বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের টেকসই উন্নয়নের সমস্যা ও সম্ভাবনা

Cox সাবরীনা খোন্দকার:
একবিংশ শতাব্দীর দ্রুত বিকাশমান একটি শিল্প পর্যটন। প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের এক অপার সম্ভাবনাময় দেশ। দ্রুত প্রসারণশীল এই শিল্প বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেমন অভাবনীয় সুফল বয়ে এনেছে, আবার এর নেতিবাচক প্রভাবও নেহাত কম নয়। বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন তো আছেই, সাথে সাথে এ দেশের পর্যটন শিল্প উন্নয়নে অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, অসচেতনতা, অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের কারণে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য অধিকমাত্রায় হুমকির মুখে হয়ে পড়ছে। প্রকৃতিনির্ভর বাংলাদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, সমাজ-সংস্কৃতি ও পর্যটন বহুলাংশে আবর্তিত হচ্ছে জীববৈচিত্র্যকে কেন্দ্র করে। এ অবস্থায় নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে উপজীব্য করে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যবান্ধব পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলে অর্থনৈতিক সুফল বয়ে আনতে পর্যটন শিল্পের টেকসই উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।
টেকসই পর্যটন উন্নয়নের মূলত তিনটি পন্থা রয়েছে। প্রথমত, জীব, প্রজাতি ও ইকো সিস্টেমের প্রতিটি ক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্যের কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, জীববৈচিত্র্যকে পুঁজি করে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করা। এবং তৃতীয়ত, সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে অংশগ্রহণ ও দায়িত্ববোধমূলক পরিবেশবান্ধব পর্যটন সেবা সৃষ্টি করা, যা আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বর্তমানে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থানগুলো দূষণের শিকার। দেশে প্রয়োজনীয় পর্যটন বর্জ্য ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, টেকনাফ, কুয়াকাটা, সুন্দরবনের সমুদ্রসৈকত সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার। সুষ্ঠু বর্জ্যব্যবস্থা না থাকায় জাহাজ ভ্রমণকালে পর্যটকেরা তাদের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি সমুদ্রে ফেলে পরিবেশদূষণ করছে। প্রবালের ফাঁকে এসব দ্রব্যাদি জমে একধরনের নোংরা পরিবেশ সৃষ্টি করছে। কোরালের ওপর বালুর আস্তর জমে যাচ্ছে। অনেকে কোরাল কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এতে স্থানীয় জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। একই অবস্থা রাঙ্গামাটির সুভলং ঝরনা এবং বান্দরবানের  শৈলপ্রপাত এবং বগা লেকে বিদ্যমান।
অপরূপ বৈশিষ্ট্যের একমাত্র জলার বন রাতারগুলকে নিঃশেষ করার কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশের অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনও রক্ষা পায়নি অবকাঠামো বিশেজ্ঞদের হাত হতে। সুন্দরবনের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আয়োজন চলছে পুরোদমে।
টেকসই পর্যটন উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে দারিদ্র্য দূরীকরণ। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সেটি সবসময় সম্ভবপর হয় না, বরং সম্পদ কিছু শ্রেণীর মানুষের হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। পর্যটন স্থাপনার অর্জিত অর্থের সুফল স্থানীয় জনগোষ্ঠী ভোগ করতে পারে না। কারণ অভিজাত হোটেল-মোটেল গড়ে ওঠায় প্রচুর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হলেও এসব অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত স্থানীয় জনগণ যোগ্যতার অভাবে সম্পৃক্ত হতে পারছে না। অনেক সময় কর্মসংস্থানের সুযোগ পেলেও সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে সুযোগ দেয়া হয় না, যা টেকসই উন্নয়নের জন্য খুব প্রয়োজন। এসব জনগণকে শিক্ষিত তথা প্রশিক্ষিত করে তারকা হোটেলে কাজ করার জন্য যোগ্য করে তোলা ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে যায়। কেবল একটি বা দু’টি শহরভিত্তিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে সম্ভব নয়।
বিশ্বায়নের সাথে সাথে পর্যটন শিল্প বিকাশের কারণে বিদেশী সংস্কৃতির প্রভাবে নিজস্ব কৃষ্টি ম্রিয়মাণ হতে চলেছে। পর্যটক ও স্থানীয় জনগণের সামাজিক অবস্থানের পার্থক্যের কারণে স্থানীয় জনগণকে পর্যটকদের সাথে বিরূপ আচরণ করতে দেখা যায়। একইভাবে পর্যটকেরা আদিবাসী তথা স্থানীয় ঐতিহ্য দেখে অবজ্ঞা করে। পর্যটকদের সংস্পর্শে এসে স্থানীয় জীবনে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। সাথে সাথে হারিয়ে যায় হাজার বছরের মূল্যবান সাংস্কৃতিক উপদানগুলো। আমরা দেখেছি কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়াতে লালনের মাজার চত্বর এবং শিলাইদহের রবীন্দ্রনাথের কুঠি বাড়িতে উন্নয়নের নামে ইমারত কমপ্লেক্স তৈরি করে সরকার তার রাজস্ব ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছে, কিন্তু হারিয়ে যেতে বসেছে নিজস্ব কৃষ্টি।
তবুও আমরা আশায় বুক বাঁধতে ভালোবাসি। সরকার পর্যটন শিল্পের টেকসই উন্নয়ন সুনিশ্চিত করে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বান্ধব পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে ‘বিশেষ পর্ষটন অঞ্চল আইন-২০১০’ প্রণয়ন করেছে। এ ছাড়া পর্যটন স্থাপনাগুলো ধূমপানমুক্ত করার ঘোষণা এবং ‘পর্যটন সচেতনামূলক কার্যক্রম-২০১৩’ শুরু করেছে। পর্যটন শিল্পকে উৎসাহিত করতে সরকার ইতোমধ্যে সোলার প্যানেল ও বায়োটারবাইনের ওপর কর প্রত্যাহার করে নিয়েছে এবং এ খাতে বিনিয়োগকারীদের জন্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে মানসম্মত হোটেল স্থাপনে যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক রেয়াতের সুবিধা দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ রেখে পর্যটন উন্নয়নের সামগ্রিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমাদের একমাত্র চাওয়া সব নীতিমালা যেন কেবল কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ না থাকে। সব কার্যক্রম যেন বুলি আওড়ানোতেই শেষ না হয়ে যায়।
লেখিকা :  প্রভাষক, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button