নন্দিত র‌্যাব, নিন্দিত র‌্যাব

Rabতোফাজ্জল হোসেন কামাল
দু‘হাজার চার সালের কথা। চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায়। স্বার্থবাদীগোষ্ঠী উস্কে দিচ্ছে অরাজকতা, সন্ত্রাস আর নানাবিধ অপরাধকে। শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্রও। দেশজুড়ে জঙ্গি তৎপরতা আর সন্ত্রাসীদের উৎপাতে আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে, এমন পরিস্থিতিতেই যাত্রা শুরু করে পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী এলিট ফোর্স হিসেবে র‌্যাপিড এ্যকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব। আপাদমস্তক কালো পোষাকের এই বাহিনীটির পথ চলার শুরু থেকেই নানা অভিযানে জঙ্গি নির্মূলে ভূমিকা রেখেছে। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে র‌্যাবের নানা কাজের প্রশংসা ছিল শুরু থেকেই। জনগণের আস্থা অর্জনে সামর্থ্য লাভ করে র‌্যাব। কিন্তু সন্ত্রাসীদের ক্রসফায়ার, এন কাউন্টার আর লাইন অব ফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার কারণে সমালোচনাও হয়েছে এ বাহিনীর বিরুদ্ধে। তবে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন এলাকায় গুম-অপহরণের ঘটনায় এ বাহিনীর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে তারা। গত কয়েক বছরে গুম, খুন, অপহরনের তাদের নাম জড়িয়ে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে র‌্যাবের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নির্যাতনের এবং র‌্যাবের রাজনৈতিক ব্যবহারের। আর নারায়ণগঞ্জে সাত জনকে ধরে নিয়ে হত্যার পর র‌্যাবের তিন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুতির পর রীতিমতো এ বাহিনীর বিলুপ্তির দাবিও উঠছে।
তবে র‌্যাব বলছে, দুই-একটি ঘটনায় র‌্যাবের অর্জনকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠার পর গত ১০ বছরে র‌্যাব অনেক ভালো কাজ করেছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা। চার দলীয় জোট সরকারের আমলে বাংলা ভাই ও শায়খ আবদুর রহমানসহ শীর্ষ জঙ্গিদের গ্রেপ্তার, চরমপন্থিদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনা, শীর্ষ সন্ত্রাসী দমনসহ আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নের চেষ্টার কারণে এ বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা আছে বলেও দাবি করেছেন র‌্যাব কর্মকর্তারা।
কদিন আগে কিশোরগঞ্জে সোনালী ব্যাংকের লুট হওয়া ১৬ কোটি টাকা উদ্ধারসহ অপরাধীদের গ্রেপ্তারের অগ্রনায়ক ছিল র‌্যাব। এছাড়া বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, জাতীয় পর্যায়ে আয়োজিত উৎসব প্রাঙ্গণে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিতেও র‌্যাব ভূয়সী প্রশংসার দাবিদার।
কিন্তু গুম-অপহরণের সঙ্গে র‌্যাবের জড়িত থাকার অভিযোগ কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে এ বাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, এ সবের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো সংগঠিত শক্তি তাদের সুনামকে নষ্ট করতে নাম ব্যবহার করছে।
তবে কি সত্যিই নন্দিত র‌্যাব এখন নিন্দিত হতে বসেছে?- জানতে চাইলে র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘দুই-একজনের জন্য গোটা বাহিনী নিয়ে সিদ্ধান্তে চলে আসা কোনোভাবেই উচিত নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হলেও কেউ কেউ যে অপরাধে জড়িয়ে পড়বে না সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা সেটাই আসল কথা। আমরা কাউকে ছাড় দেইনি, দেবও না।’
কেন র‌্যাবকে নিয়ে বিতর্ক উঠছে- জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দিয়ে একটি খারাপ কাজ করানো হলে এর চেয়ে অনেক খারাপ কাজ নিজেরাই করতে পারে। তখন তাদের জবাবদিহিতায় আনার জন্য সরকারের নৈতিক অধিকার থাকে না। শুরু থেকেই এ বাহিনীকে দিয়ে তার দায়িত্বের বাইরে কাজ করানো হয়েছে।’
সুলতানা কামাল বলেন, ‘তাদেরকে (র‌্যাব) পুরোপুরি আইনের ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে। বেআইনি কাজ করানো হয়েছে। এর ফলাফল এখন আমরা ভোগ করছি।’ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন তরফ থেকেও বিভিন্ন সময়ে র‌্যাবকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু তাতে কোন কর্ণপাত না করার কারণেই আজ র‌্যাব এমন এক অপকর্মে জড়িয়েছে যার ফলশ্রুতিতে বিলুপ্তির দাবি উঠেছে।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, যে মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে চারদলীয় জোট সরকার র‌্যাব গঠন করেছিল, বর্তমান সময়ে এসে র‌্যাব তার পথ থেকে বিচ্যত হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে অতিমাত্রায় ব্যবহারের ফলে র‌্যাবের কর্মকা- আজ বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। বর্তমান সরকার ভিন্নমত, পথ ও দলকে দমনে এলিট ফোর্স র‌্যাবকে গ্রেফতার, খুন, গুম, অপহরনসহ দমন-পীড়নের কাজে ব্যবহারের ফলে আজ র‌্যাব লক্ষ্যচ্যুত। তারা অতিমাত্রায় অতিউৎসাহী হয়ে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়েই নিন্দিত হয়ে উঠেছে বলে তাদের অভিমত।
সাত হত্যা নিয়ে বিপাকে র‌্যাব
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে হত্যার পর তাঁর পরিবারের অভিযোগের তীর র‌্যাবের দিকে। ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে র‌্যাবের একটি উপদল এই নারকীয় হত্যা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করছেন নিহত নজরুলের শ্বশুর শহিদুল ইসলাম যা গত কয়েক দিনে বার বার ওঠে এসেছে গণমাধ্যমের খবরে। ঘটনার ৯ দিনের মাথায় র‌্যাব-১১ এর তিন কর্মকর্তাকে আগাম অবসরে পাঠিয়েছে সংশ্লিষ্ট বাহিনী। এর মধ্যে একজন র‌্যাব-১১ এর সদ্য সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহাম্মদ। তিনি ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। অন্য দুইজনের একজন আরিফ হোসেন। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর মেজর পদবিধারী এক কর্মকর্তা। আর তৃতীয়জন এম এম রানা ছিলেন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা। তার পদ ছিল লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। তিনি ছিলেন নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পের প্রধান।
নারায়ণগঞ্জের এই ঘটনার পর র‌্যাবকে বিলুপ্ত করে দেয়ার দাবি তুলেছে বিএনপি। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকার সময় র‌্যাব গঠন করা হয়। যাদের হাতে র‌্যাবের জন্ম, তারাই যখন এ বাহিনীর বিলুপ্তির দাবি জানায়, তখন বিষয়টি গুরুতর বলেই মনে করেন মানবাধিকার কর্মীরা।
গুমের অভিযোগ আগেও ছিল
কেবল নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ এবং খুনই নয়, এর আগেও নানা অভিযোগ ছিল র‌্যাব নিয়ে। বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম নিখোঁজ হওয়া, বন্দুকের গুলীতে ঝালকাঠির কিশোর লিমনের পা হারানো, চট্টগ্রামে দরবারের টাকা লুট, চট্টগ্রামে স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীকে অপহরণসহ অনেক ঘটনার পেছনেই র‌্যাবের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। যদিও এখনও এগুলোর কোনোটাই প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। আবার খোঁজও মেলেনি অপহৃতদের।
সম্প্রতি ভালুকার বিভিন্ন জায়গা থেকে ৬ জনকে তুলে আনার পর তাদের অপহরণের খবরে যখন দেশজুড়ে তোলপাড় তখন কিছুই বলেনি র‌্যাব-পুলিশ। তবে ৪ জনকে তুলে আনার ৯ দিন এবং ২ জনকে ৩ দিন পরে র‌্যাব জানায় ৬ জন আছে তাদের হেফাজতে।
র‌্যাবের এই অভিযান নিয়ে উঠেছে গুরুতর আইনি প্রশ্ন। কাউকে আটক করতে হলে স্থানীয় থানায় জানানোর বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা করেনি র‌্যাব। আবার আটককৃত স্বজনদের তাদের অভিযোগের বিষয়ে জানানো হয়নি। বাধ্যবাধকতা থাকলেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তোলা হয়নি আদালতেও। এতসব অনিয়মের বিষয়ে কোনো বক্তব্যই পাওয়া যায়নি র‌্যাবের। জানতে চাইলেও এ নিয়ে কোনো কথাই বলতে চায় না তারা।
নিখোঁজই রইলেন চৌধুরী আলম
২০১০ সালের ২৫ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে এক আত্মীয়র বাসায় যাচ্ছিলেন বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম। এ সময় ইন্দিরা রোড থেকে কয়েক ব্যক্তি তাকে তুলে নিয়ে যায়। সেই থেকে এখনও নিখোঁজ তিনি। আলমের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, র‌্যাব পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে র‌্যাবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়েছে, এ ধরনের কোনো অভিযানের খবর তারা জানেন না।
চৌধুরী আলমের বড় ছেলে আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, ‘ভেতরের কষ্ট তো আর মুখে বলে প্রকাশ করতে পারব না। বুকটা চিড়ে দেখাতে পারলে হয় বুঝতেন বাবাকে ছাড়া কীভাবে আছি।’
চট্টগ্রামে দরবারের টাকা লুটের মামলায় আসামি র‌্যাব কর্মকর্তা
২০১১ সালের ৪ নবেম্বর চট্টগ্রামের আনোয়ারায় তালসরা দরবার শরিফের পীরের মাজারে তল্লাশির নামে র‌্যাব সদস্যরা ২ কোটি সাত হাজার টাকা লুট করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় র‌্যাবের এক সাবেক অধিনায়কসহ ১০ র‌্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে ডাকাতি মামলা হয়। মামলার এক নম্বর আসামি করা হয় র‌্যাব-৭-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুলফিকার আলী মজুমদারকে। আসামি বাকি ৯ র‌্যাব সদস্য হলেনÑ ক্যাপ্টেন ওহিদুল হাসান, ডিএডি আবুল বাশার, এসআই তরুণ কুমার বসু, নায়েক হাসানুজ্জামান, এএসআই জাহাঙ্গীর আলম, নায়েক মো. লিটন, কনস্টেবল সুমন, এএসআই আলী আশরাফ, সৈনিক জসিমউদ্দিন। ঘটনার সময় এরা সবাই র‌্যাব-৭-এ কর্মরত ছিলেন। মামলায় র‌্যাবের দুই সোর্সকেও আসামি করা হয়েছিল। এরা হলেন দিদারুল আলম ও আনোয়ার মিয়া।
যুবলীগ নেতা লিয়াকত অপহরণ
৫ বছর আগের কথা। লালমাটিয়ার বাসা থেকে যুবলীগ নেতা লিয়াকত হোসেনকে আটক করে নিয়ে আসে কয়েক ব্যক্তি। লিয়াকতের স্ত্রীর দাবি র‌্যাব সদস্যরা তাকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু ওই ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত খোঁজ মেলেনি যুবলীগ নেতার।
আরও যত অভিযোগ
আড়াই বছর আগে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থেকে গ্রেফতার হওয়া রাজধানীর ৯৮ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক তুষার ইসলাম টিটুরও কোনো খোঁজ পায়নি পরিবার। পরিবারের অভিযোগ, এর পেছনেও আছে র‌্যাবের হাত। চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম, রাজধানীর ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী সুজন, জহির রায়হান হিরণের ভাগ্যেও একই দশা। এদের পরিবারের অভিযোগ, র‌্যাব পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী  লোকজন তাদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এরপর হাজার চেষ্টা করেও সন্ধান মেলেনি তাদের।
লিমনের কাঁধে আজও মামলার বোঝা
গত ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে কলেজ ছাত্র লিমন হোসেন বাড়ির কাছের মাঠে গরু আনতে গিয়ে র‌্যাবের গুলীতে আহত হয়। র‌্যাব তার পায়ে গুলী করেছিল। এরপর র‌্যাবের উপসহকারী পরিচালক লুৎফর রহমান বাদি হয়ে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা করেন। একটি অস্ত্র আইনে, অপরটি সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে। ঘটনার দিন রাতে পুলিশ তাকে বরিশাল শেরেবাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করায়। পরে সেখান থেকে পঙ্গু হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসকরা তার পা কেটে ফেলেন। র‌্যাবের করা অস্ত্র মামলায় ৪৫ দিন কারাগারেও থাকতে হয় লিমনকে।
পরে মানবাধিকার কমিশন এবং গণমাধ্যমের সহযোগিতায় বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয় লিমনের পরিবার। ৬ র‌্যাব সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম। কিন্তু ওই মামলা তদন্ত করে পুলিশ প্রতিবেদনে ওই ঘটনায় র‌্যাবের কোনো দোষ ছিল না দাবি করা হয়। ওই প্রতিবেদনের ব্যাপারে বাদীপক্ষ থেকে নারাজি দেয়া হলেও কোনো কাজে আসেনি।
আতঙ্কের নাম সাদা পোশাক
অপরাধী ধরার কৌশল হিসেবে সাদা পোশাকে অভিযান চালায় পুলিশ। এটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত একটি পদ্ধতি। এটি অপরাধীদের জন্য নিঃসন্দেহে আতঙ্কের। কিন্তু সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাদা পোশাকে অভিযান রীতিমতো আতঙ্কের কারণ হয়েছে জনসাধারণের জন্য।
নারায়ণগঞ্জের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ভাই ব্যবসা করি কিন্তু মনে শান্তি নেই। দিনকাল যা হয়েছে, তাতে কঠিন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। একের পর এক ব্যবসায়ী আটক হচ্ছে। কিন্তু কারা করছে, কেন করছে এ সবের কোনো খবরই মিলছে না। এভাবে কী আর নিরাপদে বসবাস করা যায়?’
শুধু নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীই নয়, স্কুলছাত্র আবু রাইয়ানের শঙ্কাও উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। রাইয়ানের মা কুলসুম বেগম বলেন, ‘ওর স্কুল মগবাজারে। আগে বাসা থেকে হেঁটে একাই স্কুলে যেত। কিন্তু ইদানীং ছেলে একা স্কুলে যেতে চায় না।’ কারণ জানতে চাইলে সে বলে ‘আম্মু রাস্তায় কালো পোশাকের র‌্যাব দাঁড়িয়ে থাকে। আমার ভয় লাগে। মনে হয় গুলী করবে। ছেলে নারায়ণগঞ্জ হত্যার খবর টেলিভিশনে দেখার পর থেকে এ রকম আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে।’
শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই নয়, এই কৌশলকে আয়ত্তে এনে গুরুতর অপরাধ করছে সন্ত্রাসী চক্র। সাদা পোশাকে অস্ত্রের মুখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে লোকজনকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। পরে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো তথ্য জানা যায় না। তাহলে কারা করছে এসব- সে প্রশ্নের জবাবও মিলছে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
দেশজুড়ে আলোচনার মুখে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সাদা পোশাকে অভিযান পরিহার করতে নির্দেশ দেন। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশে সব গাড়ির কালো গ্লাস ১০ মের মধ্যে খুলে ফেলার জন্য বলা হয়।
রাজনৈতিক দলগুলো যা বলছে
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘সরকার কখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজে হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু সরকারকে বিব্রত করার জন্য কেউ এসব করছে কি না খতিয়ে দেখতে হবে।’
প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। এ ঘটনায় যাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। নিহত নজরুলের শ্বশুর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করেছেন, সেটা উড়িয়ে দেয়া যায় না।’
সারা দেশে র‌্যাবের নামে এসব অভিযোগ ও গুম-খুনের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘র‌্যাবের মূল উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাসী, জঙ্গি ও চাঁদাবাজদের দমন করা। কিন্তু এই বাহিনীকে সরকার যেভাবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ব্যবহার করেছে তাতে লোকজন এই বাহিনীর দিকে আঙুল তুলে কথা বলার সাহস পাচ্ছে। অথচ দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে কখনই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সরকারের প্রভাব বিস্তার করা ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ মুখে সুশাসনের কথা বললেও এই কাজটিই করেছে। বিএনপির এই নেতা নারায়ণগঞ্জের ঘটনা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানান।
কী বলছেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ
র‌্যাবের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ উঠলেও কোনো সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ায় একই রকম ঘটনা বারবার ঘটছে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আইনের আওতায় এনে অন্যায়ের বিচার করা হলে অবশ্যই অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে আনা সম্ভব।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা বলেন, ‘অভিযোগগুলো গুরুতর। প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দিলে এ সন্দেহটা থাকবে না।’ তিনি বলেন, দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজন ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেয়া এবং বিচার বিভাগীয় তদন্তও হতে পারে।
সংশ্লিষ্টতার আলামত মিলছে নারায়ণগঞ্জের ঘটনায়
নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় সন্দেহভাজন সদস্যদের সংশ্লিষ্টতার আলামত র‌্যাবের তদন্তে উঠে আসছে বলে জানিয়েছে বাহিনীর একাধিক সূত্র। সূত্রগুলো বলছে, অপহরণ ও হত্যাকা-ে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে র‌্যাব এবং নূর হোসেন ছাড়া অন্য কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কারো কাছ থেকে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত তদন্তে নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলামের করা অভিযোগের বাইরে অন্য কোনো গোষ্ঠী জড়িত থাকতে পারে, এমন কোনো আলামত মেলেনি। সাত খুনে র‌্যাবের জড়িত থাকার বিষয়ে অভিযোগ আসার পর র‌্যাব চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে।
র‌্যাবে অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্ণেল জিয়াউল আহসান বলেন, ‘নূর হোসেনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। যারা অপরাধী তাদের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। সেটা র‌্যাব সদস্য হলেও।
১৯৪৯ জন সদস্যকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছে র‌্যাব
ভাল কাজের পুরস্কার এবং মন্দকাজের শাস্তির মাধ্যমেই শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে র‌্যাবে। গত দশ বছরে নানা অপরাধে নিজেদের ১৯৪৯ জন সদস্যকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছে র‌্যাব। এর মধ্যে সাতশর বেশি সদস্যকে গুরুদ-ে দ-িত করা হয়েছে। যাদের সবাই চাকরি হারানো ছাড়াও বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছেন। অন্য বাহিনীতে এ নজির কম।
র‌্যাব বিধিমালা-২০০৫ অনুযায়ী বাহিনীটির সদস্যরা অপরাধে জড়ালে বিশেষ আদালত গঠন করে বিচারের পাশাপাশি আছে সামারি কোর্ট এবং লঘুদ-ে বিভাগীয় শাস্তির ব্যবস্থা। অবশ্য র‌্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযোগ আসার পর নিজ বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে পরিচালিত এসব আদালতের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে র‌্যাবের উচ্চ পদস্থ একজন কর্মকর্তার দাবি, অভিযোগ আসার পর র‌্যাবের বিধিমালা অনুযায়ী তার তদন্ত করা হয়।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক এটিএম হাবিবুর রহমান বলেন, ‘র‌্যাব ঘটনার পর থেকে এর সদস্যদের যেকোনো ধরনের শৃঙ্খলা বহির্ভূত কর্মকা- এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। সব সময় এটি কঠোরভাবে দেখা হয়েছে। এসব অপরাধের কারণে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১৯৪৯ জন র‌্যাব সদস্যকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কোনো বাহিনীতে কর্মরত সদস্যদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে, ফৌজদারি মামলায় আদালতে মামলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে এরকম নজির সম্ভবত একমাত্র র‌্যাবেই হয়েছে। র‌্যাবে কর্মরত কোনো বাহিনীর বেআইনী কর্মকা-ের দায়ভার র‌্যাব কখনো নেয়নি এবং নেবে না।’
র‌্যাবের ওপর জনগণের আস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের উচ্চপদস্থ এই কর্মকর্তা বলেন, ‘অপরাধীদের জন্য র‌্যাব বরাবরই আতঙ্কের নাম। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে র‌্যাব এখনও আস্থার প্রতীক হয়েই আছে।’

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button