শেষ হলো ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন

Saarcছত্রিশ দফা কাঠমান্ডু ঘোষণা ও জ্বালানি সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে সম্মেলনের শেষ দিন বৃহষ্পতিবার বিকেলে সার্ক নেতারা জ্বালানি চুক্তিটিতে স্বার করেন। এ দিকে, আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা চুক্তির বিষয়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে সদস্যদেশগুলোর পরিবহন মন্ত্রীরা বৈঠকে বসবেন বলে জানিয়েছেন সার্কের নতুন চেয়ারম্যান নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা। পরবর্তী শীর্ষ সম্মেলন হবে ২০১৬ সালে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে। খবর এপি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি, বাসস-এর।
নির্ধারিত সময়ের প্রায় আধা ঘণ্টা পরে বৃহষ্পতিবার স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৪টায় সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশন শুরু হয় নেপালের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। এরপরই নেপালের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপনী অধিবেশনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
শুরুতে সার্কভুক্ত আট দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা জ্বালানি সহযোগিতা চুক্তিতে (এগ্রিমেন্ট অব এনার্জি কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক) স্বার করেন। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তেশেরিং তোবগে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা সিটি হলে চুক্তি স্বার অনুষ্ঠান প্রত্য করেন।
এরপর নেপালের প্রধানমন্ত্রী সমাপনী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী বক্তব্য দেন। এরপরই পরবর্তী ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক দেশ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সমাপনী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন।
জ্বালানি সহযোগিতা চুক্তি :
স্বারিত জ্বালানি সহযোগিতা চুক্তিতে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে এক দেশের বিদ্যুৎ সহজেই অন্য দেশ কিনতে পারবে।
ফলে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বাজার গড়ে তোলার প্রোপট যেমন তৈরি হলো, তেমনি এই চুক্তি হয়ে রইলো এবারের সম্মেলনের প্রধান প্রাপ্তি।
জ্বালানি চুক্তির পাশাপাশি সার্ক আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা চুক্তি এবং সার্ক পণ্য ও যাত্রীবাহী মোটরযান চলাচল চুক্তির আশা নিয়ে শুরু হয়েছিল এবারের সার্ক সম্মেলন।
শীর্ষ সম্মেলন শুরুর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জোর আলোচনা চললেও প্রথম দিনটি নিষ্ফলাই থেকে যায়। পাকিস্তান প্রস্তুত নয় জানিয়ে আপত্তি জানালে আটকে যায় চুক্তিগুলো।
সার্ক সচিবালয়ের এক কূটনীতিক বলেন, বৃহষ্পতিবার সকালে অবকাশ বৈঠকে সব দেশের প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে একমত হন। ফলে সমাপনী অনুষ্ঠানেই তা স্বার করা সম্ভব হয়।
এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবদের বৈঠকে চুক্তিটির বিষয়ে সব সদস্য দেশ একমত হতে পারেনি। ফলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের প্রথম দিন চুক্তি স্বারের বিষয়টি অনুষ্ঠান সূচিতে থাকলেও চুক্তি ছাড়াই অনুষ্ঠান মুলতবি করা হয়।
গতকাল সকালে কাঠমান্ডু শহরের ৩০ কিলোমিটার দূরে বিনোদন কেন্দ্র দোয়ারিকাস পরিদর্শনে যান নেতারা। সম্মেলনের অবকাশ কর্মসূচির এই অনুষ্ঠানের আলোচনাতেই সার্ক নেতারা চুক্তিটি সই করতে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেন।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সন্ত্রাস দমনে গুরুত্ব কৈরালার : সমাপনী অধিবেশনে দেয়া বক্তব্যে নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা বলেন, আমাদের সময় এসেছে দণি এশিয়াকে সামনে এগিয়ে নেয়ার। এ লক্ষ্যে সবাইকে সমানভাবে অংশীদার হয়ে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, সম্ভাবনাময় দণি এশিয়া করতে যোগাযোগ উন্নয়নসহ একই স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সন্ত্রাস দমনসহ নিরাপদ এশিয়া গড়ার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
কাঠমান্ডু ঘোষণা : ৩৬ দফা কাঠমান্ডু ঘোষণায় দণি এশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার ল্েয অবাধ বাণিজ্য চালু, সার্ক উন্নয়ন তহবিল, যোগাযোগ, জ্বালানি, কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা, পরিবেশ, সাগর অর্থনীতি, ২০১৫ সাল-পরবর্তী উন্নয়ন এজেন্ডা, স্বাস্থ্য, শিা, অভিবাসন, পর্যটন, সন্ত্রাসবাদ, সুশাসন, সার্ক সচিবালয়সহ সার্কের প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার মতো বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এসেছে।
ঘোষণায় দণি এশিয়ায় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সার্ক নেতারা নিজেদের সহযোগিতা জোরদারে অঙ্গীকার করবেন। এ ল্েয তারা সহযোগিতা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জ্বালানি, নিরাপত্তা, অবকাঠামো, যোগাযোগ খাতের বিভিন্ন প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে- ফলাফলভিত্তিক এমন প্রকল্প, কর্মসূচি ও কার্যক্রম নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কাঠমান্ডু ঘোষণায় ইতঃপূর্বে সই হওয়া চুক্তি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সার্ক সচিবালয়ের মতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।
পরবর্তী সম্মেলন পাকিস্তানে :
পরবর্তী সার্ক শীর্ষ সম্মেলন ২০১৬ সালে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হবে। ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের চেয়ারপারসন নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা বৃহষ্পতিবার বিকেলে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে এ ঘোষণা দেন।
পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ২০১৬ সালে ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ হবে পাকিস্তান।
নেপালের প্রধানমন্ত্রী পরবর্তী সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে স্বাগতিক দেশ হতে প্রস্তাব করায় পাকিস্তানকে ধন্যবাদ জানান।
পরে এক ধন্যবাদ ভোটে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পরবর্তী সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের স্বাগতিক দেশ হিসেবে পাকিস্তানকে নির্ধারণ করায় সার্ক সদস্যদেরকে ধন্যবাদ জানান।
কে কখন এলেন :
সমাপনী অধিবেশনে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে সবার আগে সম্মেলনস্থলে আসেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি। তাকে স্বাগত জানান নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা। এর পরপরই সিটি হলে আসেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী তেশেরিং তোবগে ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পরপরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবেশ করেন সিটি হলে। প্রায় সাথে সাথেই আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
এ দিকে নির্ধারিত সময়ের প্রায় ২৫ মিনিট পর সমাবেশস্থলে আসেন মালদ্বীপের প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ ইয়ামেন আবদুল গাইয়ুম। আর নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৩০ মিনিট পরে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহেন্দা রাজাপাকসে সম্মেলনস্থলে পৌঁছান।
অন্যান্য চুক্তির খসড়া :
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি চুক্তি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখলেও বাকি দু’টি চুক্তি সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য সার্ক আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা চুক্তি এবং সার্ক পণ্য ও যাত্রীবাহী মোটরযান চলাচল বিষয়ক চুক্তির বিষয়ে আগামী তিন মাসের মধ্যে কাউন্সিল অব মিনিস্টারদের সভায় আলোচনা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সড়কপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে প্রস্তাবিত ‘মোটর ভেহিকলস অ্যাগ্রিমেন্ট’-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, এর আওতায় পণ্য ও মালামাল পরিবহনের জন্য ‘কার্গো ভেহিকল’, যাত্রী বহনের জন্য নিয়মিত বাস সার্ভিস এবং পিকনিক, স্টাডি ট্যুর, সামাজিক অনুষ্ঠান বা এ ধরনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণকারীদের বহনকারী যানবাহন সীমান্ত পেরিয়ে সদস্য দেশগুলোতে যাতায়াত করতে পারবে।
‘সার্ক রিজিওনাল রেলওয়েজ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর সার্ক মেম্বারস স্টেটস’-এর খসড়ায় কয়েকটি রুট ব্যবহার করে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান ও পাকিস্তানের মধ্যে আন্তঃদেশীয় রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনের কথা বলা হয়।
জ্বালানি সহযোগিতা চুক্তি সইয়ের পর জোটের নতুন চেয়ারম্যান নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা বলেন, অচিরেই সার্ক আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা চুক্তি এবং সার্ক পণ্য ও যাত্রীবাহী মোটরযান চলাচল চুক্তি স্বারিত হবে।
এ জন্য আগামী তিন মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পরিবহনবিষয়ক মন্ত্রীরা বৈঠকে বসবেন বলে জানান তিনি।
‘শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য গভীর সংযোগ’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে তৃতীয়বারের মতো সার্ক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। ১৯৮৭ সালে প্রথম এবং দ্বিতীয়বার ২০০২ সালে সার্ক সম্মলনের আয়োজন করেছিল দেশটি। সর্বশেষ সার্কের ১৭তম সম্মেলনটি হয়েছিল মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে। ১৯তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button