গাজায় ওবামার ভূমিকা

Obamaজাহাঙ্গীর আলম আনসারী:
ফিলিস্তিনের গাজায় ইতিহাসের এক নির্মম ও নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে মানবতার দুশমন ইহুদী সন্ত্রাসীরা। প্রতিনিয়ত এই সন্ত্রাসীদের বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন নিরপরাধ নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ বহু মানুষ।
ঘরবাড়ি ছাড়া লাখ লাখ আশ্রয়হীন মানুষ এখন দিশেহারা। মা-বাবা তাদের শিশু বাচ্চাদের নিয়ে কোথাও একটু আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছেন না। দুনিয়ায় একটু বেঁচে থাকার জন্য তারা যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই ইহুদী বর্বর-হায়েনারা বোমা নিক্ষেপ করে জীবন্ত মানুষগুলোকে লাশ করে দিচ্ছে। ফিলিস্তিনী মুসলমানদের চিরতরে শেষ করে দেয়ার লক্ষ্যে এই নরপশুরা ঘোষণা দিয়ে নারী ও শিশুদের অকাতরে হত্যা করছে। এর চেয়ে জঘন্য-বর্বর-মানবতাবিরোধী অপরাধ আর কী হতে পারে?
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো- গাজার নারী-পুরুষ আর শিশুদের ক্ষতবিক্ষত দৃশ্য দেখে বিশ্বের অনেক জায়গায় মুসলমানরা প্রতিবাদ জানালেও নিশ্চুপ হয়ে আছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। আর নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে আমেরিকা ও তাদের অনুগত জাতিসংঘ নামের সংগঠনটি। আজকে আমাদের জানতে খুব ইচ্ছে করে, মানবাধিকারের সেই ফেরিওয়ালা আজ কোথায়? যারা দেশে দেশে ফেরি করে মানবাধিকার বিক্রি করে যাচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকার সেই মোড়লরা আজ কোথায়? যারা শান্তি প্রতিষ্ঠার শ্লোগান নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায়। যাদের মানবাধিকার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা মুসলমানদের জন্য নয়- শুধু ইহুদী ও খ্রিস্টানদের জন্য। মনে হয়, তাদের নিকট ফিলিস্তিনের লোকজনতো মানুষ নয়, তারা হলো- মুসলমান। মুসলমানদের আবার কিসের মানবাধিকার? মুসলমানদের যত তাড়াতাড়ি নিঃশেষ করে দেয়া যায়, ততই তাদের জন্য মুশকিল আছান।
এদিকে গাজা ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও ইহুদিবাদী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়েছে বলে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের বরাত দিয়ে বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে। সংবাদে বলা হয়েছে গত রোববার টেলিফোনে কথা বলার সময় তাদের মধ্যে এ বাক্যবিনিময় হয়। হিবরু ভাষায় মঙ্গলবার তাদের কথোপকথন ফাঁস করে দেয় ইহুদী টেলিভিশন স্টেশন চ্যানেল ওয়ান। পরে ইংরেজি ভাষায় এর অনুবাদ প্রকাশ করে ‘টাইমস অব ইসরাইল।’ সম্প্রতি ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে বলেও একটি খবর বেরিয়েছে।
সংবাদের ভাষ্যমতে ইহুদীবাদী প্রধানমন্ত্রীর ওপর বারাক ওবামা এখন নাকি খুব ক্ষুব্ধ। তিনি নেতানিয়াহুকে বলেছেন, আমি দাবি করছি ইসরাইলকে অবিলম্বে, একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে হবে এবং সমস্ত আক্রমণাত্মক কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে, বিশেষ করে বিমান হামলা। কথোপকথনের ফাঁকে তিনি আবারো বলেন, আমি আবারো বলছি এবং আশা করছি ইসরাইলকে একতরফাভাবে সব ধরনের সামরিক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে। গাজায় ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র দেখে বিশ্ব ইসরাইলের অবস্থান থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে গাজায় ইসরাইলী হামলা বন্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কি সত্যিকার অর্থেই আন্তরিক? নাকি নেতানিয়াহুর সাথে ওবামার উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় স্রেফ ভাঁওতাবাজি? বারাক ওবামার এসব কথা কতটুকু গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে এখন যথেষ্ট সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করার জন্য সন্ত্রাসী ইসরাইলকে ‘নতুন করে’ অস্ত্রের চালান দিয়েছে মার্কিন সরকার। ইসরাইল গাজার দুটি স্কুল ও একটি বাজারে হামলা চালিয়ে অন্তত ৫৩ ব্যক্তিকে হত্যা করার পর অস্ত্র দেয়ার কথা ঘোষণা করলো ওয়াশিংটন।
একজন মার্কিন সেনা কর্মকর্তা গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, গত সপ্তাহে তেল আবিবকে দেয়া অস্ত্রের চালানে রয়েছে ক্ষেপণাস্ত্র, সাঁজোয়া যান ও কামানের গোলা। এসব অস্ত্র ইসরাইলের একটি গোপন অস্ত্রাগারে রাখা হয়েছে। এটা তাদের জন্য নতুন কিছু নয়। এর আগেও ২০০৬ সালে লেবাননের হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাঝখানে তেল আবিবকে একই ধরনের অস্ত্র দিয়েছিল ওয়াশিংটন। বিশ্ববাসীর কাছে এখন বিষয়টি পরিষ্কার যে, গাজায় ইসরাইলী হামলা বন্ধে মার্কিন সরকার কোনোভাবেই আন্তরিক নয়। তারা আন্তরিক হলে যুদ্ধের মাঝখানে ইসরাইলী সন্ত্রাসীদের আবার নতুন করে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করতো না।
দ্বিতীয়ত, গত বুধবার ভোরে ফজরের নামাজের সময় জাবালিয়ায় জাতিসংঘ পরিচালিত একটি স্কুলের ঘুমন্ত শিশুদের ওপর হামলা চালিয়েছে ইসরাইলী সন্ত্রাসীরা। তাদের এই পাশবিক হামলায় অন্তত ২০ জন নিহত হয়। এ হামলার পর ইসলাইলের ওপর সামান্য নাখোশ হয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মুখপাত্র ক্রিস গানেস বলেছেন, গোটা বিশ্ব নাকি এ হামলায় ক্ষুব্ধ হয়েছে।
গানেস আরো বলেছেন, জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের এই স্কুলটিতে যে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে তা ইসরাইলকে ১৭ বার জানানো হয়েছে। স্কুলটিতে হামলা না চালাতে ইসরাইলকে তারা বহুবার হুঁশিয়ারও করেছিল।
কোস্টারিকা সফররত জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনও এ হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, হামলা হৃদয়বিদারক। এটি অন্যায়। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার করা উচিত। আমি কঠোরতম ভাষায় এ হামলার নিন্দা জানাচ্ছি। ঘুমন্ত শিশুদের ওপর হামলার চেয়ে লজ্জাজনক আর কোনো বিষয় থাকতে পারে না। এই আক্রমণ ভয়ানক নিষ্ঠুর এবং একেবারে অগ্রহণযোগ্য। তিনি এর জবাবদিহিতা ও বিচার দাবি করেন।
জাতিসংঘের উপ-মহাসচিব ইয়ান এলিয়াসন বলেছেন, এখন একথা বলার সময় এসেছে যে, যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়।
জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে হামলা চালানোর পর বান কি মুন বললেন, এ হামলা একেবারে অগ্রহণযোগ্য। এর আগে ঘুমন্ত নারী-পুরুষ ও শিশুদের ওপর হামলা চালিয়ে যে ১২০০ লোককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে এটা কি গ্রহণযোগ্য ছিল? জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে হামলার পর নাকি বিশ্ববাসী স্কুব্ধ হয়েছে। এর আগেও তো গাজার একটি স্কুলে ইসরাইলী নরপশুরা হামলা করেছে। সে সময় কি বিশ্ববাসী নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছিল? জাতিসংঘের উপ-মহাসচিব বলেছেন, এখন কথা বলার সময় এসেছে। আর না, যথেষ্ট হয়েছে! এর মানে কি তাদের পরিচালিত স্কুলে হামলা চালানোর আগ পর্যন্ত যথেষ্ট ছিল না।
আসলে জাতিসংঘের এই নিন্দা আর প্রতিবাদ কি গাজার মুসলমানদের জন্য নাকি তাদের অর্থে নির্মিত স্কুল ভবনটি ধ্বংসের জন্য? স্কুলটিতে হামলার আগ পর্যন্ত জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে আসছে। এর আগেতো একবারও জাতিসংঘ মহাসচিব ইসরাইলী সন্ত্রাসীদের বিচার দাবি করেননি।
নির্যাতিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ গঠন হলেও এটা এখন মার্কিনীদের একটি গৃহপালিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইহুদী-খ্রিস্টানরা যখনই বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছে তখনই জাতিসংঘ নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে। গত বছর যখন মিয়ানমারের নাসাকা বাহিনী রাখাইন মুসলমানদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে তখনও জাতিসংঘ ছিল নিশ্চুপ। এ জন্যে না বলে উপায় নেই যে, এটা মুসলমানদের জন্য নয়, এটা হলো বিশ্বের ইহুদী-খ্রিস্টানদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জাতিসংঘ।
লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button