স্কটল্যান্ডে আজ ৭ মার্চ ২০১৪, কিন্তু…

Shofiq rahmanশফিক রেহমান
এই লেখাটি যেদিন প্রকাশিত হচ্ছে সেদিন দুপুরে বাংলাদেশে ক্যালেন্ডারের তারিখ ৩১ আগস্ট ২০১৪। এই একই দিনে সকালে স্কটল্যান্ড, তথা বৃটেনেও ক্যালেন্ডারের তারিখ একই, অর্থাৎ ৩১ আগস্ট ২০১৪।
কিন্তু যদি ১৯৭১-এ বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষিতে স্কটল্যান্ড, তথা বৃটেনের বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের তুলনা করা হয়, তাহলে, স্কটল্যান্ড, তথা বৃটেনের ক্যালেন্ডারের তারিখ আজ ৭ মার্চ ২০১৪।
৭ মার্চ ১৯৭১ -এ ঢাকায় রেসকোর্সে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রেরণাদায়ক ঐতিহাসিক ভাষণের ১৮ দিন পরে পাকিস্তান ভেঙে গিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্র, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল- ঠিক তেমনি আজ থেকে ১৮ দিন পরে ইউনাইটেড কিংডম (সংক্ষেপে ইউকে, UK) ভেঙে গিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্র, স্কটল্যান্ডের জন্ম হতে পারে। তফাৎ এই যে, ১৯৭১-এ ১৮ দিন বাংলাদেশে গণবিক্ষোভ ও নৈরাজ্যের পরে পাকিস্তান সরকার সূচিত একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের শেষে বাংলাদেশ মুক্ত ও স্বাধীন দেশ হয়েছিল। আর ২০১৪-তে স্কটল্যান্ডে ১৮ দিন পরে একটি শান্তিপূর্ণ অবাধ ও সুষ্ঠু গণভোটের শেষে ১৮ সেপ্টেম্বরে স্বাধীন স্কটল্যান্ডের জন্ম হতে পারে।
স্কটল্যান্ডে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে অনুষ্ঠেয় গণভোটের পরে স্কটল্যান্ড স্বাধীন দেশ রূপে আত্মপ্রকাশ করতে পরে, যদি গণভোটে স্কটল্যান্ডের অধিকাংশ ভোটার ইয়েস (Yes অর্থাৎ হ্যা) ভোট দেয়। ওই দিন একটি রেফারেন্ডাম বা গণভোটে ব্যালট পেপারে প্রশ্ন থাকবে, স্কটল্যান্ডের কি একটি স্বাধীন দেশ হওয়া উচিত? (Should Scotland be an independent country?) স্কটল্যান্ডে যদি ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪-তে অধিকাংশ ভোটার নো (No, অর্থাৎ না) ভোট দেয় তাহলে ইউনাইটেড কিংডম অখণ্ড থেকে যাবে।
ভোটের ফলাফল যাই হোক না কেন, ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মতো ২০১৪-তে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনো রক্তক্ষয় হবে না, কেউ মুক্তিযোদ্ধা হবার গৌরব অর্জন করতে পারবে না, কেউ রাজাকার অথবা যুদ্ধ অপরাধীর গ্লানি বহন করতে পারবে না। অর্থাৎ, একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান স্কটল্যান্ডে হবে রাজনৈতিকভাবেই। কেউ সেখানে দেশপ্রেমিক অথবা দেশদ্রোহীরূপে বিবেচিত হবে না। সমস্যার সমাধান হবে গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে।
ধর্মীয় ভিত্তিতে দেশ বিভক্তি
বৃটিশদের কাছ থেকে এখানে বাংলাদেশীদের শেখার অনেক কিছু আছে। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান যে রাজনৈতিকভাবে হতে পরে সেটা বৃটিশরা শেখা শুরু করেছিল ৯২ বছর আগে, ১৯২২ সাল থেকে, যে বছরে আয়ারল্যান্ডের ছয় ভাগের পাচ ভাগ (৫/৬) ইউনাইটেড কিংডম থেকে বেরিয়ে গিয়ে স্বাধীন আয়ারল্যান্ড নামে আত্মপ্রকাশ করে। আয়ারল্যান্ডের বাকি এক-ষষ্ঠাংশ (১/৬) থেকে যায় ইউনাইটেড কিংডমের সঙ্গে। ইউনাইটেড কিংডমের নতুন নাম হয়, ইউনাইটেড কিংডম অফ গ্রেট বৃটেন অ্যান্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড (United Kingdom of Great Britain and Northern Ireland)। এই পূর্ণ নামেই এখন ইউকে জাতিসংঘের সদস্য দেশ। (বাংলাদেশ নর্দার্ন ইউনিভার্সিটির নাম ভুল করে বাংলায় লেখা হয় নর্দান)।
নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড বা উত্তর আয়ারল্যান্ডের অধিকাংশ অধিবাসী প্রটেস্টান্ট কৃশ্চিয়ানধর্মী। তারা চায়নি অধিকাংশ ক্যাথলিক কৃশ্চিয়ানধর্মী দক্ষিণ আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে থাকতে। তারা চেয়েছিল অধিকাংশ প্রটেস্টাস্ট কৃশ্চিয়ানদের দেশ ইউকে-র সঙ্গে থাকতে। অর্থাৎ, ধর্মীয় ভিত্তিতে আয়ারল্যান্ড বিভক্ত হয়েছিল, যেমনটা পরে ১৯৪৭-এ ভারত বিভক্ত হয়েছিল। বর্তমান বাংলাদেশের পূর্বদেশ, পূর্ব পাকিস্তান, ধর্মীয় ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়ায় এখনো যারা মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করেন, তারা এই ঘটনা থেকে জানতে পারবেন, শিল্প বিপ্লবের জনক এবং আধুনিক সভ্যতার অগ্রণী দেশ ইউকে-রও বিভক্তি হয়েছিল ধর্মীয় ভিত্তিতে। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতির পাশাপাশি আইরিশদের জাতীয় অনুভূতির স্রোতও বহমান ছিল। তাই আজও উত্তর আয়ারল্যান্ডে আইরিশ জাতীয়তাবাদ প্রবল এবং তাদের একাংশ ইউকের কবলমুক্ত হতে চায়। ঠিক তেমনই ধর্মীয় ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের দাবি ১৯৭১-এ অপ্রতিরোধ্য হয়েছিল।
দুটি সমান্তরাল অনুভূতি
আয়ারল্যান্ড-ইউকে এবং পাকিস্তান-বাংলাদেশের এই দুটি ঘটনায় প্রতিষ্ঠিত হয় যে, একটি স্বাধীন দেশের কামনায় এবং সেই স্বাধীনতা রক্ষার কামনায় দুটি অনুভূতিই, ধর্ম এবং জাতীয়তাবাদ, সমান্তরালভাবে প্রবাহিত হতে পারে। এতে নিন্দনীয় কিছু নেই – প্রশংসনীয়ও কিছু নেই। এটা শুধু বাস্তব এবং এটা মেনে নিলে একটি দেশের অধিবাসীরা শান্তিপূর্ণভাবে বেচে থাকতে পারে।
১৯২২-এ ইউকে থেকে দক্ষিণ আয়ারল্যান্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পরে উত্তর আয়ারল্যান্ডের ক্যাথলিক কৃশ্চিয়ানরা চেয়েছিল ইউকে থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ আয়ারল্যান্ডে, অর্থাৎ স্বাধীন আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে যোগ দিতে। এই লক্ষ্য অর্জনে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিদ্রোহীরা আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (সংক্ষেপে আইআরএ, IRA) গঠন করে। বৃটেনের বিরুদ্ধে তারা বহু বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও আন্দোলন করেছিল। এর ফলে বৃটেন বুঝতে পেরেছিল রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান বল প্রয়োগে নয় – শান্তিপূর্ণভাবে, গণতান্ত্রিকভাবে করাই শ্রেয়।
তাই স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা কামনার বিরুদ্ধে আজকের বৃটেন বল প্রয়োগ করেনি। বৃটেন একটি গণভোটের আয়োজন করেছে।
কিন্তু কেন স্কটল্যান্ডের একাংশ অধিবাসী স্বাধীনতা চাইছে? স্কটল্যান্ডের অধিকাংশ অধিবাসী তো প্রটেস্টাস্ট কৃশ্চিয়ান ধর্মাবলম্বী, যেমনটা ইউকেরও। ইউকের প্রায় ৭২% শতাংশ কৃশ্চিয়ানদের মধ্যে অধিকাংশ প্রটেস্টান্ট। (২০০১-এর আদমশুমারি অনুযায়ী ইউকের জনসংখ্যা ৭১.৬% কৃশ্চিয়ান, ২.৭% মুসলিম, ১% হিন্দু এবং ২৪.৭% অন্যান্য মত বা ধর্মাবলম্বী।
আয়ারল্যান্ডের ধর্ম ভিন্ন এবং আয়ারল্যান্ড ও বৃটেনের সীমান্ত সংলগ্ন নয়। কিন্তু স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের ধর্ম এক এবং দুটি অঞ্চল সংলগ্ন। তাহলে স্কটল্যান্ডের একাংশ অধিবাসী কেন স্বাধীনতাকামী সেটা জানতে হলে ইউকের একটি সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত বলতে হবে।
যেভাবে ইউকে হলো
অতীতে ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড চারটি আলাদা দেশ ছিল এবং তাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। ১৫৩৬-এ কিংডম অফ ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয় পৃন্সিপালিটি অফ ওয়েলস। ১৭০৭ সালে কিংডম অফ স্কটল্যান্ড যুক্ত হয় কিংডম অফ ইংল্যান্ডের সঙ্গে। তখন ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসের সম্মিলিত নাম হয় কিংডম অফ গ্রেট বৃটেন। এরপর ১৮০১ সালে কিংডম অফ আয়ারল্যান্ড সংযুক্ত হলে এই চারটি দেশের সম্মিলিত নাম হয় ইউনাইটেড কিংডম অফ গ্রেট বৃটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড।
৬ ডিসেম্বর ১৯২২-এ অ্যাংলো-আইরিশ চুক্তির পরে পঞ্চ-ষষ্ঠাংশ আয়ারল্যান্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন ইউকের নতুন নাম হয় ইউনাইটেড কিংডম অফ গ্রেট বৃটেন অ্যান্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড।
সংক্ষেপে ইউকে পরিচিত বৃটেন নামেও। তবে গ্রেট বৃটেন হচ্ছে বৃটিশ দ্বীপ যেখানে রয়েছে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলস। বৃটিশ বিশেষণে বোঝায় বৃটেনকে। তাই ঢাকায় যুক্তরাজ্যের দূতাবাসকে বলা যায় বৃটিশ দূতাবাস। যুক্তরাজ্যের হাই কমিশনারকে বলা যায় বৃটিশ রাষ্ট্রদূত। একীভূত বৃটেনকে বোঝানোর জন্য ২০০৬-এ একটি নতুন বৃটিশ পাসপোর্ট চালু করা হয়, যার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ইউকের নাম তিনটি ভাষায় – ইংরেজি, ওয়েলশ (Welsh) ও স্কটিশ গেইলিক।
এখন যদি ২০১৪ তে গণভোটে স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা স্বাধীন স্কটল্যান্ডের পক্ষে রায় দেয় তাহলে ভবিষ্যতে ইউকের নাম কি হবে সে বিষয়ে জল্পনা কল্পনা হচ্ছে।
প্রাসঙ্গিকভাবে আরো অনেক বিষয় আলোচিত হচ্ছে। যেমন, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস যদি ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে স্কটল্যান্ডও কি তাদের পথ অনুসরণ করবে? ইংল্যান্ডে অনেকে, বিশেষত ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির একাংশ, এখন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবার পক্ষে।
আরো প্রশ্ন উঠছে, স্কটল্যান্ডে এখন বৃটিশ কারেন্সি চালু আছে। কিন্তু স্কটল্যান্ড স্বাধীন হয়ে গেলে, তার কারেন্সি কি হবে? বৃটিশ পাউন্ড নাকি ইওরোপিয়ান ইউনিয়নের মুদ্রা ইওরো? নাকি সম্পূর্ণ নতুন একটি স্কটিশ কারেন্সি?
স্বাধীন হবার পরে স্কটল্যান্ড যদি কমনওয়েলথের সদস্য হতে চায়, তাহলে তার স্টেটাস কি হবে? ইনডিয়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো রিপাবলিক, প্রজাতন্ত্রী দেশ? নাকি অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড ও কানাডার মতো দেশ, যেখানে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ইউকের রানি।
স্পোর্টসের, বিশেষত ফুটবলের ক্ষেত্রে, স্কটল্যান্ডের একটি স্বাধীন অস্তিত্ব বহুকাল ধরে আছে। তাই ইংল্যান্ড, ওয়েলস ও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের পাশাপাশি ওয়ার্ল্ড কাপে স্কটল্যান্ডের নিজস্ব দল খেলে। এই চারটি দলের চারটি জাতীয় পতাকা আছে। ইংলিশ পৃমিয়ার লিগে ওয়েলসের ফুটবল ক্লাব কার্ডিফ সিটি খেললেও, স্কটল্যান্ডের কোনো টিম খেলে না। স্কটল্যান্ডে নিজেদের স্কটিশ পৃমিয়ার লিগ চলে যেখানে আছে খুব বিখ্যাত দুটি ক্লাব, রেনজার্স ও সেলটিক।
শান্তিপূর্ণ মীমাংসার পথে বৃটিশ সরকার
স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে বিচ্ছিন্নতাবাদিদের মন জয় করার জন্য ইংল্যান্ড তথা বৃটিশ সরকার গত কয়েক যুগ ধরে তাদের মানসিকতা বদলে ফেলে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার দিকে এগিয়ে গিয়েছে। স্কটল্যান্ড, ওয়েলস ও উত্তর আয়ারল্যান্ডকে কমবেশি পরিমাণে স্বায়ত্বশাসন দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয়েছে ডিভলিউশন (Devolution)।
তিনটি অঞ্চলের জন্য তিনটি পার্লামেন্ট বা সংসদও তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। স্কটল্যান্ডের জন্য স্কটিশ পার্লামেন্ট। ওয়েলসের জন্য ন্যাশনাল এসেম্বলি ফর ওয়েলস। উত্তর আয়ারল্যান্ডের জন্য উত্তর আয়ারল্যান্ড এসেম্বলি। এই তিনটি সংসদের ভিন্ন ভিন্ন নির্বাচন হয়। তাই বর্তমান বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বৃটেনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, বৃটেন হচ্ছে এমন একটি দেশ, যার মধ্যে আরো দেশ রয়েছে। স্কটিশ পার্লামেন্টের নেতা এবং স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার (প্রাইম মিনিস্টার নয়) হচ্ছেন এলেক্স স্যালমন্ড, যিনি স্কটিশ স্বাধীনতা প্রশ্নে ২০১৪-তে গণভোটের জন্য বৃটিশ সরকারের সঙ্গে স্কটিশ সরকারের পক্ষে এডিনবরা চুক্তিতে সই করেছেন। এই চুক্তি মোতাবেকই হতে চলেছে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪-র গণভোট।
২০১০-এ বৃটেনের সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে তিনটি জাতীয় দল, টোরি পার্টি, লেবার পার্টি ও লিবারাল ডেমক্রেট পার্টির প্রার্থীরা সম্মিলিতভাবে পার্লামেন্টের ৬৫০টি আসনের মধ্যে ৬২২-টি আসনে জয়ী হয়েছে। বাকি ২৮টি আসনে জয়ী হয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (সংক্ষেপে এসএনপি, SNP), প্লাইড কামরি (Plaid Cymru, ওয়েলস পার্টি)। এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের চারটি পার্টি। কিন্তু এসব পার্টির কোনো প্রার্থী তাদের নিজ অঞ্চলের বাইরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নি। বর্তমানে ক্ষমতাসীন বৃটিশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, ও ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী উভয়ে ইংল্যান্ডের। কিন্তু এর আগের দুই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী, টনি ব্লেয়ার এবং গর্ডন ব্রাউন ছিলেন স্কটিশ বংশোদ্ভূত। সুতরাং বলা যায়, বৃটিশ রাজনীতিতে স্কটিশদের আশা আকাক্সা অনেকটাই প্রতিফলিত হয়েছে। তবুও কেন স্কটল্যান্ডের একাংশ অধিবাসী এখন স্বাধীনতা চাইছে? নিচে কয়েকটি কারণ দেওয়া হলো :
মূল কারণ তেল সম্পদ
১ স্কটল্যান্ডের তেল সম্পদ। স্কটিশ সরকারের ধারণা, ইউকে সহ ইইউ-এর তেল সম্পদের মধ্যে ৬৪% স্কটল্যান্ডের সমুদ্র সীমায়, নর্থ সি-তে। ডেভিড হিউম ইন্সটিটিউটের মতে স্কটল্যান্ড বসে আছে ৪ টৃলিয়ন পাউন্ড তেল ও গ্যাস রিজার্ভের ওপর। সুতরাং এই সম্পদ যদি শুধু স্কটল্যান্ডবাসীদের ওপর খরচ করা যায়, তাহলে স্কটল্যান্ডের চেহারার আমূল পরিবর্তন ঘটে যাবে। তাই এসএনপির স্লোগান হয়েছে, ইটস স্কটল্যান্ডস অয়েল (It’s Scotland’s Oil – এটা স্কটল্যান্ডের তেল)।
২ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ। বৃটিশ সরকারের ট্রাইডেন্ট পারমানবিক অস্ত্র নিজ অঞ্চলের বাইরে রাখতে চায় স্কটল্যান্ড। স্কটল্যান্ডে যারা পারমানবিক অস্ত্র বিরোধী তাদের সংগঠনসমূহ এই কারণে এসএনপিকে সমর্থন দিচ্ছে। স্কটিশরা চাইছে তাদের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয় দুটি নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করবে।
৩ রিনিউয়েবল এনার্জি বা নবায়নযোগ্য শক্তি। স্কটল্যান্ড মনে করে ইওরোপের বায়ু এনার্জি (Wind Energy)-র ২৫% শতাংশ এবং ইওরোপের টাইডাল এবং ওয়েভ এনার্জি (Tidal and Wave Energy)-র ৩৫% শতাংশ আছে স্কটল্যান্ডে। স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার এলেক্স স্যালমন্ডও বলেছেন, এর ফলে স্কটল্যান্ডের নতুন শিল্পায়ন সম্ভব হবে।
৪ সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ। স্কটল্যান্ডের অধিবাসীরা মনে করছে তাদের অঞ্চলে সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ হবে। নতুন কালচারাল সৃষ্টি হবে। স্কটল্যান্ডে আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
৫ জাতিসংঘ, ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং নেটো-তে স্কটল্যান্ড তার নিজস্ব মত প্রকাশ করতে পারবে।
৬ গণতন্ত্র ও স্বায়ত্বশাসন। এ সবের ফলে স্কটল্যান্ডে প্রকৃত গণতন্ত্র ও স্বায়ত্বশাসন চালু হবে।
বিপরীত যুক্তি সমূহ
বিপরীত পক্ষে, অর্থাৎ স্কটল্যান্ডকে ইউকের অন্তর্ভুক্ত রাখার পক্ষে বলা হচ্ছে স্কটিশদের কাছ থেকে ইউকের মানুষকে পৃথক করা দুঃসাধ্য হবে। ২০১১-র আদমশুমারির মতে প্রায় ৭০০,০০০ প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের জন্ম হয়েছিল স্কটল্যান্ডে, তারা এখন ইউকের অন্য অঞ্চলে বাস করে। অন্যদিকে প্রায় ৪৭০,০০০ প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের স্কটল্যান্ডের বাইরে ইউকের অন্য অঞ্চলে জন্ম হয়েছিল, তারা এখন স্কটল্যান্ডে বাস করে।
ইউকে এখন জনসংখ্যায় (৬ কোটি ৪১ লক্ষ) বিশ্বের ২২তম দেশ। রাজধানী লন্ডন একটি গ্লোবাল সিটি এবং বিশ্বের গুটিকয়েক গুরুত্বপূর্ণ ফিনানশিয়াল সেন্টারের অন্যতম। সামরিকভাবে যেসব দেশ বিশ্বে সবচেয়ে বেশি খরচ করে তাদের মধ্যে বৃটেনের স্থান চতুর্থ থেকে ষষ্ঠের মধ্যে ওঠানামা করে। বৃটেন একটি পারমানবিক শক্তি। অর্থাৎ, সামরিকভাবে বৃটেন খুব শক্তিশালি দেশ। জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলের পাচটি স্থায়ী সদস্য দেশের অন্যতম বৃটেন। বিশ্বের ষষ্ঠতম বৃহৎ ইকনমি বৃটেনে যার আছে অষ্টম বৃহৎ ক্রয় ক্ষমতা। তাই মিলিটারি, অর্থনৈতিক, সাংষ্কৃতিক, বৈজ্ঞানিক এবং রাজনৈতিক কারণে বৃটেন আন্তর্জাতিকভাবে খুব প্রভাবশালী।
স্কটল্যান্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এসব শক্তি, সম্মান ও গৌরব থেকে বঞ্চিত হবে এবং তেল সমৃদ্ধ হলেও মিডল ইস্টের দেশগুলোর মতো দুর্বল হবে। পরিণামে স্কটল্যান্ডের তেল সম্পদ থাকলেও তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্কটিশদের হাতে না-ও থাকতে পারে।
জনমত জরিপে বৃটেনের ভীতি
এসব কারণে স্কটল্যান্ডের নো ভোটের পক্ষপাতীরা এবং বৃটেনের অন্যান্য অঞ্চলের ভোটাররা এতদিন মনে করেছিল স্কটিশরা নিজেদের স্বার্থেই ইউকে-তে থাকবে। ইউকের কিছু সাম্প্রতিক জনমত জরিপে এমনটাই প্রতিফলিত হচ্ছিল।
কিন্তু চার সপ্তাহ আগে স্কটল্যান্ডে গৃহীত একটি জনমত জরিপে দেখা গেছে নো ভোটের সংখ্যা কমে গেছে। আগে নো ভোট ছিল ৫০.৩%। এখন কমে হয়েছে ৪৭.৬%। আগে ইয়েস ভোট ছিল ৩৭.২%। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ৪১.৬%। অর্থাৎ নো এবং ইয়েস ভোটের মধ্যে ব্যবধান কমে এখন হয়েছে ৬%।
যারা এখনো মনস্থির করেন নি, তাদের সংখ্যা প্রায় একই, ১০.৮% রয়ে গেছে। তার মানে আগের নো ভোটারদের মধ্যে অনেকে এখন মত পালটে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে গিয়েছে। আর যারা মনস্থির করে নি, শেষ পর্যন্ত তাদের ভোটেই স্কটল্যান্ডের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।
এর ফলে পলিটিশিয়ানরা এখন প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। ষাটের দশকে যেটা ছিল স্কটিশ অভিনেতা শন কনোরি-র স্বপ্ন, যেটাকে তখন বৃটিশরা উড়িয়ে দিয়েছিল একটা জেমস বন্ড টাইপের কল্পনা হিসেবে যার বাস্তবায়ন কোনোদিনই সম্ভব হবে না – সেটা কি এখন প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে বাস্তবে রূপান্তরিত হতে চলেছে? আর তাই ২৮ আগস্ট ২০১৪-তে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়েছেন স্কটল্যান্ডে গ্লাসগো শহরে। সেখানে হিলটন হোটেলে একটি প্রেস কনফারেন্সে ক্যামেরন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্কটল্যান্ডকে ‘‘শিগগিরই’’ আরো ক্ষমতা দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ইউকে অখ- রাখার পক্ষে বৃটেনের প্রধান তিনটি পার্টি, টোরি, লেবার ও লিবারাল ডেমক্রেট, তাদের বিবৃতি দিয়েছে। এমনকি জর্জ গ্যালোওয়ে-র রেসপেক্ট পার্টিও একই মত প্রকাশ করেছে।
বৃটিশ মিডিয়া এতদিন পর্যন্ত এই উদ্বেগজনক ইসুটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তাদের সংবাদে এই ইসু এখনো হেডলাইন হয়নি। ডেভিড ক্যামেরনের প্রেস কনফারেন্সের সংবাদ মাত্র কয়েক ঘণ্টা অনলাইনে পঞ্চম স্থানে ছিল। রয়টার্স, এএফপি এবং এপি, প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাসমূহ স্কটল্যান্ডের সম্ভাব্য স্বাধীনতা প্রসঙ্গে খুব কম সংবাদ ও সংবাদ বিশ্লেষণ রিলিজ করেছে। বিবিসি-ও স্কটল্যান্ড স্বাধীনতা প্রসঙ্গে যথাসম্ভব কম খবর দিয়েছে।
স্কটল্যান্ডে স্বাধীনতার জোয়ার ঠেকানোর জন্য ‘‘বেটার টুগেদার’’ (Better Together এক সঙ্গে থাকাই ভালো) নামে একটি রাজনৈতিক মঞ্চ এখন সক্রিয় হয়েছে।
এসবের ফলে হয়তো গণভোটে, স্কটল্যান্ড স্বাধীনতাকামীরা পরাজিত হবে। যদি তারা বিজয়ী হয়, তাহলেও, কখন ও কিভাবে স্কটল্যান্ড পূর্ণ স্বাধীন হবে সে বিষয়গুলো অনিশ্চিত আছে। অবশ্য এলেক্স স্যালমন্ড বলেছেন, ইয়েস ভোটই বিজয়ী হবে এবং আগামী বছরে স্বাধীন স্কটল্যান্ড আত্মপ্রকাশ করবে।
ভিন্নমত মোকাবিলায় শক্তি নয়, যুক্তি
গণভোটের ফলাফল যাই হোক না কেন, বৃটেন এটা প্রতিষ্ঠা করেছে যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোতে ভিন্নমত মোকাবিলায় শক্তি নয়, যুক্তি- সহিংস নয়, অহিংস পরিবেশ কাম্য। উত্তর আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতাকামীদের দমন করতে গিয়ে গত কয়েক যুগে বহু ব্যক্তি হতাহত হয়েছে এবং বিশেষত গোটা ইংল্যান্ড নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছে। তাই বৃটিশ সরকার এবার সেই পথে এগোয়নি। স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামীদের দমন ও হত্যার জন্য বৃটিশ আর্মি ও পুলিশ নিযুক্ত হয়নি। বরং স্কটিশদের যুক্তি যে অসার সেটা প্রমাণের জন্য টিভি বিতর্কে স্কটিশ ফার্স্ট মিনিস্টার এলেক্স স্যালমন্ডের মুখোমুখি হয়েছেন বৃটিশ মুখপাত্র অ্যালিস্টেয়ার ডারলিং। স্কটিশ ও বৃটিশ পত্রপত্রিকায় এখন উভয় পক্ষের মতামত প্রকাশিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে নিখোজ ভোট
বৃটেন তার সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে যাচ্ছে গণতান্ত্রিক ও অহিংসভাবে। ৩০৭ বছরের পুরনো একটি দেশ এখন বিভক্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় পড়েছে। এর চাইতে বড় সংকট একটি দেশে আর কি হতে পারে? তবুও বৃটেনে এই ইসুতে কেউ গ্রেফতার হয়নি। কেউ হতাহত হয়নি। কারো বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়নি।
কিন্তু বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন লঘুতর ইসুতে মানুষ হয়রানি, গ্রেফতার, আহত এবং নিহত হয়েছে। বহু মানুষের বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা করা হয়েছে। সারা বাংলাদেশ জুড়ে সেইসব মামলায় দিনের পর দিন হাজিরা দিতে হচ্ছে শত শত মানুষকে। তদের মূল অপরাধ একটাই – তারা ভিন্ন মত পোষণ করে। তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়।
বর্তমানে ক্ষমতাসীন অনির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার সাধারণ মানুষের এই দাবি মেনে নিতে নারাজ। বরং অবৈধ প্রধানমন্ত্রী এবং অবৈধ মন্ত্রীরা পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঘোষণা করে চলেছেন আওয়ামী লীগ একটানা কতো বছর ক্ষমতায় থাকবে তার বিভিন্ন সময়কাল। আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশে ভোট এবং ভোটার নিখোজ করে দেওয়ার অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ স্থির করেছে জানুয়ারি ২০১৪-র মতোই তারা ভবিষ্যতেও নিখোজ ভোটে নির্বাচন করবে।
উত্তর আয়ারল্যান্ডে বৃটিশ সরকার যে ভুল করেছিল সেখান থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকার যে ভুল করেছিল সেখান থেকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কোনো শিক্ষা নেয়নি।
এর অবশ্যম্ভাবী পরিণাম- ভয়াবহ।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button