ইসলামী আইনে অমুসলিমদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার অধিকার

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান : অন্যান্য রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যবস্থার ন্যায় ইসলামও আত্মীয়-অনাত্মীয় অথবা স্বদেশী ও বিদেশীদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করে থাকে। তবে এ পার্থক্য নিরূপণের ক্ষেত্রে ইসলামের স্বতন্ত্র দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
(ক) ইসলামী আদর্শকে গ্রহণ করে যে কেউ বাধার প্রাচীর অতিক্রমের সুযোগ নিতে পারে। (খ) দুটি শ্রেণীর মধ্যে পার্থিব বিষয়ে তারতম্য থাকলেও সেটা হবে খুবই সামান্য। এখানে আমরা শেষোক্ত বিষয়ে আলোকপাত করবার চেষ্টা করবো।
মুসলমানরা এ বিশ্বাস নিয়ে ইসলামী আইন-কানুন মেনে চলে যে এর ভিত্তিমূলে রয়েছে ঐশী প্রত্যাদেশ। এখানে তারা কেবলমাত্র দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতার ইচ্ছাতেই পরিচালিত হয় না। বস্তুতপক্ষে এ ধরনের বিশ্বাসের ব্যবহারিক তাৎপর্য অপরিসীম। সংখ্যাগুরুর সম্মতির ভিত্তিতে কোন কোন আইন প্রণীত হলেও সংখ্যালঘুরা সবসময় তাদের মতকে বাস্তবায়ন করার জন্য সংগ্রাম করে। আর আধুনিক গণতান্ত্রিক নিয়মে নির্বাচনের ধারাই এমন যে, একবার যারা সংখ্যালঘু হিসাবে বিবেচিত হয়েছে, পরের বারে তারাই হয়ত সংখ্যাগুরু হবে। প্রথমবারে তাদের যে মতটা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল, এবার হয়ত তাদের মতটাই প্রতিষ্ঠা পাবে। তাছাড়া এটাও লক্ষ্য করা যায় যে, যারা ক্ষমতায় আসে তারা পূর্ববর্তীগণের সমস্ত রীতি-নীতি বাতিল করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। এমন কি তারা প্রচলিত আইন কানুনকে পাল্টে ফেলে। কিন্তু ইসলামী আইনের ব্যাপারটা আলাদা। এখানে যে কেউ নির্দ্বিধায় এ কথা স্বীকার করবে যে, অন্যান্য আইনের তুলনায় ইসলামী আইন অধিকতর স্থিতিশীল। সমাজের ক্রমবিকাশ বা পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে এ নিয়ম-নীতিগুলো কতটুকু উপযোগী, এ নিয়ে কেউ কখনো প্রশ্ন তোলে না। বস্তুতপক্ষে ইসলামী আইন-কানুন আল্লাহর তরফ থেকে নির্ধারিত বিধায় এমনটি হয়ে থাকে। এখানেই রয়েছে দুনিয়ার অন্য যে কোন আইনের তুলনায় ইসলামী আইনের শ্রেষ্ঠত্ব। ইসলামী আইনে এমন কতকগুলো ধারা রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে অমুসলিমদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়। রাজনৈতিক কোন্দল যত ব্যাপক বা সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, ইসলামী আইনের কোন পরিবর্তন ঘটে না অথবা কোন শাসক বা সংসদ ইসলামী আইনের পরিবর্তন বা ভয়-ভীতির মধ্যে থাকতে হয় না। বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী কখনো সম-মর্যাদার হতে পারে না। যারা বিশ্বাসী বা মুমিন তারা যাবেন জান্নাতে। আর অবিশ্বাসীরা যাবে জাহান্নামে। এ সবই আখিরাতের বিষয়।
মুসলিম আইনবেত্তাগণের মধ্যে কেউ কেউ পার্থিব জীবনে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী- এ দুয়ের মধ্যে অধিকতর সমতা সংরক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁদের মধ্যে আদ দাউসীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁদের এ সমতা নীতির তুলনা চলে আত্মীয়স্বজনদের মধ্যকার সম্পর্কের সঙ্গে। নিম্নের আলোচনা হতে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ধর্মীয় সহনশীলতার বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন মজীদ স্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছে যে, ধর্মের ব্যাপারে কোন জোর জবরদস্তি নেই। মুসলমান শাসনাধীন অঞ্চলে যে সমস্ত অমুসলিম স্থায়ীভাবে বসবাস করে অথবা সামায়িকভাবে অবস্থান করে তাদের সকলের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাছাড়া তাদের সকলেরই বিবেক সম্মত মত প্রকাশ করার সুযোগ প্রদান করা হয়েছে।
কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, মুশরিকদের মধ্যে কেউ তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তুমি তাকে আশ্রয় দেবে যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনতে পারে অত:পর তাকে নিরাপদ স্থানে পৌছে দেবে কারণ তারা অজ্ঞ লোক (৯ ঃ ৬)। বস্তুতপক্ষে ধর্মীয়, জাতিগত, রাজনৈতিক এবং অন্যান্য কারণে নির্যাতিতদের সব সময়ে ইসলামী হুকুমতে নিরাপদ আশ্রয় পেতে দেখা যায়।
হিজরত করে নবী করীম (সা:) যখন মদীনায় আসেন তখন সেখানে বিরাজ করছিল চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা। বিভিন্ন জাতি ও উপজাতির মধ্যকার আত্মকলহ ছিল তুঙ্গে। রাষ্ট্র বা রাজা সম্পর্কে তাদের কোন প্রত্যক্ষ ধারণা ছিল না। আত্মকলহে ছিল তুঙ্গে। রাষ্ট্র বা রাজা সম্পর্কে তাদের কোন প্রত্যক্ষ ধারণা ছিল না। আত্মকলহে লিপ্ত জাতিগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য কেউ কখনো উদ্যোগ নেয়নি। প্রিয়নবী (সা:) সেই মদীনায় আসার সপ্তাহ কয়েকের মধ্যে সেখানকার জনগণকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে সমর্থ হন। তিনি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন একটি নগর রাষ্ট্র। মুসলমান, ইয়াহুদী, পৌত্তলিক একটি সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে এই নগর রাষ্ট্রের আওতার মধ্যে চলে আসে। খুব সম্ভব কিছুসংখ্যক খৃষ্টানও ছিল এই চুক্তির আওতাভুক্ত।
শুরুতে এই মুসলিম রাষ্ট্রটি ছিল সংঘ বা জাতিপুঞ্জ ধরনের। কারণ বহু জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল এ রাষ্ট্র। নগর রাষ্ট্রের লিখিত সংবিধানটি এখনো অপরিবর্তিতভাবে সংরক্ষিত আছে। সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায় লেখা আছে ‘‘মুসলমানদের জন্য তাদের দীন ইয়াহুদীদের জন্য তাদের ধর্ম।’’ এই সংবিধানটিতে এও বলা হয় যে, সেখানে প্রতিষ্ঠা পাবে সমতা ও ন্যায়বিচার। ইব্ন হিশাম এবং আবু উবায়দার বর্ণনা মতে উক্ত সংবিধানে ইহাহুদীদের চিহ্নিত করা হয়েছে মুসলমানদের একটি অংশ হিসাবে। নগর রাষ্ট্র মদীনার আশেপাশে কতকগুলো স্বাধীন ইয়াহুদী বসতি ছিল। তারাও স্বেচ্ছায় নগর রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দেয় এবং নবীজীকে গ্রহণ করে সরকার প্রধান হিসাবে। এ ঘটনা থেকে এটা অনুমান করা যায় যে মুসলিম রাষ্ট্রের সরকার প্রধান নির্বাচনের ক্ষেত্রে অমুসলমানদেরও ভোট দেয়ার সুযোগ ছিল। অন্তত দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য ছিল।
সংবিধান অনুসারে দেশের প্রতিরক্ষার বিষয়টি নগর রাষ্ট্রের সকল জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব। ইয়াহুদীরাও ছিল এর অন্তর্ভূক্ত। এটা মূলত কর্মসূচী প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণের ইঙ্গিত বহন করে। সংবিধানের আরো উল্লেখ আছে যে, চুক্তিভুক্ত গোষ্ঠী বহিরাগত দ্বারা আক্রান্ত হলে সম্মিলিতভাবে তা প্রতিহত করা হবে এবং ইয়াহুদী ও মুসলমানেরা যার যার ব্যয়ভার সে বহন করবে। চুক্তিভুক্ত সকল দল যুদ্ধ এবং শান্তি- সব সময় পরস্পরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বিরাজ করবে।
নগর রাষ্ট্র মদীনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বেশ কিছু সংখ্যক বিধর্মী পৌত্তলিক বসবাস করত। বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, নবী করীম (সা:) এ সমস্ত রাষ্ট্র মদীনা প্রতিষ্ঠার দশ বছর পর। অথচ এ সময় তাদের পারস্পরিক সম্পর্কে কোন ফাটল ধরেনি অথবা সন্ধিপত্র বাতিল হয়নি। পরবর্তী ঘটনাগুলো থেকে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে।
দ্বিতীয় হিজরীতে মক্কার কাফির-মুশরিকরা আবিসিনিয়ায় একটি কূটনৈতিক মিশন প্রেরণ করে। মক্কার যে সমস্ত মুসলিম আবিসিনিয়ায় সম্রাট নাজ্জাশীর দরবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদের বহিষ্কারের জন্য দাবি উত্থাপন করাই ছিল মিশনের উদ্দেশ্য। প্রকৃতপক্ষে এ সমস্ত মুসলিম স্বগোত্রীয়দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সুদূর আবিসিনিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কাফির-মুশরিকদের দুরভিসন্ধির মুকাবিলা করা এবং দেশত্যাগী মুসলমানদের পক্ষে নাজ্জাশীর সমর্থন লাভের আশায় নবী করীম (সা:) ও একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। তার নাম আমর ইব্ন উমাইয়া আদ-মাদ্রী। অথচ তিনি তখনো ইসলাম গ্রহণ করেননি। তিনি ছিলেন উপরিউক্ত সংবিধানের স্বাক্ষরকারী এবং পার্শ্ববর্তী একটি মিত্র গোত্রের লোক।
এমন এক সময় এসেছিলো যখন সীমান্তের ব্যাপক অংশ জুড়ে অবিরাম যুদ্ধ চলছিল। অথচ সে সময়ে সামরিক বিভাগে চাকরি করে কেউ জীবিকা অর্জন করার কথা চিন্তাও করত না। কারণ সে সময়ে যুদ্ধে ঝুঁকির পরিমাণ ছিল বেশি। যারা সৈনিক হিসাবে যুদ্ধ করত তাদের আর্থিক অবস্থাও অস্বচ্ছল। আরবের অসংখ্য অমুসলিম হিসাবে যুদ্ধ করত তাদের আর্থিক অবস্থাও ছিল অস্বচ্ছল। আরবের অসংখ্য অমুসলিম তখন মুসলিম শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। তাদের শাসনকে মেনে নিয়েছিল অকপটে। তাছাড়া অন্য কারো সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে মুসলমানদের উৎখাত করার কোন চিন্তাও তাদের ছিল না। তবু এ সমস্ত অমুসলিমদের সম্পর্কে সন্দেহ থাকলে তাদেরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হত। অমুসলিমরা এতে বরং খুশি হত। অথচ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুসলমানদের ছুটে যেতে হত যুদ্ধের ময়দানে। এই অবসরে অমুসলিমরা নিজেদের কাজকর্ম ও ব্যবসা বাণিজ্য চালাতে পারত পুরো মাত্রায়। ফলে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি হতো। বিনিময়ে তারা জিযিয়া নামে অতিরিক্ত একটি ট্যাক্স দিত। অবশ্য মহিলা শিশু এবং দরিদ্রদের জিযিরা প্রদান করতে হত না।
জিযিয়ার পরিমাণও ছিল যৎসামান্য। নবী করীম (সা:)-এর আমলে একজন অমুসলিমের বাৎসরিক জিযিয়ার পরিমাণ ছিল মাত্র ১০ দিরহাম। এটা ছিল মোটামুটিভাবে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের দশ দিনের খরচের সমান। তাছাড়া একজন অমুসলিম যদি বছরের কোন সময়ে কোন যুদ্ধে অংশ নিত তাহলে সেও ঐ বছরের জিযিয়া প্রদান করা থেকে অব্যাহতি পেত। ইসলামের প্রাথমিক অবস্থায় মদীনা অথবা অন্য কোথাও জিযিয়া প্রদানের প্রচলন ছিল না। নবম হিজরীতে জিযিয়া সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হয়। বলে রাখা আবশ্যক যে, জিযিয়া ইসলামের অবশ্য পালনীয় কোন বিধান নয় বরং বিশেষ ব্যবস্থা ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে জিযিয়ার বিধান কার্যকর করা হয়। নিম্নের দুটি ঘটনা থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
ক. নবী করীম (সা:) এর এক ছেলের নাম ইবরাহীম (রা:)। তাঁর মা ছিলেন একজন মিসরীয় কিবতী মহিলা। ইবরাহীম (রা:) তখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত। সে সময়ে নবী করিম (সা:) বলেছিলেন যে, যদি ইবরাহীম আরোগ্য লাভ করে তাহলে ইবরাহীমের মায়ের সম্মানে কিবতীদের জিযিয়া থেকে অব্যাহতি দেবেন।
খ. ফুসতাত (কায়রো) থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত একটি খাল ছিল। হযরত উমর (রা:)-এর শাসনামলে একজন অমুসলিম মিসরবাসী চমৎকার একটি পরিকল্পনা নেয়। সে প্রস্তাব দেয় যে, এ খালটি পুন:খনন করা হলে নৌপরিবহনের উন্নতি ঘটবে এবং মিসর থেকে মদীনায় খাদ্য-খাবার পাঠান অনেকখানি সহজতর হবে। সেই খালটির নামই নহরে আমিরুল মু’মিনীন। খলীফা তাঁর পরামর্শে খুশি হয়ে তাকে গোটা জীবনের জন্য জিযিয়া প্রদান করা থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন।
তাছাড়া বর্তমানে অবস্থারও পরিবর্তন ঘটেছে। এখন বিশ্বের সর্বত্র ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে গেছে। লাখ লাখ মুসলমান অমুসলিম শাসনাধীন অঞ্চলে বসবাস করে। এমতাবস্থায় খৃষ্টান, ইয়াহুদী, হিন্দু অথবা অন্যদের উপর যদি জিযিয়া আরোপ করা হয় তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই খৃষ্টান এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর শাসনাধীন অঞ্চলে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে মুসলিম আইনবিদগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, জিযিয়া আরোপ করার সময় এ বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে।
একটি হাদীসে এরূপ উল্লেখ আছে যে, নবী করীম (সা:) মৃত্যুশয্যায় থাকা অবস্থায় হিজাজের খৃষ্টান ও ইয়াহুদী অধিবাসীদের অন্যত্র স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছিলেন। হাদীস শরীফে এ ধরনের নির্দেশ প্রদানের কোন কারণ উল্লেখ করা হযনি। তবে এটা স্পষ্ট যে, এ বিধানটি সর্বসাধারণের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। বরং কিছুসংখ্যক লোকের বিরুদ্ধে তাদের রাজনৈতিক আচরণের কারণে এরূপ অবস্থা নেয়া হয়েছিল।
বলে রাখা আবশ্যক যে, খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে অনেক মুসলমানের দাস-দাসী ছিল অমুসলিম। তাদের অনেকেই মনিবের সঙ্গে মক্কা ও মদীনায় বসবাস করত। এ প্রসঙ্গে একজন খৃষ্টান চিকিৎসকের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। পবিত্র কা’বা ঘরের মিনারের নিচেই ছিল তার চিকিৎসা কেন্দ্র (ইব্ন সা’দ) ঐতিহাসিক ইবন সা’দ আরো উল্লেখ করেছেন যে, জুফাইনা নামক একজন খৃষ্টান মদীনার একটি স্কুলের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখাতেন।
পরিশেষে নবী করীম (সা:) এর আরো দুটি হাদীসের উল্লেখ করা যেতে পারে। আল-মাওয়ারদী থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সা:) মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় বলেছেন, আমার তরফ থেকে অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়েছে, নিষ্ঠার সঙ্গে তা প্রতিপালন কর। তিনি আরো বলেছেন যে, কোন অমুসলিমের উপর যে নির্যাতন চালাবে, মেষ বিচার দিবসে সে আমাকে নির্যাতিতের পক্ষে সুপারিশকারী হিসাবে দেখতে পাবে (আবু দাউদ)। নবী করীম (সা:) আমাদের জন্য যে নির্দেশ রেখে গেছেন, নিজের জীবনে পরবর্তীকালের মুসলমানগণ এগুলোকেই আইন হিসাবে বিন্যস্ত করেছেন এবং বাস্তব জীবনে অনুসরণ করেছেন নিষ্ঠার সাথে। এখানে তার কিছু উদাহরণ উপস্থাপন করা হলো ঃ
একবার মহান খলীফা হযরত উমর (রা:) সিরিয়ার গভর্ণরকে রাজস্বের হিসাব সংরক্ষণের জন্য দক্ষ ও অভিজ্ঞ একজন গ্রীক অধিবাসীকে মদীনায় পাঠানোর নির্দেশ প্রযোজ্য। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার-উপযোগী একটি বিখ্যাত আইন গ্রন্থের নাম হিদায়া। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যে কোন প্রকার নিন্দা বা অপবাধ সেটা মুসলমান অথবা জিম্মী (অমুসলিম) যারা বিরুদ্ধেই হোক না কেন, তা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। ‘বাহর আর রায়ক’ নামক আইন গ্রন্থে আরো উল্লেখ আছে যে, একজন মৃত মুসলমানের দেহাবশেষ যেভাবে সম্মান করতে হয় তেমনি সম্মান করতে হয় একজন অমুসলিম (জিম্মী)-এর মৃতের দেহাবশেষকে। তাকে কোনভাবেই অপবিত্র করা যাবে না। কারণ কোন অমুসলিমকে যদি জীবদ্দশায় নিরাপত্তা দেয়া হয়, হিফাজত করা হয় অন্যায় অপবাদ থেকে তাহলে তার মৃত্যুর পর সকল প্রকার অপবাদ অপবিত্রতা থেকে রক্ষ করাটাও বাধ্যতামূলক। ফকীহগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যেমন শাস্তি সে পেত একজন মুসলিম রমনীর অমর্যাদা করলে। এ ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদগণের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই।
খলীফা হযরত উমর (রা:)-এর আমলের ঘটনা। কিছুসংখ্যক মুসলমান একজন ইয়াহুদীর জমিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। খলীফা উমর (রা:)-এর কাছে এ সংবাদ পৌছে, তখন তিনি মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলার এবং উক্ত জমিখন্ড ইয়াহুদী মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে লেবাননের খৃষ্টান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কারদাহী লিখেছেন ঃ বায়তুল ইয়াহুদীর সেই বাড়িটি এখনও বিদ্যমান রয়েছে (প্রাইভেট ইন্টারন্যাশনাল ল অফ ইসলাম, লেকচার সিরিজ, দি হেগ, ১৯৩৩)। দামেশকের প্রধান মসজিদ সম্পর্কেও অনুরূপ একটি মশহুর কাহিনী রয়েছে। ইবনে কাছীর এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকের বর্ণনায় বিষয়টি স্থান পেয়েছে ঘটনাটি এ রকম- একজন উমাইয়া খলীফা একটি মসজিদ সম্প্রসারণের সুবিধার্থে পার্শ্ববর্তী একটি চার্চ দখল করেন। পরবর্তীতে এ অভিযোগটি খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীযের নিকট উপস্থাপন করা হয়। ততক্ষণাৎ তিনি এ মর্মে নির্দেশ জারি করেন যে, গীর্জার যে অংশে বলপূর্বক মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে, তা ভেঙ্গে ফেলতে হবে এবং উক্ত স্থান গীর্জার জন্য নির্ধারিত থাকবে। যা হোক পরবর্তীতে খৃষ্টানরা অর্থের বিনিময়ে উক্ত ভূমিখন্ডের মালিকানা প্রত্যাহার করে নেয় এবং এভাবেই উভয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এখানে হযরত উমর ইব্ন আবদুল আযীয-এর আরেকটি নির্দেশনামার উল্লেখ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে বিস্তরিত বিবরণ পাওয়া যাবে ইব্ন সা’দের ইতিহাস গ্রন্থে। গভর্ণর আদি বিন আরতাতকে এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, অমুসলিমদের প্রতি নজর দাও এবং তাদের সঙ্গে বিনয় নম্র ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ যদি বার্ধক্যে পৌছে এবং নিজের বিষয় সম্পদ না থাকে, তাহলে তার ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা নেওয়া তোমার দায়িত্ব। যদি তার কোন আপনজন থাকে, তবে তার কাছ থেকে ভরণ-পোষণ বাবদ অর্থ আদায় কর। যদি কেউ তার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করে তাহলে প্রতিশোধ নাও। আমি জানতে পেরেছি তুমি আমদানিকৃত মদের এক দশমাংশ আদায় কর এবং তা সরকারী কোষাগারে জমা দাও। স্মরণ রেখো যে, এই কোষাগার তোমারও নয়, আমারও নয়। এর মালিকানা আল্লাহর। আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি যে, এ জাতীয় সম্পদ-এর পরিমাণ যত সামান্যই হোক না কেন, আর কখনো তা সরকারী কোষাগারে জমা নেবে না। যদি তুমি সম্পদের পবিত্রতা সম্পর্কে নিশ্চিত হও তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। তোমার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এখানে উমর ইব্ন আবদুল আযীযের আরো একটি পত্রের উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। পত্রের বিষয়বস্তু এ রকম ঃ পুরাতন নথি-পত্রগুলো পর্যালোচনা কর। অন্যায়ভাবে কর আরোপ সংক্রান্ত উত্থাপিত আপত্তি এবং অন্যায় অবিচার করলে তার সংশোধন কর এবং প্রত্যেককেই তার ন্যায্য পাওনা ভোগ করতে দাও। অত্যাচার জর্জরিত কোন লোক যদি মারা যায় তাহলে তার উত্তরাধিকারীর নিকট তার পাওনা হস্তান্তর কর। এটা সকলের জানা কথা যে, কোনকিছু ক্রয় বা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে দূরের লোক অপেক্ষা প্রতিবেশীরা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। ফকীহগণও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। এটা অমুসলিমদের ক্ষেত্রেও একটি স্বীকৃত নীতি। অমুসলিমদের এমন কতকগুলো রীতিনীতি বা প্রথা আছে যেগুলো ইসলামী আক্বীদা বা আচার-আচরণের পরিপন্থী। তদসত্ত্বেও ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিমরা এ সমস্ত রীতিনীতি বা প্রথা মেনে চলার অধিকার ভোগ করে থাকে। যেমন- মদ্যপান মুসলমানদের জন্য হারাম। অথচ অমুসলিম নাগরিকরা ইচ্ছামত মদ্যপান করতে পারে। এমনকি মদ আমদানি, উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ পেয়ে থাকে। অনুরূপভাবে তারা জুয়া খেলতে, নিকটাত্মীয়কে বিয়ে করতে ও সুদী কারবারে লিপ্ত হতে পারে। অথচ অমুসলমানদের জন্য এসবকিছু নিষিদ্ধ বা হারাম।
ইসলামের প্রথম যামানায় অমুসলিমদের এ সমস্ত অনৈসলামিক কাজকর্ম মুসলমানদের উপর কোন প্রভাব ফেলতে পারত না। এমনকি এ সমস্ত বিষয়ের প্রতি মুসলমানরা বড় একটা আমলও দিত না। তবে আধুনিক আইন বিশারদগণের মতে সুখী সমাজ ও সুন্দর বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য মদের ব্যবসা বা মদ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকলে চলবে না, সমাজের গোটা জনগোষ্ঠীর উপর এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করা আবশ্যক। এ ব্যাপারে অমুসলিম চিন্তাবিদগণও অনুরূপ ধারণা পোষণ করেন। তদনুসারে একজন খৃষ্টানকে মদীনায় পাঠনো হল এবং তাকে নিয়োগ করা হলো রাজস্ব প্রশাসনের প্রধান হিসাবে (দ্র. আল-বালাযুরী, আনসা)
এমনকি কখনো কখনো খলীফা হযরত উমর (রা:) অমুসলিমদের সঙ্গে সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনেতিক, প্রশাসনিক বিষয়ে আলোচনা করতেন। ইসলামে ইমামের (মসজিদের ইমাম) পদটি মুসলমানদের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। ইসলাম আধ্যাত্মিক এবং পার্থিব জীবনের মধ্যে সমন্বয়ের বিধান দিয়েছে। সে কারণেই নামাযে ইমামতি করা রাষ্ট্র প্রধানের যেমন দায়িত্ব তেমনি এটা তার একটি অধিকার। এভাবে যদি বিষয়টি বিবেচনা করা হয় তাহলে কোন অমুসলিম মুসলিম দেশের রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচিত হতে পারেন না। বস্তুতপক্ষে এটা একটা ব্যতিক্রম। এর অর্থ এই নয় যে, দেশের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কর্মকান্ড থেকে অমুসলিম নাগরিককে বাদ দিতে হবে।
খলীফাগণের আমল থেকেই মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমরা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে, এমনকি মন্ত্রীর পদ-মর্যাদার নিয়োগ পেয়েছেন। শাফি’ঈ মযহাবের আল-মাওয়ারদী এবং হাম্বলী মযহাবের আবু ইয়া’লা আল-র্ফারা খলীফা কর্তৃক অমুসলিম নাগরিককে মন্ত্রী হিসেবে এবং নির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে নিয়োগ সমর্থন করেছেন। প্রিয়নবী (সা:) নিজেই একজন অমুসলিমকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে আবিসিনিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। বিশ্বের দরবারে যে সমস্ত দেশ ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ধারক বলে পরিচিত সে সমস্ত দেশেও এরূপ নজীর পাওয়া যাবে না।
ইসলামের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই যে, এখানে অমুসলিমদেরকে সামাজিক এবং বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। কুরআনুল করীমে উল্লেখ আছে যে, তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি এর পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবের সমর্থক ও সংস্কারকরূপে। সুতরাং আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে তুমি তাদের বিচার নিষ্পত্তি করবে এবং যে সত্য তোমার নিকট এসেছে তা ত্যাগ করে তাদের খেয়াল খুশির অনুসরণ করবে না (৫ : ৪২-৪৮)।
কুরআনুল করীমের এই নির্দেশের প্রেক্ষিতেই নবী করীম (সা:) এবং খলীফাগণ ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদের বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে স্বাধিকার প্রদান করেছিরেন। তারা স্বাধিকার ভোগ করেছিল দেওয়ানী, ফৌজদারী, ব্যক্তি আইন প্রভৃতি সকল বিষয়ে। খলীফাগণের সমসাময়িক কালে খৃষ্টানদের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, মুসলিম শাসনামলে খৃষ্টান যাজকদের বিচারের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার-উপযোগী একটি বিখ্যাত আইন গ্রন্থের নাম হিদায়া। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যে কোন প্রকার নিন্দা বা অপবাদ সেটা মুসলমান অথবা জিম্মী (অমুসলিম) যার বিরুদ্ধেই হোক না কেন, তা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। ‘বাহর আর রায়ক’ নামক আইন গ্রন্থে আরো উল্লেখ আছে যে, একজন মৃত মুসলমানের দেহাবশেষ যেভাবে সম্মান করতে হয় তেমনি সম্মান করতে হয় একজন অমুসলিম (জিম্মী)-এর মৃতের দেহাবশেষকে। তাকে কোনভাবেই অপবিত্র করা যাবে না। কারণ কোন অমুসলিমকে যদি জীবদ্দশায় নিরাপত্তা দেওয়া হয়, হিফাজত করা হয় অন্যায় অপবাদ থেকে তাহলে তার মৃত্যুর পর সকল প্রকার অপবাদ অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করাটাও বাধ্যতামূলক। ফকীহগণ ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন যে, একজন মুসলিম কোন অমুসলিম রমনীর অমর্যাদা করলে সে তেমন শাস্তি পাবে যেমন শাস্তি সে পেতো একজন মুসলিম রমনীর অমর্যাদা করলে। এ ব্যাপারে ইসলামী আইনবিদগণের মধ্যে কোন মতানৈক্য নেই।
খলীফা হযরত উমর (রা:)-এর আমলের ঘটনা। কিছুসংখ্যক মুসলমান একজন ইয়াহুদীর জমিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। খলীফা উমর (রা:)-এর কাছে এ সংবাদ পৌছে, তখন তিনি মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলার এবং উক্ত জমি খন্ড ইয়াহুদী মালিককে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ১৯৩৩ খৃষ্টাব্দে লেবাননের খৃষ্টান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক কারদাহী লিখেছেন ঃ বায়তুল ইয়াহুদীর সেই বাড়িটি এখনও বিদ্যমান রয়েছে (প্রাইভেট ইন্টারন্যাশনাল ল অফ ইসলাম, লেকচার সিরিজ, দি হেগ, ১৯৩৩) দামেশকের প্রধান মসজিদ সম্পর্কেও অনুরূপ একটি মশহুর কাহিনী রয়েছে। ইবনে কাছীর এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকের বর্ণনায় বিষয়টি স্থান পেয়েছে। ঘটনাটি এ রকম- একজন উমাইয়া খলীফা একটি মসজিদ সম্প্রসারণের সুবিধার্থে পার্শ্ববর্তী একটি চার্চ দখল করেন। পরবর্তীতে এ অভিযোগটি খলীফা উমর বিন আব্দুল আযীযের নিকট উপস্থাপন করা হয়। তৎক্ষণাৎ তিনি এ মর্মে নির্দেশ জারি করেন যে, গীর্জার যে অংশে বলপূর্বক মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে তা ভেঙ্গে ফেলতে হবে এবং উক্ত স্থান গীর্জার জন্য নির্ধারিত থাকবে। যা হোক পরবর্তীতে খৃষ্টানরা অর্থের বিনিময়ে উক্ত ভূমিখন্ডের মালিকানা প্রত্যাহার করে নেয়। এবং এভাবেই উভয়ের মধ্যে একটি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এখানে হযরত উমর ইব্ন আব্দুল আযীয-এর আরেকটি নির্দেশনামার উল্লেখ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যাবে ইবন সা’দের ইতিহাস গ্রন্থে। গভর্ণর আদি বিন আরতাতকে এ মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, অমুসলিমদের প্রতি নজর দাও এবং তাদের সঙ্গে বিনয় নম্র ব্যবহার কর। তবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার-আচরণের ক্ষেত্রে যে বিভিন্নতা রয়েছে মুসলিম আইনবিদগণ সে সব বিষয়ে কোন রকম হস্তক্ষেপ করেন না।
ইসলাম অমুসলিম সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একটি পার্থক্য নির্ধারণ করে দিয়েছে।  মুসলমানদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কেও রয়েছে বিভিন্নতা। এদের মধ্যে একটি হল আহলে কিতাবী অন্যটি কিতাব বহির্ভূত জনগোষ্ঠী। যারা আহলে কিতাবী তারা এক আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখে এবং তাদের নবীর উপর যে বিধি-বিধান নাযিল হয়েছে তা মেনে চলে। ইয়াহুদী ও খৃষ্টানরা আহলে কিতাবীদের অন্তর্ভূক্ত। অন্য দলটি এর ঠিক উল্টো। এদের কোন আসমানী কিতাব নেই। অথবা এরা এক আল্লাহর উপর ঈমান রাখে না। এদের মধ্যে রয়েছে পুতুল পূজারী ও নাস্তিক শ্রেণীর লোকেরা। অবশ্য সকল সম্প্রদায়ের লোকই ইসলামী রাষ্ট্রে স্বাধীন নাগরিক হিসাবে বসবাস করবে, জীবনের নিরাপত্তা পাবে এবং মতামত প্রকাশেরও সুযোগ থাকবে। তবু ব্যক্তিজীবনে একজন মুসলমানের সঙ্গে তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারতম্য থাকবে। যেমন একজন মুসলমান আহলে কিতাবী মহিলাকে বিয়ে করতে পারে। কিন্তু আহলে কিতাবী নয় এমন মহিলাকে সে বিয়ে করতে পারে না। তাছাড়া মুসলমানের স্ত্রী হয়েও একজন ইয়াহুদী বা খৃষ্টান মহিলা তার নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে চলতে পারে। গীর্জা বা নিজস্ব উপাসনালয়ে যেতে পারে, এমনকি পানীয় পান করতে পারে। কিন্তু একজন মুসলিম মহিলা কখনো অমুসলিম এমনকি আহলে কিতাবীর স্ত্রী হতে পারে না (৬০ ঃ ১০)। আবার একজন মুসলমান আহলে কিতাবী নয় এমন কোন লোকের জবাই করা পশুর গোশ্্ত খেতে পারে না। ইসলাম একজন অমুসলিমকে স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম করার অধিকার দিয়েছে। নিষিদ্ধ করেছে জোর করে কাউকে ইসলামে দীক্ষিত করবার উদ্যোগকে। পক্ষান্তরে ইসলাম মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত কঠোর শৃঙ্খলা সংরক্ষণ করে।
ইসলামে জাতীয়তার মূল ভিত্তি হচ্ছে দীন বা ধর্ম। ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা আঞ্চলিকতার প্রশ্নটি এখানে একেবারেই গৌণ। আর সে কারণেই স্বধর্মত্যাগ স্বাভাবিকভাবেই রাজদ্রোহ বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা হিসাবে বিবেচিত হয়। এজন্য ইসলামে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় এই যে, ইসলামের ইতিহাসে জাতীয় রাজদ্রোহের ঘটনা খুবই বিরল। এবং শাস্তি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তাও বড় একটা দেখা যায়নি। এমন একটা সময় ছিল যখন প্রশান্ত অঞ্চল হতে আটালান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছিল মুসলিম রাজত্ব। বর্তমানে অবস্থার অনেক পরির্তন হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে পড়েছে। এতকিছুর পরেও মুসলিম বিশ্বের কোথাও কোন মুসলমান ধর্ম ত্যাগ করেছে এমন কথা শোনা যাবে না। উপনিবেশিক শক্তির মুসলমানদের ধর্মান্তর করার জন্য সম্ভাব্য সকল উদ্যোগের মুখেও কোনো মুসলিমের ইসলাম পরিত্যাগের খবর শোনা যায় না। বিবেকবান মানুষের জন্য এটা সত্যিকার অর্থেই বিস্ময়কর ব্যাপার। বরং বর্তমান সময়ে পাশ্চাত্য জগতেও ইসলাম যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছে। ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, ইটালী, কানাডা থেকে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগ থেকে শোনা যাচ্ছে ইসলামের আহ্বান। অথচ এ জন্য মুসলমানদের সুসংগঠিত কোন দাওয়াতী কার্যক্রম নেই।
মুসলমানদের গোটা জীবনটাই আসমানী বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আধ্যাত্মিক ও জাগতিক সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। কেউ যদি কেবলমাত্র লোক দেখানোর জন্য নামায পড়ে, আল্লাহকে খুশি করার দৃঢ়তা তার মধ্যে না থাকে, তখন তার নামায ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না। বরং এটা হবে আল্লাহ পাকের সঙ্গে নাফরমানী। এ ধরনের নামাযের জন্য শেষ বিচার দিনে তাকে শাস্তি পেতে হবে।
অপরদিকে কোন মুসলিম যদি এই উদ্দেশ্যে খাবার গ্রহণ করে যে, খাদ্য খাবার খেলে শরীরে শক্তি বাড়বে, এই শক্তি আল্লাহর হুকুম আহকাম পালনে সহায়ক হবে, তখন এই পানাহার বিবেচিত হবে ইবাদত হিসাবে। এমনকি স্বামী-স্ত্রী যদি আল্লাহর প্রতি আনুগত্য রেখে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী সংসার গড়ে তোলে তাহলে সেটাও নেক কাজ হবে। সকল প্রকার যুদ্ধকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে ন্যায়সঙ্গত কারণে যে যুদ্ধের আয়োজন করা হয়, যে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রিত হয় ইসলামী বিধি-বিধান দ্বারা, কেবলমাত্র সে যুদ্ধকে ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ বলা হয়।
নবী করিম (সা:) এর জীবনী পাঠ করলে তিন ধরনের যুদ্ধ সম্পর্কে জানা যায়। যেমন- প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ, শাস্তি প্রদানের জন্য যুদ্ধ এবং প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ। এক তথ্যে জানা যায়, রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে একজন মুসলিম দূতকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ ব্যাপারে রোমান সম্রাট হিরাকিলিয়াসের সঙ্গে নবী করীম (সা:)-এর এক ঐতিহাসিক পত্র যোগাযোগ হয়। পত্রে তিনি সম্রাটকে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব দেন। প্রথমত: কলেমা পড়ে ইসলামের পতাকা তলে শামিল হও। দ্বিতীয়ত: ইসলাম গ্রহণ না করলে ‘জিযিয়া’ প্রদান কর। তৃতীয়ত: অন্যথায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। (আবু উবায়দ, কিতাবুল আওয়াল, পৃ: ৫৫)
প্রত্যেক মানুষেরই বিবেকের রায় অনুসারে চলার স্বাধীনতা রয়েছে। এ অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল নবী করীম (সা:)-এর জিহাদের প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মুসলমানদের জন্য এটাই হলো প্রকৃত জিহাদ। শোষণ করার মনোভাব নিয়ে এ যুদ্ধ করা যাবে না। মনে রাখা যাবে না নিজের স্বার্থের কথা। আল্লাহর আইন, আল্লাহর হুকুম কায়েম করাই হবে জিহাদের একমাত্র লক্ষ্য।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিষ্ট।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button