গাজ্জা যুদ্ধের অনুচিন্তন

Azzamআযযাম তামিমি
প্রথমত: ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ বাহিনী ও ইজরাইলের মাঝে সম্পন্ন হওয়া সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতিটির মাধ্যমে গাজার মানুষ যা চাচ্ছিল তার সবটা তারা অর্জন করতে পারেনি। সেইসাথে ইজরাইল যা আশা করছিলো সেটার কিছুই এই যুদ্ধবিরতি দ্বারা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত দুইটি পক্ষ থেকে শেষ-মেষ এই চুক্তিতে রাজি হওয়ার কারণ হচ্ছে তাদের এই বিশ্বাস যে, উদ্ভূত সার্বিক পরিস্থিতিতে এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়ার কোনও পথই খোলা ছিল না।
এটা সত্য যে ইজরাইল গাজ্জার বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধে আরব জাতি-রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে নজিরবিহীন সহযোগিতা উপভোগ করেছিলো এবং গাজ্জায় যত বেশি সম্ভব ক্ষতিসাধন করে আত্মসমর্পণের জন্য হামাসের উপর চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু আরব ভূখণ্ড থেকে লাগাতার উৎসাহ পেয়েছে তারা। এর পরেও তারা গাজ্জার প্রতিরোধকে পঙ্গু করে দিতে পারেনি তাদেরকে অথবা তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতেও বাধ্য করতে পারেনি। গাজ্জার প্রতিরোধের ব্যাপারে কথা হল, অবরোধ এবং দুর্ভোগ স্বত্বেও এটা নিশ্চিতই গাজার জনগণের পক্ষ থেকে নিঃশর্ত ভাবে পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছে এই আশায় যে, অন্তত এই সংঘর্ষের মাধ্যমে গাজ্জা উপত্যকায় প্রায় আট বছর ধরে চলতে থাকা অবরোধ থেকে মুক্তি আসবে। এতদ স্বত্বেও প্রতিরোধের পক্ষে অবশেষে সত্যিই অবরোধ তুলে নেয়া হবে কিনা তার নিশ্চিত গ্যারান্টি পাওয়া সম্ভব হয়নি।
দ্বিতীয়তঃ ভারি কামান সম্বলিত যুদ্ধযান এবং রকেট হামলাগুলো থেমে গেছে এবং বিরক্তিকর ও ভয়ংকর ইজরাইলি যুদ্ধ বিমানের শাঁই শাঁই শব্দ গাজ্জার আকাশে আর নেই। তবে প্রচার যুদ্ধটা আরও কিছু কাল রয়ে যাবে। প্রত্যেক পক্ষই নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল হয়েছে দাবি করে নিজেদের বিজয় হয়েছে বলে প্রমাণ করতে চাইবে।
ইজরাইলিরা মনে করে অবরোধটা চালিয়ে যাওয়াই তাদের সফলতার লক্ষণ, যেখানে প্রতিরোধকারীরা মনে করে যে তাদেরকে নিরস্ত্র করার জন্য বাধ্য করতে ইজরাইলিদেরকে ব্যর্থ করে দেয়াটাই হল বিজয়। যাইহোক, দুই পক্ষের মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য যে কারো কাছে দৃশ্যমান। যখনই যুদ্ধবিরতিটা কার্যকর হতে শুরু করেছে, গাজ্জার মানুষ রাস্তায় নেমে এসে উদযাপন করেছে এবং তাদের উল্লাস প্রকাশ করেছে যে সত্যিই এটা তাদের বিজয়।
অন্যদিকে ইজরাইলি জনতাকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে এমনকি মর্ম-পীড়িতও দেখাচ্ছে। কিছু ইজরাইলি মনে করছে যে, যুদ্ধটায় তারা অনেক কিছুই অর্জন করেছে। ইজরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে গাজ্জার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক শুরুটা করেছিলেন। তিনি তার জনগণকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি হামাসের সশস্ত্র অবকাঠামো ও অন্যান্য প্রতিরোধ অবকাঠামো টুকরো টুকরো করে দেবেন, তিনি টানেল গুলো ধ্বংস করবেন এবং গাজ্জা থেকে উড়ে আসা রকেট গুলোর সমাপ্তি টানবেন। কিন্তু এর কিছুই অর্জিত হয়নি।
শুধু তাই নয় ২৪শে আগস্টের মধ্যে ইজরাইলের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো হামাসকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করানো। শুধু এই লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে নেতানিয়াহুর যুদ্ধ-যন্ত্র সর্বোচ্চ ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে গাজ্জার কেন্দ্রের আবাসিক ভবন গুলোকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করতে শুরু করেছিলো এই আশায় যে, এটা হামাসকে কায়রোর দরকষাকষির টেবিলে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে। এখন এটা পরিষ্কার যে, এই উপায়টি হামাসের অঙ্গিকার গুলো পূরণ হওয়ার পরেই বাস্তবায়ন হয়েছে। হামাস কমান্ডার ইন চিফ মোহাম্মেদ দেইফ হত্যা চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরিণতির পরে গাজ্জার সীমান্তবর্তী এলাকার ইজরাইলি বসতিগুলো খালি করে দেয়ার পরেই এটা হয়েছে।
সেই সাথে এই চালিয়ে যাওয়া যুদ্ধ স্কুলগুলোর নতুন শিক্ষা বর্ষকে হুমকির মুখে ফেলেছিল, তাছাড়া ইজরায়েলি অর্থনীতি ও পর্যটন ক্ষেত্রে যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সাথে ইজরাইলের আন্তর্জাতিক সুনামের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারটাও আছে।
তৃতীয়ত: দুটি পক্ষের মধ্যে সামরিক শক্তির ব্যাপক তারতম্য স্বত্বেও গাজ্জার প্রতিরোধ যোদ্ধারা নিঃসন্দেহে চমৎকার করেছে। ভবিষ্যৎ বিচার বিশ্লেষণে হয়ত দেখা যাবে যে যুদ্ধক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ শক্তি ইজরাইলি শক্তিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। এটাই এখন ইজরাইলিদেরকে ক্ষুব্ধ করে তুলবে, যারা বিপক্ষের সাথে সফল হতে ব্যর্থ হয়েছে এবং পুরো গাজ্জা জুড়ে বেসামরিক স্থাপনাকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করে এগিয়ে গেছে এবং একের পর এক বেসামরিক নাগরিকদের মাঝে গণহত্যার পর গণহত্যা চালিয়ে গেছে।
দেখা যাবে যে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের শক্তি, বিশেষত হামাসের যোদ্ধারা প্রায় সকলেই অক্ষত রয়ে গেছে। এটা প্রমাণ করে যে অবরোধ স্বত্বেও প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের শক্তিমত্তা ইজরাইলিদের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়ার পর্যায়ে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনের সমর্থক জনগণকে অসাধারণ বিস্ময়ে ভরে দিতে সক্ষম হয়েছে। এই সাম্প্রতিক যুদ্ধ উন্নত রকেট প্রযুক্তি, ড্রোন তৈরি ও জটিল টানেল সহ বেশ কিছু অসাধারণ মেধাবী কৌশলের সাক্ষী হয়ে থাকবে।
চতুর্থত: ইজরাইল তার কর্তব্যগুলো পূরণ করবে কিনা কিংবা সে যুদ্ধবিরতি মেনে চলবে কিনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। অতীতে সকল ক্ষেত্রে ইজরাইলিরাই প্রত্যেক সময় ভিন্ন ভিন্ন অজুহাতে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করেছে। সেই সাথে যুদ্ধবিরতির তারিখ থেকে পরবর্তী একটি মাস পর্যায়ক্রমে দর কষাকষি চলা কালে চলতে থাকা অবরোধ শুধু অস্থিরতার মাত্রা বাড়িয়েই যেতে থাকবে যা ফের উত্তেজনার অগ্ন্যুৎপাতে রসদ যুগিয়ে যাবে। এবং একথা অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না যে, উত্তেজনার যে কারণ গুলো দখলকৃত পশ্চিম তিরে রয়েছে, গাজ্জা কিংবা অন্য যায়গার ফিলিস্তিনিদের জন্য তাদের বিষয়গুলো আর কিছুতেই এড়ানো সম্ভব নয়।
সম্ভবত প্রকৃত ও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি একমাত্র আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তা সম্পন্ন নেগোশিয়েটেড প্যাকেজের (negotiated package) মধ্য দিয়েই সম্ভব, এটাই ইজরাইলের জন্য নিরাপত্তার বিনিময়ে পশ্চিম তিরের দখলদারিত্ব ও গাজ্জায় অবরোধকে বন্ধ করবে। এটা অর্জন করতে না পারলে অনিবার্যভাবেই আগে কিংবা পরে পুনরায় যুদ্ধের সূচনা করবে।
পঞ্চমত: ফিলিস্তিনি প্রতিরোধকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মিশর কর্তৃক পালিত ভূমিকাটা মোটেই সন্তোষজনক ছিলনা। এই ভূমিকা আসলে মিশরকে নেতানিয়াহু কর্তৃকই অর্পিত করা হয়েছিল যে কিনা ফিলিস্তিনের সাথে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি এবং তার মিলিটারি ছাড়া আর কাউকেই বিশ্বস্ত হিসেবে ভাবতে পারছিল না। সুতরাং কাতার, তুর্কি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এমনকি আমেরিকার পক্ষ থেকে মধ্যস্থতার প্রস্তাব ইজরাইলের নাকচ করে দেয়াটা কোনও আশ্চর্যের বিষয় ছিল না।
মিশরের পালিত ভূমিকাটি আরব-ইজরাইলি নজির বিহীন জোটবদ্ধতা থেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। যেখানে দেখা গিয়েছে যে ইজরাইল, মিশর, সৌদি আরব, ইউনাইটেড আরব নেশন্স এবং কিছু ক্ষেত্রে জর্ডান হামাসকে পঙ্গু করে দিতে একমতে পৌঁছেছিল। মিশরের এবারের মধ্যস্থতা ছিল ইজরাইলের সাথে আরও বেশি একতাবদ্ধ এবং বিগত সময়ের আমেরিকান মধ্যস্থতার চাইতে মিশরের এবারের মধ্যস্থতা ছিল ইজরাইলের প্রতি আরও বেশি সমর্থনপুষ্ট।
পরিষ্কার ভাবেই মিশরীয় ভূমিকাটা ছিল বিশেষ ভাবে হামাস বিরোধী এবং সাধারণ ভাবে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ বিরোধী মনোভাবে প্রণোদিত। ২০১৩ সালের জুলাইয়ের তের তারিখে প্রথম গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত বেসামরিক প্রধানমন্ত্রী ড মুহাম্মদ মুরসির বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা বর্তমান মিশরীয় সরকার প্রচলিত ও আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার-ভুক্ত রাজনীতি অনুসরণ করে না। মিশরের জনমানুষের স্বার্থে এই রাজনীতি পরিচালিত হয় না বরং মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে এবং তাদের সাথে যারা জড়িত এবং তাদের ব্যাপারে যারা মর্মপীড়া অনুভব করে তাদের বিরুদ্ধে আবর্তিত ঘৃণাকে কেন্দ্র করেই এই রাজনীতি পরিচালিত হয়। সাম্প্রতিক গাজ্জা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে কিছু ইজরাইলি সোচ্চার হয়ে উঠেন যে মিশরীয় মধ্যস্থতাকারীরা স্বপ্রণোদিত হয়ে যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে চেষ্টা করছে। এটা এই আশায় তারা করেছে যেন হামাসের আরও বেশি ক্ষয়-ক্ষতি হয়। মনে হচ্ছিল যেন যেকোনো ইজরাইলির চাইতে মিশরের এই সামরিক শাসকরাই যুদ্ধটিকে দীর্ঘায়িত করার জন্য বেশি উৎসুক ছিল।
ষষ্ঠত: ভবিষ্যতটা এখনও অপরিষ্কারই রয়ে গেছে। তবে খুব সম্ভবত ইজরাইলের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই যুদ্ধ-জটিলতার কিছু সরাসরি প্রভাব রয়েছে এবং এগুলো ভবিষ্যতে ঘটতে যাওয়া ঘটনাগুলোকে প্রভাবিত করবে। যুদ্ধবিরতি চুক্তিটার দরকষাকষিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সমুদ্র বন্দরের ব্যাপার, বিমান বন্দরের ব্যাপার এবং বন্দিদের কয়েক মাসের মধ্যে ফিরে আসার ব্যাপার। কিন্তু এটা বর্তমান ইজরাইলি সরকারের উপর অনেক বেশি নির্ভর করছে এবং রাজনীতি কোনদিকে মোড় নিচ্ছে সেদিকেও নির্ভর করছে।
গাজ্জা এবং তার জনগণের ব্যাপারে কথা হল, অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণভাবে উঠিয়ে নেয়া পর্যন্ত তাদের অবিচল থাকা এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প কোনও পথ নেই। গাজ্জার জনমানুষ শুধু ইজরাইলের পক্ষ থেকে অর্পিত অবরোধেরই অবসান চায় না বরং মিশরের পক্ষ থেকে অর্পিত অবরোধেরও অবসান চায়। আরেকটা সম্ভাব্য প্রভাব যা এই ব্যাপারে তাৎক্ষনিক ভাবে কাজ করতে পারে সেটা হল আরব ইজরাইলি জোটের ভাগ্য যা বর্তমান দ্বন্দ্ব সংঘাতে ইজরাইলকে সমর্থন দিয়েছে। যদি এই জোটকে অপরাধী দেশগুলোর উঠতি জনপ্রিয় গণজাগরণের হাতুড়ি দিয়ে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়া যায় তাহলে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধের উন্নতি ও শক্তিমত্তা নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পাবে।
মূল: আযযাম তামিমির
ভাষান্তর: তারিকুর রহমান শামীম, Reflections on the war on Gaza লেখাটি থেকে
(লেখক পরিচিতি: আযযাম তামিমি একজন ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ গবেষক এবং রাজনৈতিক । তিনি বর্তমানে আলহিওয়ার টিভির চেয়ারম্যান এবং এর এডিটর ইন চিফ। ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি ইন্সটিটিউট অফ ইসলামিক পলিটিকাল থট এর প্রধান ছিলেন। তার জন্ম ১৯৫৫ সালে, তিনি ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টমিনিস্টারে পড়াশোনা করেন। তার লেখা বইগুলো হল, রাশিদ ঘান্নৌশি, হামাস: এ হিস্টোরি ফ্রম উইথ-ইন সুত্র: উইকিপিডিয়া।)

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button