কেন এত আত্ম ও আত্মীয়হনন

hangরফিকুল ইসলাম সেলিম: চট্টগ্রামে ভাইয়ের হাতে ভাই, স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী এ জাতীয় খুনের ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। স্বজনদের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে স্বজনের হাত। তুচ্ছ ঘটনায়ও মানুষ খুন হচ্ছে। আত্মহননের ঘটনা ঘটছে প্রতিদিনই। আত্মহত্যার মিছিলে যোগ দিচ্ছে গৃহবধূ, কিশোরী, তরুণী, যুবক, কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষ।
চন্দনাইশ উপজেলা জাফরাবাদ জলদাস পাড়ায় গতকাল (সোমবার) সকালে বড় ভাইয়ের এলোপাতাড়ি দা’য়ের কোপে খুন হয়েছেন ছোট ভাই। গুরুতর আহত হন বাবা-মা ও ছোট বোন। সম্প্রতি রাউজানে স্বামীকে গলাকেটে হত্যার পর রান্নাঘরে লাশ পুঁতে ফেলে স্ত্রী। সেখানে ভাইয়ের হাতে ভাই, বোনের হাতে বোন এবং স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনের ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি।
বৃহস্পতিবার নগরীর কৈবল্যধাম এলাকায় স্ত্রীর সামনে ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী এক প্রকৌশলী। এর একদিন পর রাউজানে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন এক ইউপি সদস্য। চট্টগ্রাম মহানগরী এবং জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিনই একাধিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে।
চলতি বছরের এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম মহানগরীতে শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় সমান সংখ্যক খুনের ঘটনা রেকর্ড হয়েছে জেলার ১৫টি থানা এলাকায়। একই সময়ে জেলা এবং মহানগরীতে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে প্রায় দেড় শতাধিক। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পশ্চিমা সংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব, পারিবারিক বন্ধন শিথিল, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অনৈতিক সম্পর্কসহ নানা কারণে সামাজিক অস্থিরতা থেকে খুন, আত্মীয় হনন এবং আত্মহননের ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
অব্যাহত খুনাখুনি বিশেষ করে স্বজনের হাতে স্বজনের নির্মম খুনের ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন সমাজসচেতন মানুষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও উৎকণ্ঠিত। সবার মনে একটাই প্রশ্ন হঠাৎ করে কেন এ আত্মীয় হত্যা আর কেনইবা এত আত্মহত্যা।
খুন আর আত্মহত্যায় যারা মারা যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগই কর্মক্ষম মানুষ। এর ফলে এসব পরিবারে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। আত্মহত্যা কিংবা স্বামীর হাতে স্ত্রী খুনের ঘটনায় সন্তানরা অসহায় হয়ে পড়ছে। মহানগরী ও জেলায় সংগঠিত কয়েকটি ঘটনায় স্ত্রীকে খুনের অভিযোগে স্বামী গ্রেফতার হয়েছে। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে তাদের সন্তানেরা। অকালে মাতৃহারা সন্তানদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত।
রাউজানে ঈদের দিন ঝগড়ার জের ধরে স্বামী দুদু মিয়াকে খুন করে লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলে স্ত্রী শাহনাজ বেগম। পুলিশ শাহনাজ বেগমকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে। তাদের ৪ সন্তান এখন আশ্রয়হীন অবস্থায় স্বজনদের কাছে রয়েছে। অপমৃত্যুর ঘটনায় অভিভাবকহারা সন্তানদের ভবিষ্যৎ যেমন অনিশ্চিত তেমনি কর্মক্ষম মানুষদের অপমৃত্যুতে সামাজিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।  আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর কর্মকর্তা, সমাজবিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী, সমাজ সচেতন মানুষ এ ধরনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন। এ ধরনের অপরাধ প্রবণতার কারণ উদ্ঘাটন করে এখনই প্রতিকার নেয়া জরুরি বলে মনে করেন তারা।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, সমাজে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের যে চরম অবক্ষয় হয়েছে এসব ঘটনা তারই বহিঃপ্রকাশ। সর্বত্রই এখন অস্থিরতা। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করছে। রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়ার অসম প্রতিযোগিতা চলছে। অনৈতিক পথে কিছু লোক বিত্তশালী হয়ে উঠছে। এ বৈষম্যের কারণে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। এর প্রভাবে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।
সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর সালেহ উদ্দিন আরও বলেন, দিনে দিনে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা বেড়ে গেছে। এ কারণে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তুচ্ছ ঘটনায় কিংবা স্বার্থের দ্বন্দ্বে স্বজনের বুকে ছুরি চালিয়ে দিতেও তারা দ্বিধা করছে না। পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব এবং পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় না থাকায় আত্মহত্যার মত ঘটনাও বেড়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি। এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা রোধে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি সমাজের সচেতন অংশকেও ভূমিকা রাখতে হবে। পারিবারিক শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষা পেলে সন্তানেরা কখনও বিপথগামী হতে পারে না।
চট্টগ্রাম নগর মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার প্রকৌশলী বনজ কুমার মজুমদার বলেন, সাম্প্রতিককালে চট্টগ্রামে আত্মহত্যা এবং আত্মীয় হত্যার ঘটনা অস্বাভাবিকহারে বেড়ে গেছে। সামাজিক অস্থিরতা, নৈতিক মূল্যবোধ এবং পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতার অভাবে এমন ঘটনা বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, স্বাভাবিক পুলিশি কার্যক্রম দিয়ে এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা বন্ধ করা সম্ভব নয়। এজন্য মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ এবং মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। এ লক্ষ্যে সমাজের সচেতন অংশকে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়ালের নানা ঘটনা আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে নাড়া দিচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজ ও পরিবারে। ইন্টারনেট মোবাইলের যুগে মানুষ একাকি সময় কাটানোর সুযোগ পেয়ে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর ফলে মানুষের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা প্রবল হয়ে উঠছে।
মানবাধিকার সংগঠক অ্যাড. জিয়া হাবীব আহসান বলেন, সমাজে আইনের শাসন না থাকায় মানুষের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। মানুষ বেপরোয়া হয়ে খুনের মত জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। পুলিশ বাহিনী রাজনৈতিক মামলা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে ব্যস্ত থাকায় স্বাভাবিক পুলিশি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, খুনের ঘটনায় সঠিক তদন্ত এবং যথাসময়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হলে অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করা যেত। কিন্তু বেশিরভাগ হত্যার ঘটনায় পুলিশের অবহেলা, গাফিলতি এবং দুর্নীতির কারণে খুনিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। বিচার না হওয়ায় খুনের ঘটনা বাড়ছে।
আত্মহত্যার ঘটনায়ও পুলিশ যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না অভিযোগ করে তিনি বলেন, আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়া ফৌজদারি অপরাধ। বেশিরভাগ ঘটনায় পুলিশ আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয় না। তিনি মনে করেন, হত্যার বিচার এবং আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচনাকারীদের আইনের আওতায় এনে কঠোর সাজা দেয়া গেলে এ ধরনের অপরাধ কমে যাবে। সার্বিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং পুলিশি কার্যক্রম মানবাধিকার বান্ধব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, আর এ কারণেই পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
সমাজকর্মী ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অ্যাড. সৈয়দা রেহেনা বেগম রানু বলেন, সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় চরমে পৌঁছেছে। পরিবার এবং সমাজে পরস্পরের সহমর্মিতা, ভালোবাসা এবং মানবিক মূল্যবোধ উঠে যাচ্ছে। স্বার্থের দ্বন্দ্বে মানুষ এতটাই বেপরোয়া যে স্বজনকেও খুন করছে। পরিবারের বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়ায় সন্তানদের মধ্যে অস্থিরতা, হতাশা বেড়ে যাচ্ছে। পারিবারিক অশান্তির কারণে হতাশা থেকে গৃহবধূরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। এ প্রবণতা রোধে মানুষকে মানুষ হিসেবে অধিকার দিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা বেশি। বিচার বহির্ভূত হত্যা যেমন কাম্য নয়, তেমনি হত্যাকা-ের পর বিচার না হওয়াও অন্যায়। হত্যার বিচার হলে হত্যার ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
দৃশ্যপট রাউজান
এম বেলাল উদ্দিন জানান, রাউজানে পাল্লা দিয়েই যেন বাড়ছে পারিবারিক হত্যা। গত কয়েক মাসে এমনই অনেক পারিবারিক হত্যাকা-ের ঘটনা দেশবাসীর নজর কাড়ে। স্ত্রীর হাতে স্বামী, স্বামীর হাতে স্ত্রী, ভাইয়ের হাতে ভাই, বোনের হাতে বোন খুন হয়েছে। গত চার মাসে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৬টি। আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে আটটি। রহস্যজনকভাবে মারা গেছে দুই গৃহবধূ। এরমধ্যে দুই প্রেমিক-প্রেমিকা একসাথে ঝুলে আত্মহননের ঘটনাও ঘটে। এছাড়া তিনজনের পরিত্যক্ত লাশ উদ্ধার হয়েছে উপজেলা থেকে। হরহামেশা এমন ঘটনা ঘটায় পরিবারের আপনার কাছের মানুষটি কতটা নিরাপদ- এ প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে জনমনে।
গত ঈদুল আযহার দিন রাতে উপজেলার চিকদাইর ইউনিয়নে স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যার পর নিজ ঘরেই মাটিচাপা দেন এক স্ত্রী। নিহত স্বামীর নাম দুদু মিয়া (৩৩)। হত্যাকা-ের ১০ দিন পর ১৬ আগস্ট রাউজান থানা পুলিশ চিকদাইর ইউনিয়নের দক্ষিণ সর্তার সুনিত্তে পাড়া গ্রামের নিজ ঘরের মেঝে খুঁড়ে দুদু মিয়ার লাশ উদ্ধার করে।
সর্বশেষ আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটে গত ১১ অক্টোবর বিকেলে কদলপুরের লস্করদীঘি পাড়ের পূর্ব পাশে। সেখানে রহস্যজনকভাবে আবদুর শুক্কুর (৩৫) নামের এক ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button