেয়ে যাব এবং নিশ্চিতভাবেই সে হবে একজন মুসলিম
এখন আমি আর কারো সাথে ডেটিংয়ে আগ্রহী নই, কেননা এটি একজন মুসলিমের জন্য বৈধ নয়।
আসলে আমার বাবা-মা ধর্মান্তরিত হওয়ার পর আমার আচরণে খুবই খুশি। আমাকে নিয়ে এখন আর তাদের খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না কারণ তারা জানে আমি খারাপ কিছু করছি না। আমার ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর থেকে আমার আচরণ সম্পর্কে প্রকৃতপক্ষে তারা খুবই খুশি।
প্রথম যখন আমি হিজাব পরিধান করি, স্পষ্টভাবেই এটি আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল। বিশেষ করে ক্লাসে। ক্লাসের সবাই আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে থাকত।
এখানে হিজাব পরা আরো অন্যান্য মেয়েরাও ছিল। তবে তাদের মধ্যে আমিই ছিলাম হিজাব পরা একমাত্র আমেরিকান মেয়ে। এটি পরিধান করে এখন আমি প্রতি মুহূর্তেই গর্ববোধ করি।
আমি হিজাব পরে স্বস্তিবোধ করি। আমি মনে করি এটি এখন আমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হিজাব পরিধান করলে নিজেকে অনেক বেশি নিরাপদ মনে হয়।
হিজাব পরে যখন আমি মা-বাবার সাথে বাইরে বের হই, আমার মনে হয় না তারা এ নিয়ে বিব্রত হয়। আমার বিশ্বাস তারা বরং এটি নিয়ে গর্বিত।
আমার অভিভাবকরাও সম্ভবত এটি মনে করেন যে, আমার মত অন্যরাও যেন হিজাব পরিধান করে। প্রকৃতপক্ষে হিজাব পরিধান উত্তম রুচির পরিচয় বহন করে এবং এটি নিজের ব্যক্তিত্বকেও ফুটিয়ে তোলে।
অনইসলাম অবলম্বনে রাহুল আমীন

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button