সুন্দরবনের বাঘের চামড়া পাচার হচ্ছে চীনে

Tiger Chamraআবু সাইদ বিশ্বাস সুন্দরবন অঞ্চল থেকে: টাকায় বাঘের চোখও মেলে! এই  প্রবাদটি সত্য হতে চলেছে। মোটা টাকায় মিলছে বাঘের চামড়া। তাই বাঘ পাচারকারী চক্র বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বাঘ শিকারিরা জেলে সেজে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে ফাঁদ পেতে, বন্দুক দিয়ে গুলী করে বাঘ শিকার করে। বাঘ শিকারিরা বাঘ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতে এর চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে পাচারকারীদের সাহায্যে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে পাচার করে। স্থানীয়ভাবে চামড়ার জন্য শিকারীরা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা পেলেও বিদেশে দশ লক্ষ টাকার বেশি বিক্রি হয় বলে জানা গেছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে বাঘের চামড়া চড়া মূল্য থাকায় এখন চোরা শিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে সুন্দরবনের বাঘ। ১৯৮০ সাল থেকে বাঘের চামড়া সংগ্রহ শুরু হওয়ার পর বিদেশে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ২০১১ সাল পর্যন্ত বনবিভাগ ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে শতাধিক বাঘের চামড়া।  ২০১১-১৩ সালের মধ্যে ২৭টি বাঘ হত্যার শিকার হয়েছে। সর্বশেষ ১৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাতে সাতক্ষীরায়  রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ২টি চামড়া, ১০ রাউন্ড বন্দুকের গুলী,২টি মোটরসাইকেলসহ ৬ জনকে আটক করে র‌্যাব। এ নিয়ে এ পর্যন্ত ১০২টির মত বাঘের চামড়া উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে।
বনবিভাগের  পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত এক দশকে সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগে ২৪টি  ও পূর্ব বিভাগে ১২টি বাঘের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে সাতক্ষীরা রেঞ্জে সব থেকে ১৪ টি বাঘ গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছে।
বাঘ নিয়ে কাজ করে খুলনার একটি সেবাধর্মী স্বেচ্ছাসেবী  সংগঠন তাদের নিবন্ধে উল্লেখ করেছে, ২০০২ সাল পর্যন্ত বিভিন্নভাবে  সুন্দরবনে ১২০টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে । বন বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৮০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৫৩টি হত্যার শিকার হয়। ৮১, ৮২ ,৮৪ ,৮৫, ৮৭ ও ১৯৯৫ সালে কোন  মৃত্যুর শিকার হয়নি। ১৯৮৩ সালে ৩ টি ৮৬ সালে ২টি,  ৮৮সালে ১টি ,৯০ সালে ২টি, ৯১সালে ৪টি, ৯২সালে ১ টি ,৯৩ সালে ৪ টি, ৯৪ সালে ২ টি, ৯৬ সালে ৫ টি, ৯৭ সালে ৮ টি,৯৮ সালে ২ টি ,৯৯ সালে ৪ টি ২০০০ সালে ৫ টি ,২০০১ সালে ১ টি,  ২০০২ সালে ৩ টি ,২০০৩ সালে ৩ টি, ২০০৪ সালে ৪ টি, ২০০৫ সালে ৬ টি, ২০০৭ সালে ৪ টি, ১১ সালে ৪ টি, ১২ সালে ১ টি বাঘ প্রাণ এর পেছনে ৮ টি কারণ চিহ্নিত করে তারা বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ,লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়া,মিঠা পানির অভাব,খাদ্য সংকট, বন ধ্বংস চোরা শিকারী ইত্যাদি।
স্থানীয সূত্র জানায়, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জ সংলগ্ন গ্রামগুলিতে একাধিক চোরা শিকারীর সংঘবদ্ধ দল রয়েছে। এদেও অবস্থান বরগুনার পাথরঘাটা, চরদুয়ানি, বাগেরহাটের শরনখোলা, রামপাল, মোড়লগঞ্জ, মোংলা, সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালিগঞ্জ, খুলনার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলায়। বাঘ শিকারিরা জেলে সেজে সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতি নিয়ে বনে যায়। এরপর খাদ্যে বিষ মিশিয়ে ফাঁদ পেতে, বন্দুক দিয়ে গুলী করে বাঘ শিকার করে। বাঘ শিকারিরা বাঘ হত্যার পর স্থানীয় পদ্ধতিতে এর চামড়া সংরক্ষণ করে। পরে পাচারকারীদের সাহায্যে অর্থের বিনিময়ে পাচার করে। স্থানীয়ভাবে চামড়ার জন্য শিকারীরা দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা পেলেও বিদেশে দশ লক্ষ টাকার বেশি বিক্রি হয় বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বনবিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বাঘ সুরক্ষায় বনে দুইটি ট্রাংকুলাইজার গান রয়েছে। তবে গান দুটি ব্যবহারের জন্য দক্ষ কোন লোক নেই। তেমনি নেই পর্যাপ্ত পরিমাণ চেতনানাশক ওষুধ। বাঘ বিশেষজ্ঞদের মতে দক্ষ জনশক্তি ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম থাকলে বাঘ মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হতো।
১৯৮০ সালে সুন্দরবনে এক জরিপে ৪৫০টি, ১৯৮৪ সালে ২৮৭, ১৯৯৪ সালের জরিপে ৭শ’ বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া পাওয়া যায়। বিশ্বখ্যাত ডিসকভারি চ্যানেল ১৯৯৮ সালের নবেম্বর মাসে তিন মাসব্যাপী সুন্দরবনে বাঘের চিত্র ধারণ করার জন্য অবস্থান করে। ১২ সপ্তাহ ব্যর্থ চেষ্টার পর ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতে টাইগার পয়েন্টের কচিখালি অভয়ারণ্য কেন্দ্রে বাদামতলায় একটি বাঘের পরিবারকে কৃত্রিম পন্থায় ক্যামেরাবন্দী করতে সমর্থ হন। এখানে একটি গরু বেঁধে রেখে বাঘ আসার টোপ হিসাবে ব্যবহার করা হয়। একটি বাঘ আর দুটি বাচ্চা গরুটিকে প্রথমে বধ ও পরে সাবাড় করে। সপ্তাহ সেখানে ক্যামেরারা হল থাকলেও অন্য কোন বাঘ সেখানে আসেনি। এই টিমের প্রধান মাইক হার্ট সুন্দরবনের অভয়ারণ্য হিরোন পয়েন্ট, টাইগার পয়েন্টে প্রাথমিকভাবে বাঘের জীবন ধারণ ও চলাচলের সন্ধান না পেয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। অভয়ারণ্য বাঘের স্বল্পতা দেখে দারুণভাবে ব্যথিত হয়েছেন।
১৭ অক্টোবর ২০১৪ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি সাতক্ষীরায় বাঘের চামড়া উদ্ধার শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ কারে ।  রির্পোটে বলা হয় বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা সাতক্ষীরা থেকে দুটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করেছে বিশেষ পুলিশ র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন বা র‌্যাব। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তারা বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে অভিযান চালিয়ে বাঘের চামড়া দুটি উদ্ধার করেন। এসময় ৬ জনকে আটক করে র‌্যাব। তাদের কাছে কিছু গুলী পাওয়াা গেছে। র‌্যাব ৮ এর কর্মকর্তা মেজর আদনান বিবিসিকে জানান, গত এক মাসের মধ্যেই সুন্দরবন থেকে বাঘ দুটিকে হত্যা করে চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে বলে তারা ধারণা করছেন। তিনি বলেন, একটি সংঘবদ্ধ চক্র অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী হত্যা এবং চামড়া ব্যবসার সাথে জড়িত বলে তারা জানতে পেরেছেন। আন্তর্জাতিক প্রাণীবিষয়ক সংস্থা, আইইউসিএন ২০১০ সালে রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করে।  বাঘের চামড়া উদ্ধারের সবশেষ ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১১ সালে বাগেরহাটে। বন বিভাগ বলছে, এরপর অনেকদিন অবৈধ বাঘ শিকার না হওয়ায়, এধরনের ঘটনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আছে বলে তারা ধারণা করছিলেন। কিন্তু আবারো বাঘের চামড়া উদ্ধার হওয়ার শংকিত হবার মতো ঘটনা বলেই স্বীকার করছেন বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অঞ্চলের সংরক্ষক তপন কুমার দে। তিনি বলেন, “আমরা এখন বন বিভাগ এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল জোরদার করার জন্য তৎপর হবো। আমাদের আশেপাশের ক্যাম্প কতটা দায়ী সেটাও আমরা দেখবো।”মি. দে বলছেন, এর আগে বিষ ব্যবহার করে বাঘ শিকার করার প্রমাণ পাওয়া গেলেও, এবার গুলী করে বাঘ শিকার করা হয়েছে । তিনি বলেন, বনদস্যুদের মোকাবিলায় বনরক্ষীদের অস্ত্র এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিরও অভাব রয়েছে।তবে শুধু বনদস্যুরাই নয় শিকার থেকে শুরু করে এটি বিক্রি পর্যন্ত বেশ বড় একটি চক্র কাজ করছে বলে ধারণা করছে র‌্যাব। র‌্যাব কর্মকর্তা মেজর আদনান বলেন, বনদস্যুরা দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে বাঘ শিকার করে এবং এরপর নানা হাত ঘুরে এটি আরো অনেক চামড়া দামে বিক্রি হয়। আটককৃতদের সাথে ঢাকায় বড় ক্রেতাদের যোগাযোগ আছে বলেও জানাচ্ছেন এই র‌্যাব কর্মকর্তা। তিনি বলেন, “বিশদ তদন্ত করলে কারা এর পেছনে আছেন এবং কারা অর্থের যোগান দিচ্ছেন তা বেরিয়ে আসবে।”সারা বিশ্বে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা মাত্র দু’হাজারের মতো। প্রায় দশ বছর আগে করা সর্বশেষ হিসেব অনুযায়ী বিপন্ন প্রজাতির এই বাঘটির ৪৪০ টিরই বসবাস বাংলাদেশের সুন্দরবনে। বন কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত বাঘের চামড়া এবং হাড় বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যেই বাঘ শিকার করে থাকে দুর্বৃত্তরা।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০ টায় সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়কের ইটাগাছা সংগ্রাম টাওয়ারের সামনে থেকে র‌্যাব সদস্যরা তাদের আটক করে। এসময় তাদের কাছ থেকে দুটি বাঘের চামড়া, ১০ রাউন্ড গুলী, ৬টি মোবাইল ও দুটি নম্বরবিহীন মোটর সাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে।
আটককৃতরা হলো, খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার চেচোড়ি গ্রামের মোখলেছ গাজীর ছেলে গাজী সেলিম (৩৫), আশাশুনি উপজেলার দরগাহপুর গ্রামের মৃত মহিউদ্দিন আহম্মেদের ছেলে সাবেক মেম্বর শেখ বখতিয়ার উদ্দিন (৪২), খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার চান্নিরচক গ্রামের মৃত ওয়াজেদ আলীর ছেলে রবিউল ইসলাম (৩৫), কয়রা উপজেলার মহারাজপুর গ্রামের মৃত শাহাজাহান আলীর ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান (৩৬), খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়–লি গ্রামের মৃত মোহাম্মাদ আলী সানার ছেলে ফারুখ সানা (২৫) ও  একই উপজেলার সাহাপাড়া গ্রামের সেকেন্দার আলীর ছেলে আমিরুল ইসলাম (২৫)।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০ টায় র‌্যাব-৬ সাতক্ষীরা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাব-৮ এর উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবির জানান, একটি সংঘবদ্ধ চোরাচালানী ও পাচারকারী চক্র মোটরসাইকেল যোগে সুন্দরবন থেকে ২টি বাঘের চামড়া নিয়ে সাতক্ষীরার দিকে আসছে এমন সংবাদের ভিত্তিতে  সাতক্ষীরায় দায়িত্বরত র‌্যাব-৬ এর সদস্যদের সাথে নিয়ে ইটাগাছা সংগ্রাম টাওয়ারের সামনে ওঁৎপেতে থাকে। পাচারকারীরা তারা সেখানে আসলে র‌্যাব সদস্যরা তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে। এসময় তাদের ব্যাগ তল্লাশি করে দুইটি বাঘের চামড়া, ১০ রাউন্ড গুলী, ৬ টি মোবাইল ও দুুটি নম্বরবিহীন  মোটরসাইকেলসহ উপরোক্ত ৬ জনকে আটক করা হয়। তিনি আরও বলেন চোরাকারবারীদেরকে প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে করা হচ্ছে।
খুলনার দাকোপ উপজেলায় সুন্দরবনের ঢাংমারী এলাকায় একটি বাঘ হত্যার পর চারটি বড় দাঁত চার লাখ টাকায় বিক্রির চেষ্টা করে পাচারকারী চক্র। গত বছরের ৬ নবেম্বর র‌্যাবের সহায়তায় ওই দাঁতসহ দু’জনকে আটক করে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। এক মাস পর ১৫ ডিসেম্বর পশ্চিম সুন্দরবনের জয়খালী এলাকা থেকে একটি মৃত বাঘ উদ্ধার করা হয়। বাঘটির মাথা ও চারটি পা ছিল না। এভাবে কৌশলে বাঘ হত্যা করে দাঁত, চামড়া ও হাড় সংগ্রহ করছে সংঘবদ্ধ চক্র। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সুন্দরবনে বাঘ জরিপকারী দলকে একজন জেলে জানিয়েছেন, তিনি একটি নৌকায় তিনটি বাঘের কঙ্কাল ও চামড়া নিয়ে যেতে দেখেছেন। একজন পেশাদার চোরাশিকারি জরিপকারী দলের কাছে স্বীকার করে, সে ২০১১-১৩ সালের মধ্যে ২৭টি বাঘ হত্যা করেছে।জীববৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বাঘ চোরাচালানকারী আন্তর্জাতিক চক্র সুন্দরবনসহ বিশ্বের বেশিরভাগ বনে সক্রিয় রয়েছে। গত কয়েক বছরে এই চক্র সুন্দরবন থেকে বাঘ ধরে আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের হাতে তুলে দিয়েছে। বর্তমানে একটি মৃত বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। যে কারণে চোরা শিকারিদের টার্গেট এখন জীবিত কিংবা মৃত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বাঘ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিডর ও আইলার আঘাত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া বাঘের জন্য যতটা না হুমকি, তার চেয়ে বড় হুমকি মানুষের তৎপরতা ও চোরা শিকারি নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগের ব্যর্থতা। বন বিভাগের কর্মকর্তারাই বলছেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চালু হওয়া নৌরুট দিয়ে যাওয়া জাহাজ ও কার্গোতে করে বাঘসহ বন্যপ্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, এমনকি জীবন্ত অবস্থায়ও পাচার হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন এলাকার একটি প্রভাবশালী চক্র ও বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এ কাজে সহায়তা করছেন। বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৬ বছরে সুন্দরবনে ৫২টি বাঘ মারা গেছে। এর মধ্যে স্থানীয় লোকজন ২৪টি বাঘ পিটিয়ে এবং চোরা শিকারিরা ১৭টি বাঘ কৌশলে হত্যা করে। ১১টি বাঘের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়। বন বিভাগের রেকর্ডের বাইরেও বাঘসহ বন্যপ্রাণী মারা পড়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। মারা পড়া বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কৌশলে ওই আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে। চীন, মিয়ানমার, ভারত, নেপাল, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বাজার রয়েছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্রের সহযোগিতায় দেশীয় পাচারকারী চক্র সক্রিয় রয়েছে। ওই চক্র কৌশলে সুন্দরবনে বাঘসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী হত্যা করছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় ভারতে ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ছোট-বড় জাহাজ ও কার্গো সুন্দরবনের মধ্যে নন্দবালা-চাঁদপাই-মৃগামারী-আন্ধারমানিক-তামবুলবুনিয়া-হরিণটানা-দুধমুখী-শরণখোলা-তেড়াব্যাকা ও বগী হয়ে চলাচল করছে। এতে সুন্দরবনের পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্তের পাশাপাশি ওই সব জাহাজ ও কার্গোর মাধ্যমে বাঘসহ বন্যপ্রাণী, মূল্যবান চামড়া, দাঁত ও হাড় পাচার হচ্ছে। এ ছাড়া বন বিভাগ থেকে মাছ পরিবহনের নাম করে পাস নিয়ে পরিবহন ট্রলারগুলো বনের মধ্যে প্রবেশ করছে। বন কর্মকর্তারা বলেন, এসব ট্রলারে করে বন ও জলদস্যুদের জন্য চাল, ডালসহ বিভিন্ন মালপত্র বনে নেওয়া হয়। বিনিময়ে দস্যুদের কাছ থেকে বন্যপ্রাণীসহ মূল্যবান চামড়া ও দাঁত আনা হয়। বন উজাড় ও হত্যার ফলে বর্তমানে বাঘ মহাবিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত। বাঘ পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশে এখনও তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এই ১৩টি বাঘসমৃদ্ধ দেশকে ‘টাইগার রেঞ্জ কান্ট্রি’ (টিআরসি) বলা হয়। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, ভুটান, নেপাল ও রাশিয়া। ১৯০০ সালের দিকে বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ। বর্তমানে বিশ্বে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন হাজার সাতশ’রও কম।  সর্বশেষ ২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া ‘বাংলাদেশ সুন্দরবন রিলেটিভ টাইগার অ্যাবানডেন্স সার্ভে ২০১২’ শীর্ষক জরিপে ৬৯ শতাংশ বাঘ কমেছে বলে দাবি করা হয়েছে। বন সংরক্ষক (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি) ড. তপন কুমার দে বলেন, বনের জীববৈচিত্র্যের মান নিরূপণের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে বাঘ। যে বনে জীববৈচিত্র্য বেশি, সেখানে বাঘের সংখ্যাও বেশি থাকে।প্রধান বন সংরক্ষক ইউনূছ আলী   বলেন, বাঘ ও হরিণ হত্যার জন্য আইনে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত জেল প্রদানের ধারা সংযোজন করা হয়েছে। বাংলাদেশে বাঘ সংরক্ষণের সফল উদ্যোগের কারণে বর্তমান সরকার বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে এবং সুন্দরবন সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা এগিয়ে এসেছে। তিনি জানান, বাঘের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে সুন্দরবনে বনজ সম্পদ রক্ষায় গোলপাতা ছাড়া সব ধরনের গাছপালা ও জ্বালানি কাঠ আহরণ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, বাঘ রক্ষা করতে ‘ন্যাশনাল টাইগার রিকভারি প্রোগ্রাম’ (এনটিআরপি) প্রণয়ন ও ২০০৯-২০১৭ বাঘ সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটান এরই মধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।
বাঘের চামড়ার বাজার সবচেয়ে বেশি চীনে। ১৯৯৩ সালের আগ পর্যন্ত চীনে বাঘের হাড়, মাংস, চামড়ার ব্যবসা হয়েছে প্রকাশ্য দিবালোকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে চীন ১৯৯৩ সাল থেকে বাঘের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেনা-বেচা নিষিদ্ধ করেছে।  চীনের মানুষ বিশ্বাস করে বাঘের অঙ্গ থেকে তৈরি ওষুধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং কার্যকর। প্রায় ৫ হাজার বছর আগে থেকেই সেখানে চিকিৎসার কাজে বাঘের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার হতো। খামার থেকে তাই একটি বাঘ ১ কোটি টাকারও বেশি দামে বিক্রি হয়। বাঘের সবচেয়ে মূল্যবান অঙ্গ হাড়।
চীন সরকারের নমনীয় নিষেধাজ্ঞার কারণেই চীনে এখনও বাঘের হাড় দিয়ে মদ তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। চীনের বন্যপ্রাণী পার্কগুলোই এ কাজ করে থাকে। তারা চালের তৈরি মদের মধ্যে বাঘের মৃতদেহ ও হাড় ভিজিয়ে রাখে। চীনারা বিশ্বাস করে, ওই মদ খেলে আর্থাইটিস ও রিউম্যাটিজম ভালো হয়। আর এই কাজটা বিজ্ঞাপন দিয়েই করা হয়। মাত্র ২৫ কেজি হাড়ের দাম প্রায় ৬০ লাখ টাকা।
বাঘের শিশ্নের সুরুয়া বা স্যুপ খুবই দামী পানীয়। চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসামতে এই স্যুপ খেলে মর্দামি শক্তি বাড়ে। চীন, সাউথ কোরিয়া এবং তাইওয়ানে এর বাজার সবচেয়ে বেশি। আর পর্যটকরাও চীনে গেলে এই স্যুপের খোঁজ করেন।
চীনে বাঘের চামড়া মানুষ ঘর সাজানোর জন্য কেনে। এটা সেখানে অভিজাত্যের বিষয় (তবে ব্যাপারটি আমাদের দেশেও আছে)। আর সেখানে প্রতিটি বাঘের চামড়া বিক্রি হয় ২০ হাজার মার্কিন ডলারে।
চীন, সাউথ কোরিয়া, নেপাল, ভিয়েতনাম, রাশিয়া এবং তাইওয়ানে বাঘের পণ্যের বাজার সবচেয়ে বেশি। বাঘের পণ্যের এই বিশাল আর কোটি কোটি ডলারের বাজারের জন্য চীনারা গড়ে তুলেছে বাঘের খামার। যদিও তারা বিষয়টি স্বীকার করে না। পরিবেশবাদীদের ধারণা, চীনে বড় খামারের পাশাপাশি ছোট ছোট অনেক খামার আছে যেগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে বাইরের কেউ জানে না।
ভারতে ও বাঘের চামড়া উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর  লক্ষাধিক টাকার চিতাবাঘের চামড়া উদ্ধার করেছে শিলিগুড়ি বন দফতর।  ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার  ও করে ভারতীয় পুলিশ। নেপালে পাচারের উদ্দেশ্যে চামড়াগুলি নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বলে ভারতীয় পুলিশ জানায়।
প্রকৃতির বিস্ময় সম্পদের ভান্ডার বিশ্ববিখ্যাত এই বন শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের নয় এটি বিশ্বেরও সম্পদ। কেননা জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান, ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ কমিটির ২১তম অধিবেশনে সুন্দরবনকে “হ্যারিটেজ সাইট” বা বিশ্ব সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এই ঘোষণার মধ্যে দিয়ে প্রথিবীর ৫২২টি বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে সুন্দরবনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে ঠিক যেমন বেড়েছে এবনের মর্যাদা ঠিক তেমন বেড়েছে আমাদের দায়িত্ব। সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই বনের উপর নির্ভরশীল।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button