মাদকের বিষাক্ত ছোবল

Madokহাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর: আজকের প্রজন্ম আগামী দিনের কর্ণধার। তাদের নিয়ে জাতি স্বপ্ন দেখে সুস্থ সমাজ বিনির্মাণের। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয়, আজ সেই প্রজন্মের উঠতি বয়সের অনেকেই অনৈতিকতা ও অপসংস্কৃতির ভয়াল ছোবলে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। নানা অপরাধ- অপকর্ম ফেরি করেই চলছে তাদের জীবনযাত্রা। কেবল অপসংস্কৃতির চর্চাই নয়; ইয়াবা, হেরোইন, গাজা, মদসহ নেশা সৃষ্টিকারী প্রবল ক্ষতিকর দ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয় ও সেবন চরম উদ্বেগজনকহারে বেড়ে চলেছে। গত ১২ অক্টোবর দৈনিক ইনকিলাবে “বিপথগামী তরুণ প্রজন্ম” শীর্ষক এক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী “বাংলাদেশে বর্তমানে ৯০ লাখ মাদকাসক্ত। সরকারী হিসাব মতে এ সংখ্যা ৫০ লাখ। এদের ৯১ শতাংশই কিশোর ও তরুণ। একই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মাদক নিরাময় কেন্দ্র নিউ মুক্তি ক্লিনিকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে মাদকাসক্তের শতকরা ৯০ ভাগ মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ছাত্র- ছাত্রী।”
এভাবে নবপ্রজন্মের বৃহৎ এক অংশ মাদকের করাল গ্রাসে নিমজ্জিত হওয়ায় সমাজ আজ বিষাদের কাল ছায়ায় আচ্ছন্ন। ধর্মীয় মূল্যবোধ, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা, মানবিক সৌহার্দ- স¤প্রীতি, ও পারিবারিক বন্ধন এখন বিপন্ন প্রায়। প্রতিনিয়ত মাদকাসক্তদের হাতে কোন না কোন জায়গায় কেউ না কেউ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এমনকি শান্তি-সম্প্রীতির জনপদ খ্যাত রামুতেও সম্প্রতি মাদকাসক্ত ভাইয়ের হাতে আপন বড় বোন এবং বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন হওয়ার মত মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনাও ঘটেছে। (দৈনিক কক্সবাজার ১১ অক্টোবর’১৪ইং, দৈনিক পূর্বদেশ ১২ অক্টোবর’১৪ইং দ্রষ্টব্য)।
শুধু এগুলি নয়; পুরো দেশে প্রায় প্রতিদিন মাদকের এহেন বিষাক্ত থাবায় অহরহ প্রাণহানি ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। বাড়ছে সামাজিক অপরাধ ও পারিবারিক কলহ। মাদক সেবনের প্রয়োজনীয় খরচ জোগাড় করতে অনেক মাদক সেবনকারীরা চুরি- ছিনতাইয়ের মত অপরাধও সংঘটিত করছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ ভাষ্যেও এমনটাই ফুটে উঠেছে।
“সমাজ বিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা সামাজিক ও পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধির জন্য প্রধানত দায়ি করেছেন সারা দেশে মাদকের অবাধ বিস্তারকে।” (দৈনিক আমাদের সময়, ১২ অক্টোবর’১৪ইং)। “ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক শিক্ষার অপরিপূর্ণতা, আকাশ সংস্কৃতি, প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং নৈতিক শিক্ষার অভাবেই দিন দিন এ সব অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সমাজ বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীরা। তাদের মতে এর ভয়াল থাবা পড়ছে তরুণ তরুণীদের উপর। ফলে ভবিষ্যতের কারিগররা একদিকে যেমন গড়ে উঠছে অনৈতিকতা ও মাদকের উপর ভর করে, তেমনি হ্রাস পাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতাও।” (দৈনিক ইনকিলাব ১২ অক্টোবর’১৪ইং)। এছাড়াও মাদক শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও চরম ক্ষতিকর বলে চিকিৎসকদের অভিমত।
মাদকের এই বিষাক্ত কুফল থেকে দেশ ও জাতি যাতে নিরাপদ থাকে সেই জন্য সব ধর্মেই মাদক দ্রব্যের ব্যবহার নিষিদ্ধ। মানব জাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ইসলামে মাদককে শান্তি-সম্প্রীতি বিনষ্টের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে এর ক্রয়- বিক্রয় ও সেবনকে সমান অপরাধ হিসাবে তুলনা করা হয়েছে। পবিত্র কুরআন মজীদে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, “অবশ্য শয়তান মদ ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে এবং তোমাদেরকে আল্লাহর যিকির ও নামায থেকে বিরত রাখতে চায়। অতএব তোমরা কি নিবৃত্ত হবে না!” (সূরা মায়িদা, আয়াত ৯১)। মানবতার মুক্তির অগ্রদূত বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) মাদককে সব পাপাচারের চাবি হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। হযরত আবু দারদা (র.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, “মদ্যপান করোনা কেননা তা হচ্ছে সকল পাপাচারের চাবি।” (ইবনে মাজাহ)। রাসুলে কারীম (স.) ইরশাদ করেন, “সবধরণের নেশা সৃষ্টিকারী দ্রব্য হারাম।” (ইবনে মাজাহ)। তিনি ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা’আলার ওয়াদা আছে, যে ব্যক্তি নেশা সৃষ্টিকারী দ্রব্য পান করবে আল্লাহ তাকে “তীনাতুল খাবাল” থেকে পান করাবেন। সাহাবীগণ (র.) জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (স.) “তীনাতুল খাবাল” কি? উত্তরে বললেন, তা হচ্ছে দোযখের পুঁজ।” (মুসলিম)
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, মাদক শুধু ইহজীবনে নয়; পরজীবনেও ভয়াবহ কুফল বয়ে আনবে। তাই মাদকের এই বিষাক্ত ছোবল থেকে প্রজন্মকে রক্ষা করতে, দেশকে বাঁচাতে প্রয়োজন এ বিষয়ে সকল নাগরিকের সোচ্চার হওয়া। বিশেষতঃ সন্তান-সন্ততিদের ছোট বেলা থেকেই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার প্রতি অনুরাগি করা। নৈতিক শিক্ষা দেওয়া। মাদক সেবনসহ চরিত্র ও সমাজ বিধ্বংসী কর্মকান্ডে যাতে সন্তানেরা লিপ্ত না হয় সে ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া।
মাদকের ভয়াবহ কুফল সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মসহ সর্বসাধারণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা। সেই সাথে অপসংস্কৃতি ও প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মহল থেকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। সর্বোপরি মাদকের অবাধ বিপনন ও সেবন রোধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া এবং তা কার্যকর ভাবে অব্যাহত রাখা।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button