আমরা কি মুসলমান ?

হামিদ মীর
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুসলমান মুসলমানের ভাই। কেউ কারো ওপর জুলুম করবে না। বিপদের সময় একজন অপরজনকে অসহায় রেখে অপদস্থ করবে না। তাকে তুচ্ছ ভাববে না। পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এই বাণীর ওপর মুসলমানেরা আমল করলে তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু আফসোস, মুসলমানদের অধিকাংশ একে অপরের ভাই হওয়ার পরিবর্তে অন্যের ওপর নিজের মনগড়া ইসলাম চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। ইসলামকে বাস্তবায়নের পরিবর্তে তর্ক-বিতর্কের মধ্যে সীমিত করে দেয়া হয়েছে। এক ইসলামের মধ্যে কয়েকটি ইসলাম ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আপনার আশপাশে দৃষ্টি বুলান। উত্তর ওয়াজিরিস্তান থেকে করাচি পর্যন্ত এবং করাচি থেকে কোয়েটা পর্যন্ত মুসলমান মুসলমানদের ওপর জুলুম করছে। কোথাও জালেমদের একটি অংশ মজলুমদের পশ্চিমা এজেন্ট আখ্যায়িত করে বোমা হামলার ল্যবস্তু বানাচ্ছে, আবার কোথাও নিজেকে মজলুম দাবিদার জালেমের বিরুদ্ধে পাল্টা জবাবে নিষ্পাপ নারী-শিশুকে হত্যা করছে। মুসলমানদের প্রতিটি গ্র“প নিজেদের ভ্রান্তনীতিকেই সঠিক বলে অভিহিত করছে। আর এ সকল সত্যপূজারি একে অপরের সাথে বন্দুক ও বোমার ভাষায় কথা বলছে।
একটা সময় ছিল, যখন সারা দুনিয়ার মুসলমান সঙ্কটময় মুহূর্তে পাকিস্তানমুখী হতো। আজ এমন এক সময় এসেছে, যখন উত্তর ওয়াজিরিস্তানে বোমাবর্ষণের কারণে হাজার হাজার পাকিস্তানি নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে আফগানিস্তান চলে গেছেন ও যাচ্ছেন। বিবিসির তথ্য মতে, শুধু আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশেই উত্তর ওয়াজিরিস্তানের রেজিস্টার্ড শরণার্থীর সংখ্যা সাত হাজারের বেশি। আফগান সরকার দাবি করেছে, তারা ওই পাকিস্তানিদের সঠিক দেখাশুনা করছে। অপর দিকে উত্তর ওয়াজিরিস্তান থেকে খায়বার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের বিভিন্ন শহরে আশ্রয়গ্রহণকারীর সংখ্যা এক লাখের কাছাকাছি। গরমের এই মওসুমে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় কোনো সরকারই ওই মজলুমদের সাহায্যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। উত্তর ওয়াজিরিস্তানে এক দিকে সশস্ত্র গ্র“পগুলো পরস্পরে লড়াই করছে, অপর দিকে পাাকিস্তান সেখানে বিমানে বোমাবর্ষণ শুরু করেছে। আরেক দিকে আমেরিকা পুনরায় ড্রোন হামলা শুরু করেছে। উত্তর ওয়াজিরিস্তানে কি বিমান হামলার পরিবর্তে পরিকল্পিত সমন্বিত অভিযান হতে পারত না? আমেরিকার নতুন ড্রোন হামলা কি পাকিস্তান সরকারের তাগিদেই শুরু হয়েছে? এ প্রশ্নগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমার আবেদন শুধু এই যে, যদি পরস্পরকে মারা খুবই প্রয়োজন হয়, তাহলে শুধু মুসলমান পুরুষরা একে অন্যের ওপর হামলা করুক এবং বোমা মারুক। কমপে নারী ও শিশুদের এসব থেকে দূরে রাখা হোক। যদি এটাও সম্ভব না হয়, তাহলে নিদেনপে ওই সব নারী ও শিশুকে গরমের প্রখরতায় যেন কষ্ট দেয়া না হয়। কয়েকজন আলেম আমাকে বলেছেন, উত্তর ওয়াজিরিস্তান থেকে জানিখেলে আসা একটি শরণার্থী পারিবারের এক নারী ও দুই শিশু প্রচণ্ড গরমের কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। স্থানীয় গোত্র-অধিপতিরা এই ঘটনা মিডিয়াকে জানালে মিডিয়ার প্রতিনিধিদের জানিখেলে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। কত বড় আফসোসের কথা যে, পাকিস্তানের মিডিয়া আফগানিস্তান থেকে নিয়ে ফিলিস্তিন পর্যন্ত সব যুদ্ধেেত্র ঢুকতে পারে, কিন্তু জানিখেলে ঢুকতে পারে না।
গত কয়েক মাস ধরে এক আরব সাংবাদিক বন্ধু আমাকে সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় সফরের দাওয়াত দিচ্ছেন। ওই বন্ধুর বক্তব্য হচ্ছে, তিনি আমাকে তুরস্কের পথ ধরে সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়ে যাবেন এবং ওখানকার প্রকৃত অবস্থা স্বচে দেখিয়ে নিরাপদে ফিরিয়ে আনবেন। আমি ওই বন্ধুকে বললাম, পাকিস্তানের কিছু এলাকার অবস্থা সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকার চেয়ে ভিন্ন নয়। তাই সিরিয়া যেতে মন টানছে না। কিছু দিন আগে ওই আরব সাংবাদিক আবার যোগাযোগ করেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর বললেন, সফরে যাওয়ার মতো সুস্থ হয়ে উঠলে আপনাকে ইরাকের ওই এলাকায় নিয়ে যেতে পারি, যা আইসিস দখল করে নিয়েছে। এটি ওই সংগঠন, যারা সিরিয়া ও ইরাকে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় লিপ্ত। আইসিস-এর কয়েক হাজার সশস্ত্র বাহিনী মসুলের মতো বড় শহর দখল করে নিয়েছে। এই সশস্ত্র বাহিনীর চিন্তাধারায় সাম্প্রদায়িক মনোভাব এতটাই গভীর যে আল কায়েদার মতো সংগঠনও তাদের থেকে সহযোগিতার হাত গুটিয়ে নিয়েছে। এই সংগঠনে ইরাক ও সিরিয়ার সুন্নি যুবক ছাড়াও চেচনিয়া, উজবেকিস্তান, তুরস্ক, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মিসর ও ইরানের বেলুচিস্তানের যুবকও রয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ার যুবকদের বেশির ভাগই কুর্দি। আমেরিকা আইসিস-এর বাগদাদের দিকে অগ্রসর হওয়াতে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। তবে অপর দিকে পাশ্চাত্য মিডিয়া বলছে, এই সংগঠনটি যখন সিরিয়া সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, তখন আমেরিকার মিত্র আরব রাষ্ট্রগুলোর প থেকে তারা সাহায্য পেয়েছে। কেননা এই আরব রাষ্ট্রগুলো সিরিয়াতে ইরানের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাস করতে চায়। আরব সাংবাদিক বন্ধু এটাও বলেছেন, আমেরিকার মিত্রদের সহযোগিতায় পরিচালিত এই সংগঠনে এমন কিছু পাকিস্তানি যুবকও রয়েছে, যারা পাকিস্তানে ‘আমেরিকা নিপাত যাক’ স্লোগান দেয়। আবার কিছু এমন যুবকও রয়েছে, যাদের ফিলিস্তিনে জিহাদের কথা বলে প্রতারণা করে সিরিয়ায় পৌঁছানো হয়েছে এবং এখন এ বেচারিরা সিরিয়া থেকে বের হয়ে ইরাকের ভূমি চষে বেড়াচ্ছে।
এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয় যে, আইসিস-এর বাগদাদের দিকে অগ্রসর হওয়ার অর্থ শুধু ইরাকেই নয়, বরং পুরো অঞ্চলেই সশস্ত্র সংগ্রামের প্রত্যাবর্তন। এই সংগঠনে বিভিন্ন দেশের মুসলিম যুবকদের উপস্থিতি এক বিপদসঙ্কেত। এ যুবকেরা শুধু আফগানিস্তানে অমুসলিমদের সাথে লড়াই করছে। আর পাকিস্তান থেকে নিয়ে সিরিয়া, ইরাক ও মিসর পর্যন্ত তাদের লড়াই মুসলিম সরকারের বিরুদ্ধে। কোথাও মুসলমান সরকারগুলো আমেরিকার জোটভুক্ত, কোথাও রাশিয়ার জোটভুক্ত। এই সংগঠনে অংশগ্রহণকারী কুর্দি যুবকদের ইরানের বেলুচিস্তানের সাথে যোগাযোগ ভাবনার বিষয়। এই সংগঠনের বাগদাদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রভাব ইরান ও আফগানিস্তানের পথ ধরে পাকিস্তানেও অনুপ্রবেশ করতে পারে। পাকিস্তানের মতাসীন ব্যক্তিবর্গ, উলামায়ে কেরাম ও সুশীলসমাজ ছাড়াও মিডিয়ার উচিত বেলুচিস্তানে শিয়া মতাবলম্বীদের ওপর চলমান আক্রমণের প্রতিটি দিক নিয়ে বিশ্লেষণ করা। এই সময় সিরিয়া ও ইরাকে অব্যাহত গৃহযুদ্ধের ভিত্তি হচ্ছে গোত্রগত বিদ্বেষ। পশ্চিমা বিশ্ব ও তাদের মুসলমান মিত্র দেশগুলো এই গোত্রগত বিদ্বেষে পানি ঢালার পরিবর্তে তেল ঢেলেছে। এখন ওই বিদ্বেষকে বেলুচিস্তান থেকে শুরু করে করাচি পর্যন্ত ছড়িয়ে দেয়ার অপচেষ্ট চলছে। এই গোত্রগত বিদ্বেষের পথ রোধের জন্য কি আমরা এক হতে পারি না? পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সৌদি আরব ও ইরানের স্বার্থের পরিবর্তে শুধু নিজেদের স্বার্থ সামনে রেখে আমরা কি কোনো পলিসি গ্রহণ করতে পারি না? আমাদের স্বার্থ কী? আমাদের স্বার্থ সেটাই, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের বলে দিয়েছেন, এক মুসলমান অপর মুসলমানের ওপর জুলুম করবে না এবং বিপদাপদে একে অপরকে অসহায় রেখে অপদস্থ করবে না। বলা হয়, ইসলামি প্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান বিশ্বের সপ্তম পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। অথচ আমরা উত্তর ওয়াজিরিস্তানে বোমা হামলার কারণে দেশত্যাগী শরণার্থীদের সামলানোর যোগ্য নই। পারমাণবিক শক্তিধর এই দেশটির হাজার হাজার নাগরিক আফগানিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। আমি আমার আরব সাংবাদিক বন্ধুর কাছে অপারগতা প্রকাশ করে বলেছি, বর্তমানে আমার সিরিয়া ও ইরাক যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। বরং এ মুহূর্তে আমি চাচ্ছি, গরমের এই তীব্র মওসুমে উত্তর ওয়াজিরিস্তান ও অন্যান্য গোত্রীয় অঞ্চল থেকে দেশত্যাগী মজলুমদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে এবং নিজের সাধ্যমতো তাদের সাহায্য করতে। যাতে মনকে এই সান্ত্বনা দিতে পারি যে, আমি কঠিন দুর্যোগ মুহূর্তে আমার মজলুম ভাইবোনদের একা ছেড়ে দিইনি।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১৬ জুন, ২০১৪ হতে
উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button