জামায়াত : মওদুদীবাদ থেকে হেমা মালিনীর দর্শনে !

Jamaatস্টালিন সরকার:
জামায়াতের ওপর দিয়ে ক’বছর সুনামি বয়ে গেছে। দলের নেতাকর্মীদের জেল-জুলুম-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। মগবাজারের দলের কেন্দ্রীয় সদর সফতর, পল্টনের ঢাকা মহানগর কার্যালয়সহ মাঠ পর্যায়ের অনেক কার্যালয় বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জামায়াত-শিবির দেখলেই তেড়ে যেত আইন শৃংখলা বাহিনী। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক এই দলটির কেন্দ্র থেকে শুরু করে শেকড় পর্যায়ের অনেক নেতা ছিলেন ফেরার। মানব চরিত্রই হলো কারো ওপর অন্যায়ভাবে জুলুম-নির্যাতন হলে তার প্রতি মানুষের সহানুভূতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু জামায়াতের ক্ষেত্রে দেখা গেল ব্যতিক্রম। সুবিধাবাদী আর ধুরন্ধর কৌশলী হওয়ায় দলটি মানুষের সহানুভূতি আদায় করতে পারেনি। বরং মানুষ দলটির আদর্শ নীতি নৈতিকতার পাশাপাশি চাতুরি নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছে। বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো জামায়াতকে সন্দেহের চোখে দেখছে।
মূলত রাজনৈতিক অঙ্গনের খবর হলো, ২০ দলীয় জোটে প্রকাশ্যে থাকলেও পর্দার নেপথ্যে সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ যাচ্ছে না জামায়াতের। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে অপ্রকাশ্যে দলটির বোঝাপড়া বেশ চমৎকার। ইসলামী ধারার রাজনীতির মওদুদীবাদে বিশ্বাসী দলটি সুবিধাবাদী কৌশল গ্রহণ করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ষাটের দশকের বলিউডের ড্রিম গার্ল হেমা মালিনীর ব্যক্তি দর্শনের মতই এগুচ্ছে। শাপলা চত্বরে পুলিশের সঙ্গে ফুল বিনিময়ের মাধ্যমে এটা শুরু হয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মাঝে মাঝে প্রশ্ন করছেন জামায়াত তুমি কার? বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের না ক্ষমতাসীন সরকারের? বর্তমানে যাদের বয়স ৬৫ থেকে ৭৫ এবং যারা সিনেমা জগতের খোঁজখবর রাখেন তাদের যৌবনকালে হেমা মালিনীর ‘বোমা ফাটানো’ উক্তি মনে থাকার কথা। হিন্দি সিনেমার নায়িকা হেমা মালিনীর প্রেম ছিল সিনেমা জগতের আরেক তরুণ সঞ্জীব কুমারের সঙ্গে। কিন্তু হেমার বিয়ে হয় সিনেমার নায়ক ধর্মেন্দ্রের সঙ্গে। সে সময় হেমা গর্ব করে বলেছিলেন, ‘আমি সঞ্জীব কুমারের প্রেমিকা থাকবো; কিন্তু ধর্মেন্দ্র’র সন্তানের ‘মা’ হবো। হেমা মালিনীর এ বক্তব্য নিয়ে সিনে ম্যাগাজিনগুলো চুটিয়ে ব্যবসা করেছে কয়েক মাস। জামায়াতের অবস্থাও যেন হেমা মালিনীর মতো হয়ে গেছে। দলটি হেমা মালিনীর দর্শনের মতো দু’কূল রক্ষা করে চলছেন। হেমা যেমন স্বামী এবং প্রেমিকের সঙ্গে একই সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিলেন; জামায়াতও তেমনি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে থাকলেও পর্দার আড়ালে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলছেন। দলটির সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশই বর্তমানে কারাগারে। যারা বাইরে রয়েছেন তাদের আচরণ বেশ রহস্যজনক। জামায়াত দিনের আলোয় পুরনো মিত্র বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের সঙ্গে থাকলেও কার্যত তারা সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই রাজনীতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে দলটির যে অবস্থা ছিল নির্বাচনের পর সে অবস্থা নেই। যার কারণে স্থানীয় নির্বাচনে দলটি অপ্রত্যাশিত ভালো ফলাফল করেছে।
পর্দার অন্তরালে জামায়াতের সঙ্গে সরকারের সমঝোতা নিয়ে সর্বত্র বিতর্ক হচ্ছে। বিএনপিসহ সুশীল সমাজ, বিশিষ্টজনদের অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখছে জামায়াতকে। দলটিকে নিয়ে সন্দেহের  কারণ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে জামায়াতের যে যুদ্ধংদেহী চেহারায় দেখা গেছে, নির্বাচনের পরে তা মিলিয়ে গেছে। নির্বাচনের আগে সরকার জামায়াতের ওপর যেভাবে দমন-পীড়ন চালিয়েছে নির্বাচনের পরে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। সাঈদী ইস্যুতে সারাদেশে যেভাবে জামায়াতের ওপর জুলুম-নির্যাতন হয়েছে তা ছিল ভয়ঙ্কর এবং অমানবিক। জামায়াতের রাজনীতি যারা পছন্দ করেন না তারাও সে সময়ে দলটির প্রতি সহানুভূতিশীল মন্তব্য করেন। কিন্তু সাঈদী ইস্যুতে আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের সহায়তা করলেও জামায়াতের বাইরে যারা নিহত হন তাদের খোঁজ নেয়নি দলটি। যার ফলে দলটির সঙ্গে সাধারণ মানুষের পুরনো দূরত্ব কমেনি বরং বেড়েছে। দলটির জেলা পর্যায়ের অফিসগুলোর অধিকাংশ বন্ধ করে দেয়া হলেও পর্দার আড়ালে সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। জামায়াতের পরিসংখ্যান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে দলটির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ৩০ হাজার মামলা হয়েছে। আর নির্বাচনের পরে হয়েছে মাত্র ৫ হাজার। তাও আগের আন্দোলনের জেরে। দলটির দাবি নির্বাচনের আগে ৫০ হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর নির্বাচনের পর এখন পর্যন্ত মাত্র ১০ হাজার নেতাকর্মী আটক হয়েছেন। নির্বাচনের আগে জামায়াত নেতাকর্মীর জামিন পাওয়া ছিল দুরূহ ব্যাপার। কিন্তু বর্তমানে তাদের নেতাকর্মী সহজেই জামিন পেয়ে বেরিয়ে আসছেন। সন্দেহের আরো কারণ নির্বাচনের আগে জামায়াত ও ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতাই প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে কোনো বৈঠকে মিলিত হননি। কিন্তু নির্বাচনপরবর্তী সময়ে সরকারের এক মন্ত্রী লন্ডনে জামায়াতের অন্যতম এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন বলে মিডিয়ায় খবর বেরিয়েছে। এছাড়া অন্য সময়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কোনো নেতার মামলার রায়ের দিনেও হরতালসহ বড় ধরনের কর্মসূচি দিতে দেখা গেলেও মতিউর রহমান নিজামীর রায়ের তারিখ ঘোষণার পরও দলটি কোনো কর্মসূচি দেয়নি। সন্দেহের আরো কারণ হলো, এতদিন সামনে থেকে বিরোধী জোটের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকলেও এখন জামায়াত সুর বদল করেছে। তারা এখন বিএনপির পেছনে আন্দোলনের মাঠে থাকবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। আর নতুন করে আন্দোলন জোরদার করার তেমন কোনো সাংগঠনিক পরিকল্পনাও তাদের নেই। জামায়াত সম্পর্কে সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের বক্তব্যে নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে। আন্দোলন প্রশ্নে জামায়াতের রহস্যজনক আচরণ দেখে ২০ দলীয় জোটের নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, জাতীয় পার্টিকে দিয়ে এর আগে খেলা হয়েছে; সরকার এবার জামায়াতকে দিয়ে একই খেলা খেলতে চায়। সে কারণে আন্দোলন ইস্যুতে বিএনপির ডাকে আর আগের মতো সাড়া দিচ্ছে না দলটি। সে জন্য সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার সন্দেহ আরো বাড়ছে। তবে জামায়াতের দাবি সরকারের সঙ্গে সরাসরি জামায়াত কোনো সমঝোতার চেষ্টা করেনি। কিন্তু কূটনৈতিকদের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করছে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ইউরোপ, আমেরকিা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফর করে এ ব্যাপারে কাজ করছেন। জামায়াত সরকারের সঙ্গে পর্দার আড়ালে সমঝোতার কথা যতই অস্বীকার করুক জামায়াতকে নিয়ে সরকার লুকোছাপা খেলছে এটা পরিষ্কার। আর জামায়াতও ২০ দলীয় জোটে থাকার ব্যাপারে প্রকাশ্যে দৃঢ়তা দেখালেও তলে তলে দলের স্বার্থ সংরক্ষণে গোপন আঁতাত করছে। মওদুদীবাদী দলটির দু’কূল রক্ষা করে টিকে থাকার এ কৌশল অনেকটা হিন্দি সিনেমার ড্রিম গার্লখ্যাত হেমা মালিনীর দর্শনের মতোই। শেষ পর্যন্ত হেমা মালিনীর দর্শনে চলছে জামায়াত?

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button